ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আমি বিজয়ীর হাসি হাসতে পারিনি || আবুল কাশেম চৌধুরী

আবুল কাশেম চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৭, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমি বিজয়ীর হাসি হাসতে পারিনি || আবুল কাশেম চৌধুরী

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

২৫ মার্চ। রাজধানী ঢাকা। রাত ১১টা পর্যন্ত বন্ধুদের সঙ্গে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা শেষে ঘুমাতে গেলাম। শেষরাতের দিকে হঠাৎ বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। জানালা খুলে দেখি শুধু মানুষের দৌড়াদৌড়ি আর গোলাগুলির শব্দ। এমন সময় একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, কী অবস্থা? জবাবে বললেন, আমরা ইপিআর-এর লোক। ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুমন্ত অবস্থায় খান সেনারা আমাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করেছে। যে যেদিকে সম্ভব পালিয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছি।

আমি স্থবির হয়ে গেলাম। ফজরের নামাজ আদায় করে বের হলাম অবস্থা দেখার জন্য। দেখলাম উলঙ্গ, অর্ধ উলঙ্গ লোক জীবন বাঁচানোর তাগিদে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এগুলাম এবং এই এলাকায় পলায়নরত কিছু মানুষকে একত্রিত করলাম। আমাদের বাসার কাছেই বুড়িগঙ্গা নদীর বালুচরে তাদের জন্য সামান্য নাস্তা ও কিছু কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা করলাম। এলাকার লোকজন বেশ সহযোগিতা করলেন। এরপর বের হলাম অন্যান্য স্থান দেখার জন্য। চারিদিক দেখে মনে হলো- এটা পরিচিত সেই ঢাকা শহর নয়, একটা মৃত্যুপুরী। পরের দিন গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। দেখলাম ছাত্র-শিক্ষকের অগনিত লাশ। এরপর গেলাম আরো কয়েকটা ছাত্রাবাসে, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, শাখারী পট্টি। লাশ আর ধ্বংসস্তুপ দেখতে দেখতে অবসন্ন হয়ে গেলাম। ফিরে এলাম বাসায়। এর পরের দিন বুড়িগঙ্গার ওই বালুচরে কয়েক বন্ধু মিলিত হলাম, কী করা যায় এই আলোচনার জন্য। দিন কেটে গেল সমাধান খুঁজে পেলাম না। শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করব। যেমন সিদ্ধান্ত, তেমন কাজ।

প্রায় ৩০ জন বন্ধুকে সংগঠিত করি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য। কয়েকবার তারিখ পেছানোর পরও আমার বন্ধুরা ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারল না। তাই আমি একাই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে আঁটি গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন হাজারীবাগ ইউনিয়নের তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিরউল্লাহ। প্রথমে তার কাছে গেলাম। তিনি একটা চিঠি লিখে দিলেন। আমি চিঠিখানা নিয়ে একাই হাঁটতে শুরু করি। ঢাকা থেকে একদিন হাঁটার পর পৌঁছালাম ফরিদপুর এলাকায়। সেখানে রাতে এক বাড়িতে আশ্রয় নিলাম এবং শুনলাম কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে এলাকার লোকজন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। যারা এই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তারা হলেন- মরহুম ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী, মরহুম অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন চৌধুরী প্রমুখ।

সকাল হতেই আবার হাঁটা শুরু করলাম, হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত অবস্থায় ফরিদপুরের এক রেল স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। সেখানে দেখলাম মানুষ অনিচ্ছাকৃত হলেও শান্তি কমিটি গঠন করতে ব্যস্ত। একটা ট্রেন ছাড়লো কুষ্টিয়া অভিমুখে। অত্যন্ত ক্ষুধার্ত ও অবসন্ন অবস্থায় ট্রেনে চাপলাম। টাকা দিয়েও খাবার পাচ্ছিলাম না। কুষ্টিয়া পৌঁছলাম পরের দিন। আবার হাঁটতে শুরু করলাম। কেউ কোনো কথা জিজ্ঞেস করল না। কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের সামনে এসে মুখোমুখি হলাম পাকিস্তানি বাহিনীর। তারা বিভিন্ন কথাবার্তা জিজ্ঞেস করল। আমি ঠিকমতো উত্তর দেওয়ায় প্রাণে রক্ষা পেলাম। আবার চলতে শুরু করলাম। ক্ষুধার্ত অবস্থায় শুধু হাঁটছি। শরীর অসার হয়ে আসছে। পড়ন্ত বিকেল, রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে।

কয়েকজন সাইকেল চালককে একটু এগিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। কেউ রাজী হলেন না। পরে একজন লোক আমাকে বিশ্বাস করে নিয়ে যেতে রাজী হলেন। সীমান্তের কাছে তার বাড়িতে আমাকে নিয়ে গেলেন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং নিজে আমাকে আশ্রয় দিয়ে খুব গর্ববোধ করলেন এবং খুব যত্ন করে খাওয়ালেন। সকালে তিনি আমাকে সীমান্ত পার করে দিলেন। আমি প্রথম ভারতের মাটিতে পা রাখলাম।

শিকারপুর থেকে পায়ে হেঁটে গিয়ে (সম্ভবত বনগ্রাম) রাস্তার পাশেই খালি পড়ে থাকা বিরাট এক জমিদার বাড়িতে উঠলাম। আমার মতো অনেকেই আছেন সে বাড়িতে। সে এক অস্বস্তিকর অবস্থান। কিছু দূরেই মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। আমি বিকেলে সেই ক্যাম্পে গিয়ে উপস্থিত হলাম। বেতাই ক্যাম্প পরিচালক তৎকালীন মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা এবং বর্তমানে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাহবুব উদ্দীন আহমদ বীরবিক্রম এবং তৎকালীন ঝিনাইদহ মহকুমা প্রশাসক বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক এলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম। আমি দেখলাম, একটা বটগাছের নিচে কুঁড়ে ঘরে অফিস রুমে তারা বসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন। আমার কিছু বলার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু হলো না। আমি বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সাংবাদিকরা চলে গেলে আমি মাহবুব সাহেবের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি আগ্রহ ভরে আমার সব কথা শুনলেন। দুঃখ করে বললেন, কেন আমার সঙ্গে কথা না বলে সাংবাদিকদের বিদায় করে দিলেন। যা হোক, আমি নাসরুল্লাহ সাহেবের লেখা চিঠিটা তাকে দিলে তিনি খুশি হন এবং ক্যাম্পে থাকা, খাওয়া ও কাজের ব্যবস্থা করে দেন।

কয়েকদিন পরে মাহবুব সাহেব আমার হাতে একটা চিঠি দিয়ে আমাকে সীমান্ত এলাকায় পাঠালেন। চিঠিটা ছিল একজন ভারতীয় কর্মকর্তার কাছে লেখা। আমি চিঠিখানা নিয়ে ভদ্রলোকের কাছে গেলে তিনি আমাকে বেশ সমাদর করলেন। তিনি সেখানে আমার থাকার ব্যবস্থা করলেন। মাহবুব সাহেব আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সেটা ছিল অত্যন্ত কঠিন। কাজটা ছিল বিশেষ একটা লোকের দিকে নজর রাখা। আমি এক সপ্তাহ ধরে ভদ্রলোকের খোঁজখবর নিলাম এবং জানতে চেষ্টা করলাম তিনি আসলে কে? তার কাজটা কী? ভদ্রলোক থাকেন একটা বিরাট বাড়িতে। সর্বক্ষণ তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটান, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। কিন্তু রাতে তার ভিন্নরূপ। রাত ১০টার পর তিনি বাসা থেকে বের হয়ে চরপাড়ায় একটা খালের পাড়ে যান। সেখানে তার জন্য অপেক্ষারত কয়েকজন মানুষের সঙ্গে দেখা করেন, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন এবং লেনদেন করেন। আমি দূর থেকে তার গতিবিধি লক্ষ্য রাখতাম, কিন্তু সঠিক কিছু বুঝে উঠতে পারতাম না। পরে স্থানীয় কিছু লোকজন ও ভারতীয় কিছু কর্মকর্তা আমাকে জানালেন, ওই ভদ্রলোক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য ভারত থেকে চা-পাতা, চিনি এবং আরো কিছু মালামাল ভারতের বাজার থেকে কিনে তাদের সরবরাহ করত। এক সপ্তাহ পর এসব খবর নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। এসে দেখি মাহবুব সাহেব এবং তৌফিক ভাই কয়েক দিনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের কাজে ক্যাম্পের বাইরে গেছেন।

এদিকে ক্যাম্পের লোকজন আমাকে ঠিক সহজভাবে নেয়নি। তারা আমাকে সন্দেহ করতে লাগল, আমি পাকিস্তানি গুপ্তচর কি না। বিমান বাহিনীর একজন লোক আমাকে আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলতে লাগলেন এবং ভারতীয় এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাকে সহযোগিতা করছিলেন। অবশেষে চাপাচাপির মুখে আমি ওই রহস্যজনক ভদ্রলোকের নাম বলতে বাধ্য হলাম, আর অমনি তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। তারা আমাকে গুলি করতে চাইলেন এবং পরে বন্দি করে রাখতে চাইলেন। আমি চুপ করে থাকলাম। তারা বললেন, তুমি কি জানো ওই ভদ্রলোক সম্পর্কে? তিনি একজন এমসিএ- এটা তোমার জানা উচিত। যা হোক, এবারের  মতো নির্যাতনের হাত থেকে বেঁচে গেলাম। মাহবুব সাহেব না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার সুযোগ পেলাম। দুদিন পর মাহবুব সাহেব এলেন এবং আমার এই দুরবস্থার অবসান হলো। পরে আমার দায়িত্ব অনুযায়ী, সমস্ত রিপোর্ট সুন্দর ও সবিস্তারে মাহবুব ভাইয়ের কাছে উপস্থাপন করলাম। ওই এমসিএর নাম ছিল রাজা মিয়া। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছিলেন দুর্নীতির দায়ে।

অতঃপর শুরু হল আমার প্রশিক্ষণ গ্রহণের পালা। আমি প্রশিক্ষণে যাওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। কিন্তু ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ডাক্তার আমাকে বাতিল করে দিলেন। আমি কাঁদতে শুরু করলাম, আমি কি মুক্তিযোদ্ধা হতে পারব না? আমার সঙ্গে আরো যারা ছিল তারা সবাই দিল্লি, আজমীর ও অন্যান্য জায়গা ঘুরে ফিরে এসেছে। কিন্তু আমি কোথাও যাইনি, আমার মনের অবস্থা ভালো নয়। কয়েকদিন পর প্রশিক্ষণে নিয়োগের জন্য একটি দল এলো। আমি লাইনে দাঁড়ালাম। এবার মনোনীত হলাম। আমি আনন্দিত হলাম। সময় নির্ধারিত হলো ৩০ জুন রাতে আমরা রওনা হব। সন্ধ্যার আগেই খাওয়া শেষ করে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। সন্ধ্যার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর গাড়ি আমাদের নেওয়ার জন্য এলো। প্রতি গাড়িতে ১৪ জন করে নেওয়া হলো। আমরা গাড়িতে উঠলে গাড়ির সব এমনভাবে বন্ধ করা হল যাতে বাইরে কোনো কিছু দেখা না যায়। আমাদের সঙ্গে ভারতীয় কয়েকজন সামরিক অফিসার ও কয়েকজন জওয়ানও ছিল। কিছু দূর যাওয়ার পর তারা নেমে গেল এবং আরেক দল গাড়িতে উঠল। সকাল ৮টায় আমরা বিহারের এক জায়গায় নামলাম। সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করা হলো। নাস্তা খেয়ে তাঁবুতে বসলাম। প্রতি তাঁবুতে ১০ জন করে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। আশপাশ ঘুরে-ফিরে দেখলাম। কিছু জঙ্গল আর বিমান ওঠানামার রানওয়ে দেখলাম। পরে জানতে পারলাম যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রয়োজনে এটা ব্রিটিশরা নির্মাণ করেছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণের জন্য মুজিবনগর সরকার চাকুলিয়া বিমানবন্দর নির্ধারণ করেছিলেন। বিহার রাজ্যের সিংভুম জেলায় অবস্থিত চাকুলিয়া পুরাতন বিমানবন্দর। আমাদের উইংয়ে প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন মাদ্রাজের অধিবাসী ভারতীয় সেনাবাহিনীর তরুণ ক্যাপ্টেন ভোরা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। আমি আমার তাঁবুর দায়িত্ব পেলাম। ১ জুলাই ১৯৭১ প্রশিক্ষণ শুরু হলো। ১০টি উইং ছিল। প্রতি উইংয়ে ১৪০ জনের প্রশিক্ষণ চলছিল। দিনরাত প্রশিক্ষণ চলছে বিরামহীনভাবে। সব ধরণের প্রশিক্ষণই এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিল। প্রশিক্ষণ চলাকালীন একদিন এলেন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও মু্ক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি আতাউল গণি ওসমানী। বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য সব ধরনের বিশেষ প্রশিক্ষণ এখানে দেওয়া হতো। আমি দক্ষতার সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করেছিলাম। প্রশিক্ষণের মধ্যে বিস্ফোরক প্রশিক্ষণই ছিল সবচেয়ে কঠিন। ৩০ জুলাই আমাদের প্রশিক্ষণ শেষ হলো। প্রশিক্ষণ শেষে কাকে কোথায় দেওয়া হবে- এ প্রশ্ন আসলে আমাকে ঢাকা বা চট্টগ্রাম পাঠানোর অনুরোধ করলাম।

এরপর আমরা ১৬ জন ২ নং সেক্টরের পথে রওয়ানা হলাম। পথে ৯ নং সেক্টর কমান্ডার কার্যালয়ে এক দিন এক রাত অবস্থান করি। মেজর জলিল আমাদের খুব সমাদর করে বললেন, তোমাদের পরিচয় হচ্ছে তোমরা কমান্ডো। হায়েনার দলকে পরাজিত করতেই হবে এবং বাঙালি যে বীরের জাতি তা প্রমাণ করতে হবে।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কয়েক দিন পরে অতি কষ্টে আমরা এসে পৌঁছলাম মেলাঘর ২ নং সেক্টর কমান্ডারের কার্যালয়ে। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চলছে। ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ আমাদের সাদরেই গ্রহণ করে নিল। দেশের ভেতরে প্রবেশের জন্য উদগ্রিব ছিলাম। সুযোগ এসে গেল। ঢাকার লালবাগের খাজে দেওয়ানের মাহবুব আহাম্মদ শহীদের নেতৃত্বে আমরা ছয়জন অস্ত্রসহ ঢাকায় আসার অনুমতি পেলাম। আমাদের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন সহকারী কমান্ডার মেজর হায়দার। প্রয়োজনীয় নির্দেশ তিনিই দিলেন। তার শেষ কথা ছিল- প্রয়োজনে যেন নিজের জন্মদাতা পিতাকেও ক্ষমা করা না হয়। সেই শপথের কথা অনেকেই মনে রাখতে পারিনি।

মাহবুব আহাম্মদ শহীদের নেতৃত্বে আমরা ছয়জন ঢাকা শহরে পৌঁছলাম আগস্টের ১০ তারিখের দিকে। এখানে এসে আমাদের থাকা-খাওয়ার সমস্যা দেখা দিলো। একে একে সবার ব্যবস্থাই হলো। আমি থাকলাম মাহবুব হোসেনের ওয়ারীর বাসায়। বর্তমানে তিনি বিএনপি নেত্রীর উপদেষ্টা। তার স্ত্রী ও ভাই খন্দকার শাহদাত হোসেন আমাকে অসুস্থতার মাঝে সেবা-শুশ্রুষা করে ভালো করে তোলেন। অতুলনীয় তাদের দেশপ্রেম, যা ভোলার নয়। ঝুঁকি নিয়ে অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাকে ওষুধ ও সেবা দিয়েছেন। ইউছুফ নামে হাজারীবাগের একজন রাজাকারের কার্ডধারীর চেষ্টায় অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের বাসায় আমার থাকার ব্যবস্থা হয়। তিনি স্বাধীনতার পরে সরকারি অ্যাডভোকেটের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। গভর্নর ডাক্তার আব্দুল মালেক মল্লিকের মামলা পরিচালনা করেছিলেন সরকারের পক্ষে। অনেক প্রতিকূলতা সত্বেও গ্রুপ কমান্ডার মাহবুব আহমদের অনুমতি নিয়ে নিজ জেলা চট্টগ্রামের পথে রওনা হলাম। চাঁদপুর হয়ে ট্রেনে দুই দিন একনাগারে চলার পর রাত ১১টার পর নিজ বাড়িতে পৌঁছলাম। বাড়িতে পৌঁছার পর সেখানে আনন্দে কান্নার রোল পড়ে গেল। মা যেন ফিরে পেলেন তার আকাশের চাঁদ, হারিয়ে যাওয়া মানিককে। সে দৃশ্যের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যে না দেখেছে সে দৃশ্য, তার উপলব্ধিতে আসার কথা নয়।

ঢাকায় ফিরে আসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিপদসংকুল রাস্তার কথা ভেবে আর আসা সম্ভব হলো না। সিদ্ধান্ত নিলাম নিজ এলাকায় যুদ্ধ করব। ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে ৪৫০ জনের অধিক অসম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা এই এলাকায় যুদ্ধরত। আমিও যুক্ত হলাম তাদের সঙ্গে। বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও চারশরও বেশি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছে, যারা স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল।

পটিয়া চট্টগ্রামের একটি পাহাড়ি এলাকা। পাহাড়ের পাদদেশে চিরমাই মাদ্রাসায় আমাদের ক্যাম্প ছিল। এখানে দু’একটি সফল অপারেশনের কথা না বলে পারছি না। একটা বিরাট রাজাকার ক্যাম্প চতুর্দিক ঘিরে রাত প্রায় ১টার দিকে আক্রমণ করা হলো। সেখানে অজস্র গুলিবিনিময় হলো। রাজাকাররা ভেতরে, আমরা বাইরে। আমি পড়ে গিয়েছি শত্রুর মাঝখানে, আমার গ্রুপ লিডার অধ্যাপক শামশু পিছু হটার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু সে আওয়াজ আমার কানে আসেনি। আমার এসএলআর-এর গুলি শেষ। পেছনে চেয়ে দেখি আমার সঙ্গে আর কেউ নেই। অনেক কষ্টে ও কৌশলে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। সে কথা মনে পড়লে আজও আমার গা শিউরে ওঠে।

আরেকটি ঘটনা বলেই আমরা পূর্বের কথায় ফিরে যাব। চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলের বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাওয়ার স্টেশন ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছিলেন কমান্ডার করিম। ক্যাপ্টেন করিম সাহেবসহ সাতজনের একটি দল ঘটনাস্থলে গেলাম রাঙ্গুনিয়া থানার করের হাট নামক স্থানে। কথা ছিল একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ দিয়ে অপারেশন করানো হবে। ওই বিশেষজ্ঞ একজন প্রকৌশলী। তিনি যথাসময়ে সেখানে আসেননি। ক্যাপ্টেন সাহেব চিন্তিত হয়ে পড়লেন, সকাল হয়ে যাচ্ছে দেখে। আমি বললাম, যদি অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে আমি অপারেশন করতে পারি। কারণ এ বিষয়ে আমার ভালো প্রশিক্ষণ আছে। তিনি দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যেও আমাকে অনুমতি দিলেন। আমি নিজেই সেই অপারেশন করলাম এবং সফলও হলাম। করিম সাহেব অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। সে সময় থেকে তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেল। এর মধ্যে যুদ্ধের তীব্রতা আরো বেড়ে গেছে। ৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা হয়ে গেল। ওই দিন ক্যাপ্টেন করিম সাহেব আমাদের ডেকে বললেন, আমাকে সেক্টরের প্রধান কার্যালয়ে ডাকা হয়েছে। তোমরা কাজ করতে থাক। আমি দু-এক দিনের মধ্যেই ফিরে আসব। একজন সাথী নিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করলাম। আমাদের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস দানা বাঁধতে লাগল এক অজানা আশঙ্কায়। দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির। মুজিব বাহিনীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জনাব করিম শাহাদত বরণ করলেন । এদিকে ওপরের কর্মকর্তারা এসে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গেলেন। আমরা নিরস্ত্র হয়ে গেলাম আর এভাবেই ১৫ ডিসেম্বর কোনোমতে আবার নিজ গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলাম।


দেশ স্বাধীন হলো। একদিকে সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ, ভাইহারা বোনের কান্না, স্বামীহারা স্ত্রীর বিলাপ, সম্ভ্রম হারানো বীরাঙ্গনার আহাজারীর মাঝে আমি বিজয়ীর হাসি হাসতে পারিনি। আমি বিজয়ের আনন্দ আজও উপভোগ করতে পারিনি। কেন যেন মনে হয়, শহীদের আত্মা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মুক্তিযুদ্ধের শহীদরা আমাকে যেন বলছে, তোমরা কি আমাদের রক্তে কেনা স্বাধীনতার স্বাদ গণমানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে পেরেছ?


লেখক : সভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি রক্ষা সংসদ, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৫/রফিক/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়