ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

অস্থিরতায় বিএনপি

রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৫, ২৭ মে ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অস্থিরতায় বিএনপি

বিএনপির লোগো

রেজা পারভেজ : টানা তিন মাস সরকারবিরোধী আন্দোলনের ফল ঘরে তুলতে ‘ব্যর্থ’ বিএনপির নেতা-কর্মীরা এই মুহূর্তে রয়েছেন চরম অস্থিরতার মধ্যে। মামলা, জেল আর গ্রেফতার-আতঙ্কে আন্দোলন পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি তারা। বিশেষ করে মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। সারা দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।

 

নেতা-কর্মীরা বলছেন, ভালো নেই তারা। সক্রিয় আন্দোলনে থাকার কারণেই অনেকের ব্যক্তিগত জীবনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তারা। অনেকে মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে ফেরারি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমনও অনেক জেলা রয়েছে, যেখানে নেতা-কর্মীরা ছয় মাসেরও বেশি সময়ে ধরে বাড়িছাড়া।

 

যেমনটি বলছিলেন ফরিদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি মো. জহিরুল হক শাহজাদা মিয়া। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘বিএনপির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে আমার ব্যক্তিগত ব্যবসায় ধস নেমেছে। সরকার সমর্থকরা আমার ব্যবসাকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এমনকি আমার ঠিকাদারি লাইসেন্সও বাতিল করা হয়েছে।’

 

শাহজাদা মিয়া বলেন, ‘টানা ৮৮ দিন এলাকায় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছি। সরকারের দমন নীতি আর অত্যাচারের কারণে নেতা-কর্মীদের মাঠে নামতে সমস্যা হলেও ফরিদপুরে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। একইভাবে অন্যান্য জেলায় আন্দোলন হলেও ঢাকায় একটি মিছিলও হয়নি। ঢাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারার কারণেই আন্দোলন ফলপ্রসূ হয়নি।’

 

আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ এই সময়ে তিনি ৭-৮টি মামলার আসামি হয়েছেন জানিয়ে বলেন, ‘শুধু আমি না, এমন কোনো সক্রিয় নেতা-কর্মী নেই যার নামে একাধিক মামলা নেই।’

 

এদিকে অস্থিরতা থেকে পিছিয়ে নেই বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও। সূত্রমতে, দলটির শীর্ষ পর্যায়ের বেশির ভাগ নেতা এখনো গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় এসব নেতা জনসমক্ষে এলেও সম্প্রতি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিনকে ভারতের শিলংয়ের একটি হাসপাতালে পাওয়ার পর তাদের মধ্যে আতঙ্ক আরো বেড়ে গেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যে, সালাহ উদ্দিন ইস্যুতে কেউ মুখ খুলছেন না। গত সিটি নির্বাচনের কিছুদিন আগে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসকে আদালত প্রাঙ্গণে দেখা গেলেও ভোটের আগ থেকেই তিনি জনসমক্ষে আসছেন না। এদিকে মাঝেমধ্যে হঠাৎ দেখা গেলেও প্রকাশ্যে নেই ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলও। আর দলের মহাসচিব থেকে শুরু করে বিএনপি নেতাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ রয়েছে জেলে। নাশকতার একাধিক মামলায় তারা এখন বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন।

 

এদিকে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা জানান, মামলা চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন তারা। দল থেকে আইনি সহায়তা না পাওয়ায় এখন দিশেহারা নেতা-কর্মীরা। এতে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেওয়া তো দূরের কথা, এখন মামলা-মোকদ্দমা মোকাবিলা করতেই বিপর্যস্ত বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতারা। আর দলের পক্ষ থেকে এসব নির্যাতিত নেতা-কর্মীকে আইনি সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ আছে বলে জানিয়েছেন ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা।

 

দলের জন্য এত নির্যাতিত হওয়ার পরও অনেক সময় দলের কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের চিনতেই পারেন না বলে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক অভিযোগ আছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নেতা-কর্মীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় পর্যায়ে মনিটরিং সেল থাকলেও মামলা এবং গ্রেফতার সম্পর্কিত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই সেখানে। এতে সারা দেশে নেতা-কর্মীদের নামে মামলা ও গ্রেফতার বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য জানাতে পারেননি কেউ।

 

তবে জানা গেছে, সারা দেশে প্রায় ২০ হাজার মামলার খড়্গ ঝুলছে দলটির পাঁচ লক্ষাধিক নেতা-কর্মীর ঘাড়ে। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মামলা ও আসামির সংখ্যা বেড়েই চলেছে দিন দিন। শতাধিক মামলার আসামিও করা হয়েছে দলের অনেক নেতাকে। আগের পাঁচটিসহ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখন পর্যন্ত অন্তত ১৮ মামলার আসামি। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও এ পর্যন্ত অন্তত ২৮টি মামলা দায়ের হয়েছে।

 

হাইকমান্ডসহ দলটির উল্লেখযোগ্য নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে চার শতাধিক মামলা। জিয়া পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে রয়েছে প্রায় অর্ধশত মামলা। একইভাবে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ৭৩টি মামলার আসামি হয়ে বর্তমানে কারাগারে। তার বিরুদ্ধে অন্তত ২৫ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের দুই মেয়াদে ষষ্ঠবারের মতো জেল খাটছেন তিনি।

 

বিভিন্ন মামলায় অনেকে জামিন নিয়ে আছেন, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, আবার নতুন মামলায় গ্রেফতার আতঙ্কে গা-ঢাকা দিয়েছেন।

 

গ্রেফতার আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে ঢাকায় অবস্থান করছেন জানিয়ে নড়াইল জেলা বিএনপির সভাপতি বিশ্বাস জাহাঙ্গীর আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার নামে চার-পাঁচটি মামলা আছে, নেতা-কর্মীরা সবাই আসামি। জেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা শত কষ্ট করে আন্দোলন করেছে।’

 

দল পুনর্গঠনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘পুনর্গঠনে যদি দল শক্তিশালী হয়, তবে করা হোক। কিন্তু এটা বলতে পারি, জেলায় যেভাবে আন্দোলন হয়েছে ঢাকায় সেভাবে হয়নি। আর ঢাকায় আন্দোলন ফলপ্রসূ না হওয়ার পেছনে জেলার নেতা-কর্মীরা দায়ী নয়।’

 

দলের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা জানার জন্য কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আছেন জানিয়ে বগুড়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চাঁন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মামলা-হামলায় নেতা-কর্মীরা ভালো নেই। তারা অনেকে স্বাভাবিক জীবন থেকে দূরে রয়েছেন। নেতা-কর্মীদের নামে গড়ে ১০/১২টা করে মামলা রয়েছে। আমার নিজের নামেও ৮টি মামলা রয়েছে। এই অবস্থায় দল কী সিদ্ধান্ত নেয় তার অপেক্ষায় আছি।’

 

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে নেতা-কর্মীদের একের পর এক মামলায় জড়াচ্ছে। এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কৌশল। সরকারকে এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’

 

নেতা-কর্মীদের আইনি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘অসংখ্য নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এদের সবার দিকে সব সময় হয়তো সমান দৃষ্টি দেওয়া হয়ে ওঠে না। আবার অনেকে হয়তো সহায়তা নিতে আমাদের কাছে আসেননি। যারাই আমাদের নজরে এসেছেন, আমরা সহায়তা দিয়েছি এবং দিয়ে যাচ্ছি।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ মে ২০১৫/রেজা/লেনিন/শাহনেওয়াজ/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়