ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

আঁচল পেতে দিয়েছিল দু’দণ্ড বসার জন্য

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৮, ২৩ আগস্ট ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আঁচল পেতে দিয়েছিল দু’দণ্ড বসার জন্য

ফেরদৌস জামান : রাতের খাবার শেষে তেঁতুল তলার অন্ধকারে মাচায় বসে চলছিল দিনতামামী- সারাদিনে কী করা হলো, কী হলো না সেই হিসাব। সাথে ছিল স্থানীয় মৌজা প্রধানের ছেলে পাখুন বম ও নাতি টাহুম বম। টাহুম খুব করে চেয়েছিল আর দুটো দিন থেকে যাই। মৌজা প্রধান লালকম বাবু অতি সজ্জন লোক। হঠাৎ নিমন্ত্রণের অতিথি হলেও যা করেছেন তা ভুলবার নয়।

 

জায়গাটি উপজেলা সদর রুয়াংছড়ি থেকে পায়ে হেঁটে পাক্কা এক দিনের পথ। যদিও স্থানীয়দের নিকট মাত্র চার ঘণ্টার ব্যাপার। শোয়ার সময় হয়ে গেছে অনেক আগেই তবুও উঠতে ইচ্ছা করছে না। ওদিকে রাত পোহালেই বিদায়ের পালা। কোথায় যেন অতৃপ্তি রয়ে গেল। জীবনে তা কি আর পূরণ হবার না কি বয়ে নিয়েই চলতে হবে? কী সেই অতৃপ্ত বাসনা, কী সেই অদৃশ্য টান?- পেছনে ফেলে আসা মেঘের মাঝে একাকি দাঁড়িয়ে থাকা সেই জুম ঘর। চারিদিকে শত শত পাহাড় চূড়া, যেন সকলে মিলে ওকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাচ্ছে। আর সর্বোচ্চ জায়গাটিতে বসে সে প্রত্যেকের মাথায় আশীর্বাদের হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে। হাজার বছর ধরে চলছে এই শ্রদ্ধা নিবেদন আর আশীর্বাদ প্রদানের নিরন্তর খেলা। জুম ঘরটাকে কেন জানি প্রিয়তমার মত মনে হচ্ছিল। আঁচল পেতে দিয়েছিল দু’দণ্ড বসবার জন্য। কিন্তু ক্ষণিকের ভালোবাসায় যেন তৃপ্তি মিটল না! তিনদিন আগে বৃষ্টির ফোটা পড়তেই যখন আশপাশের সব কিছু অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, আমরাও পথ হারাতে বসেছিলাম ঠিক সেই পরিস্থিতিতে একমাত্র ভরসা হয়ে দেখা দিয়েছিল জুম ঘরটি। এই তাহলে সেই অতৃপ্তি? অজান্তেই মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে- ঘরটা বড় টানছে, একটা রাত যদি কাটানো যেত! বাকিদের তাৎক্ষনিক  প্রতিক্রিয়ায় বুঝতে পারি অতৃপ্ত শুধু আমি একা নই বরং সকলেই।

 

রাসেল বলল, দারুণ আইডিয়া! তেঁতুল তলার অন্ধকারে দেখা গেল রোকন তার সাদা ফুলহাতা গেঞ্জি পড়া হাতটা সম্মতি জ্ঞাপনস্বরূপ আগেই তুলে রেখেছে। টর্চের আলো আমার মুখে ধরে টাহুম বলল, সত্যি বলছো বন্ধু? ব্যস, কাল তাহলে জুম ঘরে রাত্রিযাপন।

 

Travel

 

ঘুম থেকে উঠে পাখুন চললো বাজারে। আগের দিন বাগান থেকে দশ ঝুরি লিচু পেড়ে রেখেছে। পাইকারের সাথে কথা হয়ে আছে শুধু বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসবে। তারপরও ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে। ফেরার সময় সে তিনটা মুরগি নিয়ে আসবে বলেছে। এদিকে আমাদের সময় দেয়ার জন্য রয়েছে টাহুম। জুমে জুমে চলছে আদা রোপণের ধুম। আমাদের খাতিরে সেদিন আর জুমে গেল না। শুধু সে নয় তার স্ত্রীও গেল না। কারণ সকালে নাস্তার আয়োজন তার বাড়িতে। মৌসুমে একদিন কাজ বাদ গেলে অনেক ক্ষতি কিন্তু তারা সেই ক্ষতি হেসেই মেনে নিল। পাঁচ বছর হলো তাদের বিয়ের বয়স। ইতিমধ্যেই দুই সন্তানের জনক-জননী। দেরি করে ঘুমানোর ফল যা হয়, রোকনকে বিছানা থেকে টেনে তুলতে পেরিয়ে গেল আরও আধা ঘণ্টা। তারপর সাজগোজ, এই সেই করতে করতে সাড়ে আটটা। পাহাড়ে সকাল সাড়ে আটটা মানে অনেক বেলা। এদিকে টাহুম আমাদের নিতে এক ঘণ্টা আগে এসে বসে আছে। ওর বাড়িটা দাদুর বাড়ির থেকে আরও খানিকটা উঁচুতে। ঝকঝকে-তকতকে সম্পূর্ণ কাঠের বাড়ি। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কাঁঠাল, লিচু, আনারস, লটকন এবং কলা। সাথে বিন্নি চালের পিঠা।

 

আমার চোখ তো আটকে গেছে রসে টসটসে কাঁঠালের রোয়ার দিকে। আয়োজন দেখে মাথায় হাত! সাতসকালে এতো সব কীভাবে? পড়ালেখা জানা টাহুমের স্ত্রী বলল, সব আমাদের নিজস্ব বাগানের। ভোরে উঠে স্বামী-স্ত্রী দুজনে বাগান থেকে জুরি ভরে সংগ্রহ করে এনেছে। অচেনা অজানা মানুষ আমরা, মাত্র দুই দিন আগে পরিচয়। অথচ আন্তরিকতায় কোনো কমতি নেই। ফলাহার চলছে, হঠাৎ টাহুম লাফিয়ে উঠে দা হাতে দৌড় দিল। দুই মিনিটের মধ্যে ফিরে এলো, হাতে দুটি পাকা পেঁপে। বলল, কাল রাতেই পেঁপে দুটির কথা ভেবে রেখেছিলাম। ডানপিটে স্বভাবের টাহুম দুই সন্তানের জনক অথচ দু’দণ্ড স্থির থাকার নয়। তাতে ওর স্ত্রী হেসে বলে, সন্তান আমার দুইটা কিন্তু সামলাতে হয় তিনটাকে।

 

Travel_1

 

তারপর পাড়ার এ বাড়ি, সে বাড়ি ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কখন যে কীভাবে এতটা সময় পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। বাজার থেকে পাখুন ফিরেছে। নিজেরাই মুরগি কেটে হলুদ, লবণ ও মশলায় মাখিয়ে ব্যাগে ভরে নিলাম। সাথে যাবতীয় অন্যান্য রসদ। রান্না হবে জুম ঘরে। পাড়া থেকে জুমের দূরত্ব দেড় ঘণ্টার পথ, শুধুই উপর দিকে ওঠা। প্রত্যেকের পিঠে দুইটি কম্বল এবং চার লিটার করে পানি। জুমে পৌঁছার আগেই যেন রাজ্যের ক্ষুধা এসে জেঁকে বসল। রাসেল আর পাখুনের দায়িত্ব খিচুরি রান্না করা। টাহুম এবং আমার দায়িত্ব মুরগির মাংস ঝলসানো। বাকি থাকে রোকন। রোকনের দায়িত্ব বিরতিহীন গল্প করা। অর্থাৎ গল্পের তালে তালে চলতে থাকবে যার যার কাজ। আপাতত দিনের আলো যতক্ষণ আছে প্রাণ ভরে প্রকৃতিটাকে দেখে নেয়া যাক। সূর্য পশ্চিমে হেলে যেতে যেতে টুপ করে আড়াল হল চিম্বুক রেঞ্জের ওপারে। অমনি কমলা রঙের আবির আভা ছড়িয়ে পড়ল পশ্চিম আকাশের কোণায় কোণায়। অলস মেঘের আস্তরণের আড়াল ভেঙ্গে সেই আভা এসে রাঙিয়ে দিল শনে ছাওয়া জুম ঘরের সোনালী ছাউনি। সকলেই নির্বাক, কারও মুখে কোন কথা নেই। মাঝে মাঝে কেবল ক্যামেরার বাটনে চাপ পরে নিস্তব্ধ গোধূলী লগ্নে বেজে উঠছে ক্লিক ক্লিক...।

 

Travel_2

 

রাত্রি নামল সাথে ষোল কলার পূর্ণতা। মাথার উপর থেকে ঠিক হালকা পূর্ব আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল কাঁসার থালার মত একটি চাঁদ। দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ শুরু হয়ে গেল। রান্না পর্যন্ত আর কারও সইছিল না! এমন পরিস্থিতিতে রোকন বলল, কে জানতো এতটা ক্ষুধা পেয়ে বসবে, তাহলে কাঁধে করে আস্ত একটি কাঁঠাল নিয়ে আসতাম! কথা বলতে বলতে পেঁপে আনতে যাওয়ার মত ঠিক একই ভঙ্গিতে নিচ দিকে দৌড় দিল টাহুম। তবে এবার হাতে দা নয়, টর্চ লাইট। কারণ জানতে চাইলে পাখুন শুধু মুচকি হাসে। কয়েক মিনিট পর ফিরে এলো, তবে একা নয় হাতে একটি কোয়েল পাখি। সবাই তো অবাক, কীভাবে সম্ভব! তাছাড়া কোয়েল পাখি খাঁচায় ছাড়া বনে জঙ্গলে পাওয়া যায় বা থাকে তা আগে জানা ছিল না। পাহাড়, প্রকৃতি আর বন-জঙ্গলের সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে টিকে থাকাই পাহাড়িদের জীবন। সুতরাং, প্রকৃতির ভাষা তারা বোঝে। টের পায় প্রকৃতির আচার আচরণ এবং চারপাশে ঘটে যাওয়া অনেক কিছু। কোথায় কখন কী শব্দ বা ডাক শুনতে পেল অমনি গিয়ে খপ করে একটি কোয়েল পাখি ধরে আনল। অথচ পাশে বসে থেকেও আমরা কিছু বুঝলাম না। যেমন আগের রাতে তার দাদু নিশ্চিত করে বলেছিলেন, পরের দিন বৃষ্টি হবে না এবং বাতাস থাকবে। রাতের গভীরতার সাথে সাথে উজ্জল হয়ে উঠল দূর পাহাড়ের বাতিগুলো। ডান দিকে চিম্বুক সেনা ক্যাম্প আর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাতির মিটিমিটি থোকাটা রুমা সেনা ক্যাম্পের। দুই-চার কিলোমিটারের মধ্যে কেউ নেই। একাকি জুম ঘরটায় কেবল আমরা ক’জন। গল্প হচ্ছে, সাথে কবিতা আর দু’চার লাইন গান...।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ আগস্ট ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়