ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

আজ যদি হিমু থাকতো || মুম রহমান

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৩, ২১ জুলাই ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আজ যদি হিমু থাকতো || মুম রহমান

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

১.   প্রথা-ভাঙা চরিত্র হিমু

আমাদের বাংলাসাহিত্যে কুবের আছে, দেবদাস আছে, আছে কবি নিতাই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুবের, শরৎচন্দ্রের দেবদাস কিংবা তারাশঙ্করের নিতাই নিজেদের বলয়ের ভেতরে থেকেও আজও আমাদের টানে। এরা ধ্রুপদী চরিত্র। তবে কতোটা প্রাসঙ্গিক সে প্রশ্ন আসতেই পারে। কবি গান নেই, কবির লড়াইও বিলুপ্তপ্রায়। নিতাই চোর বংশের ছেলে হয়ে বংশের মুখে চুনকালি দিয়ে কবি হয়েছিল। ঠাকুরঝি আর বসন এই দুই নারীর ভালোবাসার টানাপোড়েনে সে পড়েছিল। এর মধ্যে বসন পতিতা। অন্যদিকে দেবদাসও পার্বতী আর চন্দ্রমুখীর টানাপোড়েনে ভুগেছে। চন্দ্রমুখীও পতিতা। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র কুবের অসুস্থ বউ রেখে নজর দিয়েছিল কপিলার দিকে। ‘দেবদাস’ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ‘কবি’ ধ্রুপদী পাঠ্য হলেও এর প্রেক্ষাপট, চরিত্র, গল্প প্রাসঙ্গিক নয়, নির্দিষ্ট গণ্ডি আর সমাজে আবধ্য। সমকালের বিস্ময়কর সৃষ্টি হুমায়ূন আহমেদ সে তুলনায় অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।

 

এমন নয় যে, বাংলা সাহিত্যে সমকালের অন্যান্য বিখ্যাত চরিত্ররা খুব একটা প্রাসঙ্গিক। এটা বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের সমকালের সাহিত্যিকরা বিচিত্র কোনো কারণে সমকাল এড়িয়ে গেছেন। গ্রাম অথবা নগর- পরিপ্রেক্ষিত যাই হোক, আমাদের সাহিত্যে নাগরিক বা গ্রামীণ সংকট, সমস্যা, প্রতিবেশ খুব প্রখর হয়ে ওঠেনি। তুলনায় হিমু অনেক বেশি সমকালীন। ‘আঙুল কাটা জগলু’ ‘হলুদ হিমু কালো র‌্যাব’ ‘হিমু রিমান্ডে’ ইত্যাদি উপন্যাসের শিরোনামই বলে দেয় হুমায়ূন আহমেদ হিমুকে কতোটা সমকালীন আর প্রাসঙ্গিক করেছিলেন। যাকে বলে বার্নিং ইস্যু, টক অব দ্য টাউন- তাই নিয়ে কাজ করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। ক্রস ফায়ার, র‌্যাবের কর্মকাণ্ড, রাজনীতিকদের অপরাজনীতি, পুলিশ ও থানার কীর্তি, শীর্ষ সন্ত্রাসী, চোর, ভণ্ড পীর- এইসব বিষয় ও ব্যক্তি উঠে এসেছে হিমু উপন্যাসে। আজ যদি হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতেন হয়তো হিমুকে আমরা পেতাম জঙ্গী আর সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে। হুমায়ূন আহমেদ নেই, হিমুকে নিয়ে শেষ উপন্যাসও ছাপা হয়ে গেছে। আমরা আর হিমুর নতুন কোনো কর্মকাণ্ড পাবো না। বাংলাসাহিত্যে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা এখানেই হয়ে গেলো, সমকালের বিষয় নিয়ে আর কেউ তীক্ষ্ম প্রহসন, কড়া সমালোচনা আর রস সৃষ্টি করবেন না।

 

হিমু বাংলাসাহিত্যে প্রথাভাঙা একটি চরিত্র। এক কথায় বিপ্লবী চরিত্র। প্রচলিত নিয়ম রীতিতে চলা হিমুর ধাঁচে নেই। তার বয়সের প্রতিটি নাগরিক তরুণ যখন ক্যারিয়ার আর কর্পোরেট স্বপ্নে বিহ্বল, হিমু তখন নেহাতই পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে, খালি পায়ে হাঁটা এক পরিব্রাজক। হিমু সিগারেট, তেল কিংবা টেলকো কোম্পানিতে চাকরির স্বপ্ন দেখে না, হিমু বিয়ে কিংবা প্রেমের হিসাব কষে না, হিমু আধুনিক ফ্যাশন নিয়ে ভাবে না। অথচ সে অবলীলায় সন্ত্রাসী থেকে পুলিশ সবার সঙ্গে তার স্বভাবসুলভ ইয়ার্কি মারে। ‘হিমু’ উপন্যাসে নিজেকে সে পরিচয় দেয় ‘আমি একজন পরিব্রাজক’। তাকে বেকার বললেও সে বলে, ঘুরে বেড়ানো তার কাজ। আবার ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম’ উপন্যাসেও মারিয়া যখন জানতে চায় আপনি কে? হিমু বলে, ‘মারিয়া, আমি কেউ না। হিমু হয়তো লিলি টমলিনের সেই উক্তিটি জানে- ‘ইঁদুর দৌঁড়ের সমস্যা হলো তুমি যদি জিতেও যাও তবু তুমি একটা ইঁদুরই রয়ে গেলে।’ হিমু অনেকের মতোই মুশিকে পরিণত হয়নি। সে বরং মহাপুরুষ হওয়ার পথেই এগোয়।

 

সাহিত্যের জটিল রীতি-কাঠামো আর বড় বড় তত্ত্বের ধার ধারে না হুমায়ূন আহমেদ। সরল আবেশে তিনি হিমুকে তৈরি করেন মহাপুরুষ হিসাবে। হিমুর বাবা চেয়েছিল হিমুকে মহাপুরুষ বানাতে। সেই চাওয়া এবং হওয়ার প্রক্রিয়াটিও স্বাভাবিক নয়। ‘হিমু’ উপন্যাসে হিমু নিজেই মনোবিশেষজ্ঞ ইরতাজুল করিমের সামনে স্বীকারোক্তি দেয়- ডাক্তার সাহেব, আমার বাবা ছিলেন একজন অসুস্থ মানুষ। সাইকোপ্যাথ। এবং আমার ধারণা খুব খারাপ ধরনের সাইকোপ্যাথ। তাঁর মাথায় কী করে যেন ঢুকে গেলো- মহাপুরুষ তৈরি করা যায়। যথাযথ ট্রেনিং দিয়েই তা করা সম্ভব। তাঁর যুক্তি হচ্ছে- ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ডাকাত, খুনি যদি শিক্ষা এবং ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করা যায়, তাহলে মহাপুরুষ কেন তৈরি করা যাবে না? অসুস্থ মানুষদের চিন্তা হয় সিঙ্গেল ট্র্যাকে। তার চিন্তা সে রকম হলো- তিনি মহাপুরুষ তৈরির খেলায় নামলেন। আমি হলাম তার একমাত্র ছাত্র। তিনি এগুলেন খুব ঠাণ্ডা মাথায়। তাঁর ধারণা হলো, আমার মা বেঁচে থাকলে তিনি তাকে এ জাতীয় ট্রেনিং দিতে দেবেন না-কাজেই তিনি মাকে সরিয়ে দিলেন।

 

যে বাবাকে হিমু সাইকোপ্যাথ বলছেন সেই বাবার শিক্ষা নিয়েই কিন্তু হিমু এগিয়ে চলেছে। ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম’ উপন্যাসে সে প্রশ্ন করে- আমার বাবা কি আসলেই অপ্রকৃতিস্থ? কাদের আমরা প্রকৃতিস্থ বলবো? যাদের চিন্তা-ভাবনা স্বাভাবিক পথে চলে তাদের? যারা একটু অন্যভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তাদের আমরা আলাদা করে ফেলি- তা কি ঠিক? আমার বাবা তার পুত্রকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন। তার ইচ্ছার কথা শোনামাত্রই আমরা তাকে উন্মাদ হিসাবে আলাদা করে ফেলেছি। কোনো বাবা যদি বলেন, আমি আমার ছেলে বড় ডাক্তার বানাবো তখন আমরা হাসি না, কারণ তিনি চেনা পথে হাঁটছেন। আমার বাবা তার সমগ্র জীবনে হেঁটেছেন অচেনা পথে। আমি সেই পথ কখনো অস্বীকার করিনি।

 

আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি হিমু তার বাবার দেখানো অচেনা পথেই হেঁটে চলেছেন। আমাদের সমাজের অধিকাংশ তরুণই চেনা পথে হেঁটেছেন, হাঁটছেন। তাতে হয়তো তারা সাজানো গোছানো একটি ছক-বাঁধা কিংবা সফল জীবন পাচ্ছেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই তারা অন্ধের মতো সম সময়কে এড়িয়ে চলছেন। নিরাপদ দূরত্বে বাস করছেন তারা। জীবন ও জগত নিজের মতো বোঝার চেষ্টাটা নেই বলেই আমাদের তরুণরা বিভ্রান্ত হচ্ছে। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে নিশ্চিত হিমুর হাত ধরে জঙ্গীবাদ আর ধর্মের নামে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলতেন।

 

২.   সাহিত্য ও বুদ্ধিজীবির দৈন্য

লক্ষ্য করি, সমকালের বাংলাসাহিত্যে হিমু এমন কিছু বিষয় ও বক্তব্য রাখে যা যথার্থ সাহসী ও দূর্লভ। বুদ্ধিজীবীর অবক্ষয়, রাজনৈতিক দৈন্য, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি এমনি সব বিষয় আমরা হিমু সিরিজের উপন্যাসে উঠে আসতে দেখি। ‘হিমুর মধ্য দুপুর’ উপন্যাসে আমরা পাই- ‘সবচে সহজ পণ্য হলো মানুষ। মানুষ কেনা কোনো সমস্যাই না। মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে সহজে কেনা যায় বুদ্ধিজীবিদের। তারা খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন কখন বিক্রি হবেন।’  

এই সাহসী উক্তির সঙ্গে আমাদের টকশো আর রাজনীতির ইশারায় বিবৃতি দেয়া অনেকের কথাই মনে পড়ে যেতে পারে। আমাদের বুদ্ধিজীবিদের নিরাপদ দূরত্বে থাকার প্রবণতা সত্যিই দুঃখজনক। সত্যিই আজকের বাংলাদেশের জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদের বিষয় নিয়ে কে-ইবা লিখছেন, লিখবেন!

 

‘হলুদ হিমু কালো র‌্যাব’ উপন্যাসে সমকালীন সাহিত্যের অবাস্তবতা নিয়ে মজা করেছে হিমু। আজ ছুটির দিন নামক পত্রিকার সঙ্গে আছে সাহিত্য সাময়িকী। সাম্প্রতিক গদ্য-পদ্যের মধুমিলন পাঠ করা যাবে। একটা গল্প ছাপা হয়েছে আজাদ রহমান নামের এক লেখকের। গল্পের নাম ‘কোথায় গেল সিম কার্ড?’

মনে হচ্ছে খুবই আধুনিক গল্প। গল্পকার নিশ্চয়ই হারিয়ে যাওয়া সিম কার্ডের রূপকে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদির কথা বলেছেন। বেশ কয়েকটা কবিতাও ছাপা হয়েছে, এর মধ্যে একটা কবিতার নাম ‘আড়াই বিঘা জমি’। এই কবি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের চেয়ে আধ বিঘা বড়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন দুই বিঘার কবিতা। ইনি লিখেছেন আড়াই বিঘার।

 

এই মন্তব্য শুধু সমকালের কবিতা, সাহিত্যকেও কড়া বিশ্লেষণ করেছে। আধুনিক ছোটগল্পের গল্পহীনতা ও অহেতুক জটিলতার এমন সমালোচনা হিমুর পক্ষেই সম্ভব। অন্যদিকে আধুনিক কবিতার নিরীক্ষা প্রবণতা, রবীন্দ্রনাথকে তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা লক্ষ্যনীয়।

 

‘হিমু এবং হার্ভাড পিএইচ.ডি. বল্টু ভাই’ উপন্যাসে খালু সাহেব বললেন, ‘আমি ভালো আছি। ব্রিলিয়ান্ট একটা উপন্যাস পড়ছি। ওরহান পামুকের। বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকরা কীসব অখাদ্য লেখে, তাদের উচিত ওরহান সাহেবের পায়ের কাছে বসে থাকা।’

এই উপন্যাসে বাংলা একাডেমির ডিজিকে আনা হয়েছে। হিমু তাকে প্রায়শই ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন করে। বল্টু ভাইয়ের ইচ্ছায় সে ‘ফুতুরি’, ‘ভুতুরি’ শব্দ বাংলা একাডেমির ডিকশনারিতে ঢোকাতে চায়। বাংলা একাডেমির ডিজি হিমুকে বেরিয়ে যেতে বলে। হিমু যখন মিথ্যাচার করে বলে, সে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এসেছে তখন ডিজি তার কথা শুনতে শুধু বাধ্যই হয় না, তার সঙ্গে ভালো ব্যবহারও করে। এই উপন্যাসে উঠে এসেছে বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালকের সরকারী ইচ্ছা অনিচ্ছা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া। ডিজি বলছেন, ‘সরকারি ছাত্রদলের এক সময়ের বড় নেতা এসে পাণ্ডুলিপি জমা দিল। পাণ্ডুলিপির নাম ‘বাংলার ঐতিহ্য চেপা শুঁটকির একশত রেসিপি।’ তাকে কষে চড় দেওয়া দরকার। তা না করে বললাম, এটা দেশের কালচারের অংশ রান্নাবান্না। পাণ্ডুলিপি এখনই রিভিউয়ারের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সে বলে কী, রিভিউয়ার লাগবে না, মন্ত্রীর সুপারিশ আছে। মন্ত্রী মহোদয় আপনাকে টেলিফোন করবেন।

 

ডিজিকে বিব্রত, ব্যতিব্যস্ত দেখা যায় অদ্ভুত এইসব বই নিয়ে। দবিরের সঙ্গে আলোচনা হলে সে জানায়, ডিজি এই বই নিয়ে বিপদে পরবে। অন্যদিকে বইয়ের লেখক তিনজন মন্ত্রীর রেফারেন্স নিয়ে আসে।

শিল্প-সাহিত্যে সর্বত্রই মন্ত্রীদের সুপারিশে আজগুবি সব কাণ্ড কারখানা ঘটতে থাকে যার সরব সমালোচক হিমু। (চলবে)

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ জুলাই ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়