ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

আইএস আছে আইএস নেই

শাহেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৯, ২৬ নভেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আইএস আছে আইএস নেই

শাহেদ হোসেন : আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের আড়াই বছরও পূর্ণ হয়নি মধ্যপ্রাচ্যের চরমপন্থি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য রীতিমতো আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে সংগঠনটি। আলোচিত-সমালোচিত এই সংগঠনটির জন্ম, বিকাশ, কার্যক্রম নিয়ে গোয়েন্দাসংস্থাগুলো বিভিন্ন তথ্য দিচ্ছে। আবার অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে, এটি মুসলমান চরমপন্থি কোনো সংগঠন নয়; বরং মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের সৃষ্টি একটি অগ্রগামী দল।

 

আমেরিকা ২০০৩ সালে ইরাক দখলের পর ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জামাত আল-তাওহিদ ওয়াল জিহাদ নামের একটি সংগঠন। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবু মুসাব আল-জারকায়ি। ২০০৬ সালে আমেরিকার বিমান হামলায় তার মৃত্যুর পর সংগঠনটির নেতা নির্বাচিত হন আবু উমর আল-বাগদাদি। তিনি ২০০৬ সালে সংগঠনটির নাম দেন ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক । ২০১০ সালে সংগঠনটির নেতা নির্বাচিত হন আবু বকর আল-বাগদাদি।  সিরিয়ার একটি বিরাট অংশ দখলের পর ২০১৩ সালের এপ্রিল দলের নাম বদলে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড দ্য লেভান্ট রাখা হয়। ২০১৪ সালের ২৯ জুন খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন সংগঠনের প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি। একই সঙ্গে তিনি নিজেকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা বলে দাবি করেন। গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে আইএস সিরিয়া ও ইরাকের বিশাল একটি দখল করে রেখেছে। শুধু তাই নয়, তারা সিরিয়া সীমান্ত সংলগ্ন তুরস্কের একটি শহরে বোমা হামলাও চালিয়েছে। এতো গেল আইএসের দখলদারির কথা। এবার আসি নৃশংসতার কথায়।

 

আইএসের হাতে আসলে ঠিক কতো লোক নিহত হয়েছে তার পরিসংখ্যান পাওয়া যায়  না। কারো মতে এই সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। উইকিপিডিয়ায় দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত প্রায় দুইশ লোকের শিরচ্ছেদ করেছে আইএস। সর্বশেষ প্যারিসে আত্মঘাতী বোমা ও বন্দুকধারীদের হামলায় ১৩১ জন নিহত হয়েছে। নারীদের আইএস মানুষ হিসেব গণ্যই করে না। গত বছর উত্তর ইরাকে বসবাসরত ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালায় আইএস। গ্রামের পুরুষদের হত্যা করে নারীদের তুলে নিয়ে যায় জঙ্গিরা। এরপর তাদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করে দেয় তারা।

 

এবার আসি আইএসের থাকা না থাকা প্রসঙ্গে। গত ২০ সেপ্টেম্বর মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে দাবি করা হয়, আইএস সৃষ্টিতে সিআইয়ের হাত ছিল। ওয়াশিংটনভিত্তিক খ্যাতিমান ফ্রিল্যান্স লেখক মাইক হুইটনি ইরাক যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আরেকটি রক্তক্ষয়ী আগ্রাসনের পথ সুগম করতেই পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের সহযোগীরা আইএসকে সৃষ্টি করেছে।’ কেবল হুইটনিই নয় , অনেক পশ্চিমা সাংবাদিকের মতেই , মধ্যপ্রাচ্যে নতুন একটি ছদ্মাবরণে সা¤্রাজ্যবাদ বিস্তারের জন্য পশ্চিমারা আইএস সৃষ্টি করেছে। এমনকি খোদ ইরাকিদের দাবি, সিআইএর মদদেই আইএস সৃষ্টি হয়েছে।

 

গ্লোবাল রিসার্চ নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, ২০০৪ সাল থেকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন আবুবকর আল বাগদাদি। সিআইয়ের সাবেক ঠিকাদার স্টিভেন ডি কেলি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আইএস আমেরিকার সাজানো শত্রু। একে যুক্তরাষ্ট্রই আর্থিক সহায়তা দেয়।

 

আইএস সৃষ্টিতে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ তত্ত্বও রয়েছে। আমেরিকান ফ্রি প্রেস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে,  আইএস নেতা বাগদাদি ইহুদি পিতা-মাতার সন্তান। তাকে টানা এক বছর সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে মোসাদ।

 

অধিকাংশ মুসলমানের মতেই একমাত্র ইসরায়েলই মুসলমান দেশগুলোর সবচেয়ে বড় শত্রু। শুধু মুসলমানই নয়, বিশ্বের যে কোনো ধর্ম কিংবা গোত্রের সচেতন মানুষেরই ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মুসলমানদের প্রতি সহানুভ’তি রয়েছে। সেই হিসেবে তথকাথিত খেলাফতের দাবিদার আইএসের জন্য এটাই যৌক্তিক ছিল যে, তারা সর্বপ্রথম ইসরায়েলের ওপরই হামলা চালাবে। কিন্তু আইএসের জন্মসাল থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত ইতিহাস ঘাঁটলে ইসরায়েলের ওপর আইএসের হামলার একটি তথ্যও খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিবেশী ইরানকে নিয়ে ইসরায়েল বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩শ দিনই উদ্বেগ প্রকাশ করে। অথচ আইএসের মতো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর ব্যাপারে তাদের কোন বক্তব্যই নেই। এমনকি আইএস দমনে একটি বাক্যও উচ্চারিত হয় না ইসরায়েলের কর্তাদের মুখ দিয়ে। আইএস-ইসরায়েল সম্পর্ক যে কতোটা ঘনিষ্ঠ তা বুঝতে এর চেয়ে বড় প্রমাণের প্রয়োজন হয় না।

 

পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আইএসের কাছে প্রায় ২০০ কোটি ডলার নগদ অর্থ রয়েছে। এছাড়া ইরাক ও সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি তেল খনি তাদের দখলে রয়েছে। এখান থেকে আয় হয় প্রতিদিন প্রায় তিন লাখ ডলার। সন্ত্রাসী এই গোষ্ঠীটির ৩০ হাজারের বেশি সেনা রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রতিদিন হাজার হাজার ব্যারেল তেল আইএস কার কাছে বিক্রি করছে এবং কিভাবে করছে? বলা হয়ে থাকে কালোবাজারিদের  কাছে আইএস এই তেল বিক্রি করে। আইএসের দখলকৃত এলাকার পাশের রাষ্ট্রগুলোই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। আইএস যদি যুক্তরাষ্ট্রের চরম শত্রুই হবে তাহলে মিত্রদের দেশের ভেতর দিয়ে কিভাবে চোরাকারবারিরা আইএসের কাছ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার ব্যারল তেল কিনে নিয়ে আসে?

 

সর্বশেষ আসি আইএস ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর গুলশানে ইতালির নাগরিক , ৩ অক্টোবর জাপানি নাগরিক এবং ২৩ অক্টোবর রাজধানীর হোসেনি দালান এলাকায় শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে  গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলার সবকটির দায় স্বীকার করেছে আইএস। পুলিশ কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের ভেতর থেকে পরিচালিত ওয়েবসাইট থেকে জঙ্গিসংশ্লিষ্ট কেউ এ বিবৃতি প্রকাশ করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পর আইএস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের নিজেদের অ্যাকউন্ট থেকে এসব ঘটনার দায় স্বীকার করে । কিন্তু বাংলাদেশে পরপর সংঘটিত কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার একটিতেও আইএস তাদের নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকে দায় স্বীকার করেনি।

 

গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি, দেশের ভেতর থেকে পরিচালিত কয়েকটি ওয়েবসাইট থেকে এসব হামলার দায় স্বীকার করা হয়েছে। আর এসব সূত্রের বরাত দিয়ে বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগী ‘সাইট ইন্টিলিজেন্ট’ সংবাদ প্রকাশ করেছে। সাইট ইন্টিলিজেন্ট এসব সংবাদ প্রকাশের প্রায় এক মাস পর আইএস তাদের নিজস্ব প্রকাশনা ‘দাবিক’-এ হামলার দায় স্বীকার করে নিবন্ধ প্রকাশ করেছে।

 

সাইট ইন্টিলিজেন্ট সম্পর্কে দুটি কথা না বললেই নয়। সংস্থাটির সহ প্রতিষ্ঠাতা  রিটা কাৎজ কাজ করেছেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এবং ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে। এফবিআই আর মোসাদ কাদের স্বার্থে কাজ করে আমরা জানি। সাইটে সংবাদ প্রকাশের এক মাস পর আইএসের নিজস্ব সাইটে দায় স্বীকার কি তাহলে এটা ইঙ্গিত দিচ্ছে না যে, তাদের মধ্যে পরস্পর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে? আর তাদের মধ্যে যদি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকেই থাকে তাহলে আইএস কাদের সংগঠন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

 

চল্লিশের দশকে ফিলিস্তিনকে ছিন্নভিন্ন করে ইসরায়েল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ইহুদিদের বেশ কয়েকটি গোপন সংগঠন গঠন করা হয়। এই সংগঠনগুলো ফিলিস্তিনের জনগণকে রাষ্ট্রচ্যুত করতে  ধর্ষণ, হত্যাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা-ের আশ্রয় নেয়। তাদের এই কর্মকা- যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হচ্ছিল, তখন পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে আনতে ইহুদিদের গুপ্ত সংগঠন হাগানাহ বেছে নেয় স্বগোত্রীদের ওপর বোমা হামলার পন্থা। ১৯৪০ সালে ইসরায়েলের হাইফা বন্দরে থাকা এসএস প্যাট্রিয়া নামের একটি জাহাজে বোমা পেতে রাখে। বোমার বিস্ফোরণে নিহত হয় ২৭৬ জন ইহুদি। তাদেরকে ফিলিস্তিন থেকে মরিশাস ফেরত পাঠাতে যাচ্ছিল ব্রিটিশ সরকার। ১৯৪২ সালে আরেকটি জাহাজকে উড়িয়ে দিয়ে ৭৬৯ জন ইহুদিকে হত্যা করা হয়। হাগানাহ এভাবে ইহুদিদের হত্যা করে বিশ্ব জনমতকে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করে। ইতিহাস ঘাঁটলে এমন অনেক ঘটনা পাওয়া যাবে, যেখানে ইসরায়েল স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজেদের নাগরিককে  হত্যা করতে কুণ্ঠিত হয়নি।

 

যে কোনো হত্যাকা-ই ঘৃনিত অপরাধ। কিন্তু সা¤্রাজ্যবাদী পশ্চিমা ও ইসরায়েল তাদের সা¤্রাজ্যবাদের থাবা বিস্তারের জন্য এসব কাজ করতে পিছ পা হয় না। তাই আইএস কাদের সৃষ্টি কিংবা এর অস্তিত্ব আদৌ আছে কি  না তা এক বিরাট প্রশ্ন। হয়তো ভবিষ্যতে কোনো একদিন এডওয়ার্ড ¯েœাডেন কিংবা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মতো কেউ গোপন নথি ফাঁস করে দিয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেবেন।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ নভেম্বর ২০১৫/শাহেদ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়