ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

আত্মজৈবনিক : বিবর্তন এবং আমার বন্ধু হারানোর গল্প (তিন)

কমল কর্মকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২০, ২৭ জুন ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আত্মজৈবনিক : বিবর্তন এবং আমার বন্ধু হারানোর গল্প (তিন)

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

কমল কর্মকার

॥ পর্ব - তিন ॥

নয়ানীর খাল দিয়ে ভাসতে ভাসতে আরো অনেক খালবিল ছোটো নদী পার হতে হতে সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এল। নৌকার যাত্রীদের উৎকণ্ঠা ক্রমশ বাড়তে লাগল। বাঘিয়া নামের এক গ্রামে এসে নৌকা ভিড়ল। শীতের কিঞ্চিৎ আমেজ হয়তো তখনো ছিল। গায়ে চাদর জড়ানো একজন যুবক আমাদের খোঁজখবর নিল- কোথা থেকে এসেছি, সাকিন কোথায় ইত্যাদি। চাদর ঠিক করে পরতে গেলে তার কাঁধে ঝোলানো অসংখ্য ছিদ্রময় আগ্নেয় যন্ত্রটা আমাদের কারো কারো চোখে ধরা পড়ল। বড়োরা ফিসফিস করে বলতে লাগল স্টেনগান। কেউ বলল ডাকাত, কেউ বলল ‘মুক্তি’। যুবক আমাদের সবাইকে অভয় দিয়ে অনুচ্চ স্বরে জানাল, সে মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা আর মিলিটারির পার্থক্যটা তখনো আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। পাকিস্তানি মিলিটারি যে আমাদের জন্য চরম বিভীষিকা- যার কারণে নয়ানীর খাল দিয়ে ভাসতে ভাসতে পালিয়ে আসতে হয়েছে আমাদের এই অচেনা গণ্ডগ্রামে- বেশ বুঝতে পারি তখন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা বিষয়টা তখনো ঠিকঠাক বুঝি না।

‘মুক্তি’ অভিধার সাধারণ যুবকটা আমাদের সবাইকে পরম মমতায় হাত ধরে নদীর পাড় থেকে টেনে ওপরে তুলল। যুবকের আন্তরিকতা দেখে মনে এই প্রতীতি জন্মাল যে অন্তত যুবকটি ডাকাত নয় এবং তার হাতে আমাদের প্রাণহানির কোনো আশঙ্কা নেই। বড়োদের মধ্যে জোয়ান তাগড়া একমাত্র সুখু ভাই- আমার মেজো কাকার ছেলে। বড়োই করিৎকর্মা ও কষ্টসহিষ্ণু যুবা। সুখু ভাই মুক্তি যুবকটির কাছ থেকে সুরেন্দ্র নামে একজনের ঠিকানাটা জেনে নিল। সুরেন্দ্র বাবু আমাদের পুরোনো পারিবারিক বন্ধু এবং এই এলাকার ডাকসাইটে ব্যক্তি। তাঁর শরণাপন্ন হয়েছি আমরা। সকলের মনোবাঞ্ছা, আজ রাতটা পার করব তাঁর আশ্রয়ে, যেভাবে আমাদের বাড়িতে ‘অতিত’রা আশ্রয় নিয়েছিল। নাম শোনার পর সুরেন্দ্রবাবুর বাড়ির ঠিকানা বলে দিতে যুবকের কোনো বেগ পেতে হলো না। অঙ্গুলিনির্দেশ করে দেখিয়ে দিল আর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে কীসব সতর্কবাণী বা নির্দেশনা দিয়ে দ্রুত হেঁটে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেল সে। বড়োরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলাবলি করতে লাগল যে, এরা ভালো ছেলে। দেশ স্বাধীন করার জন্য কাজ করছে এবং আমাদের কোনো ক্ষতি তারা করবে না।
সুখু ভাইয়ের পেছন পেছন মুক্তি যুবকের অঙ্গুলিনির্দেশিত পথে আমাদের শরণার্থী দলটি হাঁটতে লাগল।

সুরেন্দ্রবাবুর বাড়িটি অট্টালিকা, তবে সুরম্য নয়। প্লাস্টার খসে খসে রম্য হারিয়ে ভবনটি পোড়োবাড়ির আদল নিয়েছে। তবুও যদি এখানে আশ্রয় মেলে তো অন্তত রাতটুকু কোনোমতে গুজরান করা যাবে- সবার মনে এই ছিল আকুলতা। সুরেন্দ্র বাবুর বাড়ির দরজা খুলে বের হলেন লম্বা ছিপছিপে টিকালো নাকের এক অদ্ভুতদর্শন প্রৌঢ়। তিনি এলাকায় কবিরাজি করেন। তাঁর মুখে জানা গেল, সুরেন্দ্র বাবুরা এই বাড়ি ত্যাগ করেছেন বেশ কয়েক বছর হয়ে আগে। এলাকার মুসলমান-হিন্দু মিলে কয়েকটি পরিবার ক্রয়সূত্রে বা দখলসূত্রে এ বাড়িতে বসবাস করছে। বোঝা গেল, বাড়ির স্বত্ব নিয়ে ঝামেলা রয়েছে। এমন অবস্থায় শরণার্থীর উটকো বোঝা কে কাঁধে নিতে চায়। হলোও তা-ই। বাড়ির একাংশের মালিক কবিরাজ মশাই অগত্যা আমাদের ফিরিয়ে দিলেন।

 

তখন সন্ধ্যার কালো ছায়া অনেকটাই ঘন হয়ে এসেছে। ভগ্নহৃদয়ে আমাদের শরণার্থী দলটা অন্য আশ্রয়ের খোঁজে ফিরতি পথ ধরল। কারো পায়ে তখন আর তিলমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই। কয়েক কদম হেঁটে যাওয়াও দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। কায়িক প্ররিশ্রমে নয়, ভীষণ হতাশায় সবার শরীরের বল যেন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। বড়োদের মুখ থমথমে। কোথায় মিলবে রাতটুকুর জন্য আশ্রয়? প্রচণ্ড হতাশা বুকে গেঁথে নিয়ে আমাদের শরণার্থী দলটি যখন প্রস্থানোদ্যত, ঠিক তখনই পেছন থেকে বিপুল কাঙ্ক্ষিত একটি শব্দ শোনা গেল- ‘দাঁড়ান’।

সবাই একযোগে পেছন ফিরে দেখল, সেই কবিরাজ মশাই। তাঁর মুখে কিঞ্চিৎ লজ্জামিশ্রিত হাসির আভা আবছা অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছিল। দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। এই ভরসন্ধ্যায় আমাদের ফিরিয়ে দিয়ে তিনি স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। ‘অতিথি নারায়ণ’ বলে প্রচলিত কথাটাই বোধ হয় আমাদের সহায় হলো। আপাতত রাতটুকুর জন্য তিনি আমাদের আশ্রয় দিলেন। সবার ভেতরে জমতে থাকা গুমরে ওঠা বাতাসটা একটা বড়ো নিশ্বাস হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ওপর চাপাপড়া পাথরটা যেন সরে গেল।

কবিরাজ মশাই নিতান্ত বেচারা ধরনের মানুষ। সহজ-সরল। অতি সাধারণ। কবিরাজের ভগ্ন দালানের স্যাঁতসেঁতে অর্ধেকটা কোঠা আর কোঠা-লাগোয়া একটা বারান্দা বরাদ্দ হলো আমাদের জন্য। বাকি অর্ধেকটায় মিষ্টিকুমড়া স্তূপ করে রাখা। এতেই চারটি পরিবার কোনোমতে চটের বিছানা পেতে গুজিমুজি করে বসে পড়ল। কবিরাজ রাতের বেলা আমাদের ডাল-ভাতের আপ্যায়ন করতে চাইলেন। কিন্তু কুণ্ঠা আর আত্মসম্মানের কারণে মা রাজি হলো না। মায়ের দেখাদেখি অন্যদেরও আত্মসম্মানবোধ জেগে উঠল এবং প্রদর্শিতও হলো। এদিকে কবিরাজও আর পীড়াপীড়ি করলেন না। শুকনা খাবার দিয়েই রাতটা পার হয়ে গেল আমাদের।

সকাল হলে আলুসেদ্ধ মাখা ভাতে নাশতা হলো। বাইরে গিয়ে দেখলাম, গাছগাছালিতে ঘেরা বড়ো উঠান। চারপাশে বিস্তীর্ণ শস্যখেত। খেতে অসংখ্য মিষ্টিকুমড়া মাটির ওপর যেন থরে থরে সাজানো। এটাই আমার প্রথম কৃষিজীবন দর্শন। আমার বাপদাদারা বংশপরম্পরায় স্বর্ণালংকারশিল্পে নিয়োজিত বলেই কৃষিজীবনটা আমাদের সেভাবে দেখা হয়ে ওঠেনি। খোলা প্রান্তর পেয়ে মনটা পুলকিত হয়ে উঠলেও একধরনের বিষাদে ভরে গেল। আমার খেলার সাথি গোবরার অভাবটা ভেতরে ভেতরে অনুভূত হতে লাগল। ওকে তো দেখছি না! গেল কোথায়! ‘হায় গোবর্ধন’ বলে মনটা হাহাকার করে উঠল।

কবিরাজ মশায়ের দৈন্যদশা অচিরেই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। গত রাতে আমাদের ডালভাত খাওয়ানোর তাঁর দায়সারা গোছের আপ্যায়নের কারণটা বড়োরা বুঝতে পারল। গোবেচারা অভাবী এই মানুষটার কাছে আরো কিছুদিন আশ্রয় চাইলে তিনি আর ‘না’ বলতে পারলেন না। এই অজ গাঁয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের কোনো হানা ছাড়াই নিশ্চিন্তে দিন কাটতে লাগল। মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর প্রচারিত হতে লাগল রেডিওতে। কিন্তু বিপত্তি ঘটাতে লাগল কবিরাজ মশায়ের শরিক প্রতিবেশী জব্বার মিয়া, যার ছেলে বাচ্চু মিয়া আমার বর্তমান খেলার সঙ্গী, গোবরার বিকল্প।

 

জব্বার মিয়ারা নিয়মিত বিরতি দিয়ে আমাদের মিলিটারি আগমনের ভীতি প্রদর্শনে রত থাকল। বাচ্চুও খেলার মাঝে প্রায়শ বিজাতীয় ভাষায় গালি দিয়ে উঠত। ‘মালাউন’ শব্দটা ওর মুখেই প্রথম শুনলাম। ইতিপূর্বে আমার কোনো মুসলমান খেলার সঙ্গী জোটেনি। বিজাতীয় ওই শব্দটা তখন বেশ প্রচলিত ছিল। পাকিস্তানি হানাদাররা চারদিকে মালাউন খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন।

বড়োরা ফিসফিস করে বলাবলি করতে লাগল, জব্বার মিয়াদের লোভ আসলে আমাদের গাট্টি-বোঁচকার দিকে। তাই সে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। কবিরাজ মশায় আগেই ওদের সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

 

মাঝে মাঝে বাবা এসে আমাদের বাজার করে দিয়ে যেত। আবার ভোর হতে-না-হতেই বাড়ির উদ্দেশে রওনা হতো।  বাবা এলে আমার আনন্দের সীমা থাকত না। আসার সময় বাজার থেকে পর্যাপ্ত চিড়া-গুড় সঙ্গে নিয়ে আসত বাবা। গুড় সহযোগে দুধ-কলা মাখানো ভাত ছিল আমার খুব প্রিয়, অমৃতসমান। বাবা চলে যাওয়ার পর মনটা বিষাদে ভরে যেত। বাবা কেন আমাদের নিরাপদে রেখে নিজে অনিরাপদ আবাসভূমে ফিরে যেত, আমার বোধগম্য হতো না।

 

এদিকে খেলার সাথি গোবরাটার অভাবটাও মর্মে মর্মে অনুভব করতাম। বাড়ি ফিরে যেতে মনটা আনচান করে উঠত। বাচ্চু মিয়ার সঙ্গে আমার খেলতে ভালো লাগত না। ওর চোখে এক ধরনের হিংস্রতা ফুটে উঠত যখন-তখন। এভাবেই শরণার্থী হয়ে কয়েকটা মাস আমরা পার করে দিলাম বাঘিয়া গ্রামে। (চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়