ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

আমাদের হিরো : তৃতীয় পর্ব

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০৪, ২০ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমাদের হিরো : তৃতীয় পর্ব

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

ঘোস্ট রাইটিং বাট অরিজিনাল

 

‘ঘোস্ট রাইটিং’ বলে একটি শব্দ ইংরেজি সাহিত্যে পরিচিত। সোজা বাংলায় ভূতুড়ে লেখক বা ভূতুড়ে লেখা হলো ধার করা বা ভাড়া করা লেখক দিয়ে লেখানো। বিশ্বের অনেক নামী-দামি ব্যক্তিই লেখক নন, কিন্তু তারা ভাড়া করা লেখক দিয়ে নিজের আত্মজীবনী বা ভাবনা লিখিয়েছেন। অনেক নামকরা চিত্রনাট্যকার, সঙ্গীতকারও ভাড়া করা লেখক দিয়ে নিজের চিত্রনাট্য সম্পূর্ণ করেছেন। তবে গল্প উপন্যাসের ক্ষেত্রে ভাড়া করা লেখক নেয়া হয় সাধারণত প্রকাশনার ব্যাপক চাপ সামলাতে। একটি নির্দিষ্ট সিরিজ যখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় তখন পাঠক চাহিদা মেটাতে ভাড়া করা লেখকের সাহায্য নিতে হয়। ভাড়া করা লেখক কখনো নিজের নাম প্রকাশ করেন না। তিনি সাধারণত মূল লেখকের ভাবনা, বিষয় নিয়েই কাজ করেন টাকার বিনিময়ে।

 

ঘোস্ট রাইটিং একটি পেশাদারী মনোভঙ্গি। বিশ্বের অনেক দেশেই ভাড়া করা লেখকরা নিয়মিত বেতন পান। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ক্যারেলিস কেনি এবং ফ্রাঙ্কলিন ডব্লুই ডিক্সনের নাম। আমরা সবাই তাদের চিনি ন্যান্সি ড্রিও ও হার্ডি বয়েজ সিরিজ দুটোর লেখক হিসেবে। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় এই কিশোর সিরিজ দুটি ছেলে-মেয়েদের কাছে খুবই আদরণীয়। কিন্তু এই সিরিজের অনেক বই-ই ঘোস্ট রাইটার বা ভাড়া করা লেখক দিয়ে তৈরি। মূল গল্প, ভাষাশৈলী, সংলাপের ধরণ, চরিত্রের নিজস্বতা এবং সর্বোপরি যে লেখকের নামে বইটি জনপ্রিয় তার লেখনিশৈলী ধারণ করেই ঘোস্ট রাইটিং করতে হয়। রোমান্স উপন্যাসের জনপ্রিয় লেখিকা ভি সি এন্ড্রুস ঘোষণা দিয়েই এন্ড্রু নাইডারম্যানকে ভাড়া করেছেন যাতে করে তার মৃত্যুর পরও তার প্রেমের উপন্যাসের ধারাবাহিকতা রয়ে যায়। এ্যাকশন সিরিজের লেখক টম ক্ল্যান্সি ২০০০ সালের পর থেকেই তার বইগুলোতে তার নামের পরে ছোট করে অন্য আরেকজন ভাড়া করা লেখকের নাম দিয়ে আসছেন। 

 

মাসুদ রানা বাংলাদেশে প্রথম সিরিজ যেখানে অনেকেই ভাড়া করা লেখক হিসেবে কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কাজ করেছেন। মাসুদ রানার প্রথম দুটি উপন্যাস ‘ধ্বংস পাহাড়’ ও ‘ভারতনাট্যম’ মৌলিক কাহিনি। যদিও প্রথম উপন্যাসটি লিখতে কাজী আনোয়ার হোসেন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আয়ান ফ্লেমিং-এর জেমস বন্ড সিরিজ দ্বারা। ধারণা করা যায় মাসুদ রানার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ও পাঠক চাহিদা মেটাতেই ভাড়া করা লেখক নিতে হয়েছে।

 

আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, বিশ্বের সেরা স্পাই থ্রিলারগুলো থেকে মাসুদ রানার গল্প তৈরি হয়েছে। আয়ারন ফ্লেমিং, এলিস্ট্যার ম্যাকলীন, রবার্ট লুডলাম, জেমস হেডলী চেজ, উইলবার স্মিথ, ক্লাইভ কাসলার, ফ্রেডরিখ ফরসাইথ ডেসমন্ড ব্যাগলি, হ্যামন্ড ইনস, পিটার বেঞ্চলি, কেন ফলেট, ক্লাইভ কাসলার, এডওয়ার্ড এস আরনস, কলিন ফর্বস, জেরার্ড ডি ভিলিয়ার্স, জ্যাক হিগিন্স, এ জে কুইনেল, জিওফ্রি জেনকিনস-এর মতো বেস্টসেলার স্পাই থ্রিলার লেখকদের থেকে অকাতরে গল্প ধার করেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। কখনোই কোনো কাহিনি হুবুহু অনুবাদ হয়নি। প্রতিটি গল্পই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাজাতে হয়েছে। অন্যদিকে, কখনো আবার দুই-তিনটি কাহিনি মিলিয়ে একটি গল্প তৈরি হয়েছে। তাই মাসুদ রানার কাঠামো তৈরিতে এই সব বিদেশি উপন্যাস ও একাধিক ঘোস্ট রাইটারের অবদান আছে।

 

তবে মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম দুটি উপন্যাস ‘ধ্বংস পাহাড়’ ও ‘ভরতনাট্যম’ একেবারেই মৌলিক। ‘ধ্বংস পাহাড়’ লিখতে কাজী আনোয়ার হোসেন মোটর সাইকেলে করে কাপ্তাই, রাঙামাটি ঘুরে বেরিয়েছেন ১০ মাস। কবির চৌধুরী নামে এক বিজ্ঞানী কাপ্তাই শহরের কাছে পাহাড়ের ভেতরে আল্ট্রা সোনিক এবং এন্টিগ্র্যাভেটি নিয়ে গোপন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কাপ্তাই বাঁধের কারণে লেকের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে পাহাড়টা। তিনি ভারত থেকে আনা শক্তিশালী ডিনামাইট দিয়ে কাপ্তাই বাঁধ উড়িয়ে দিতে চান। আর মাসুদ রানার কাজ হলো কবির চৌধুরী ও তার পাহাড়টাকেই ধ্বংস করে দেয়া।

 

যতোই বিদেশি গল্প অবলম্বনে হোক মাসুদ রানার দেশীকরণ দারূণ সাবলীল। মাসুদ রানা সিরিজের কিছু নিয়মিত চরিত্রের মধ্যে গিলটি মিয়া ও রাঙার মা উল্লেখযোগ্য। ‘সাগর সঙ্গমে’ উপন্যাসে গিলটি মিয়ার দেখা পাওয়া যায়। গিলটি মিয়ার কার্যকলাপ ও ভাষা অনেকটাই আমাদের সে সময়ের কমেডিয়ান খান জয়নুল, রবিউল ও কিংবা হাবা হাসমতকে মনে করিয়ে দেয়। কাজী আনোয়ার হোসেনের মাতা হুগলি জেলার মানুষ যিনি বেড়ে উঠেছিলেন কলকাতায়। `নড়েচ কি মরেচ! খবোদ্দার, পিচন ফিরে ডেঁড়িয়ে থাক সবাই। একটা হাঁচি দিলেও গুলি খাবে!`- গিলটি মিয়ার এই ভাষা যেন হুগলি, কলকাতার এক মিশেল ভাষা। রাঙার মা’র যে মমতাময়ী চরিত্র তা কখনো পাশ্চাত্যের থ্রিলারে পাওয়া যাবে না। রাঙার মা মাসুদ রানা সিরিজের এক অনবদ্য সৃষ্টি।

 

মাসুদ রানা সিরিজে রানা বহু মেয়ের সঙ্গে প্রেম-পরিণয়-মিলনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু সে কোথাও ধরা দেয় না। জেমস বন্ডের মতো নারী তার যাত্রাপথে একটি অনুষঙ্গ মাত্র। কিন্তু সোহানা’র সঙ্গে মাসুদ রানার বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কিছু আছে। সোহানার সঙ্গে মাসুদ রানার সম্পর্ক অন্য যে কোনো নারীর থেকেই আলাদা। পাঠক হিসেবে প্রায়শই মনে হয় সোহানার সঙ্গে গাঁট ছড়া বাঁধলে ভালোই হতো মাসুদ রানার। এই সোহানা চরিত্র কাজী আনোয়ার হোসেনের একটি মৌলিক সৃষ্টি। বাঙালি স্মার্ট নারীর আদর্শ উদাহরণ সোহানা। আয়ান ফ্লেমিং সৃষ্ট জেমস বন্ড চরিত্রের বন্ধু ফিলিক্স অবলম্বনে তৈরি হয়েছে সোহেল চরিত্রটি। বন্ধুত্বের ক্ষেত্রেও সোহেল যেন প্রাচ্য দেশীয় একাগ্রতায় জাগ্রত।

 

মাসুদ রানা সিরিজের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ দিক দেশপ্রেম। এই দেশপ্রেমের কারণেই বিদেশি গল্প হওয়া সত্ত্বেও রানা সবার প্রাণের প্রিয় নায়ক হয়ে ওঠে।  ‘দড়াম করে মারল কায়েস আলী টিক্কা খানের ডান বাহুতে। মড়াৎ করে ভেঙে গেল হাতটা। পরমুহূর্তে পেটের উপর পড়ল একটা রদ্দা। দেয়ালে গিয়ে আছড়ে পড়ল জেনারেল, তারপর ঝুপ করে মেঝেতে পড়ল জ্ঞান হারিয়ে। নাকটা আর বাকি থাকে কেন, মনে করে বুটের ছোট্ট একটা লাথিতে ভেঙে দিল রানা টিক্কা খানের খাড়া নাকটা।’

 

পাকিস্তানের কুখ্যাত জেনারেল টিক্কা খানের নাকে মাসুদ রানার লাথি নিঃসন্দেহে মৌলিকতায় অনন্য। টিক্কা খান যখন মৃত্যু ভয়ে আড়ষ্ট তখন মাসুদ রানার বস মেজর জেনারেল রাহাত খান বলেন, ‘তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রকাশ্যে বিচার করতে পারলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়- ওয়ার্ল্ড ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে ব্যাপারটা, এবং পাকিস্তানও ছুতো পাবে আটক বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করার। কাজেই থাক, তুমি আপন নিয়তির টানে একটার পর একটা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাবে নিজে ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত।’

 

‘বিপজ্জনক’ উপন্যাসের এই ভাষা এই চেতনা সম্পূর্ণ মুক্তিকামী বাঙালির স্বাধীনতা চেতনার মৌলিক প্রকাশ।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জুন ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়