ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

আমেরিকা: ফেল কড়ি মাখ তেল

শাকুর মজিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৬, ৩ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমেরিকা: ফেল কড়ি মাখ তেল

ডেট্রয়েট বিমানবন্দরে লেখকের সেলফি

শাকুর মজিদ

(মিরিকিনে: প্রথম কিস্তি)

শিকাগোর ও’হারে বিমানবন্দরে ল্যান্ড করার কয়েক ঘণ্টা আগেই আমেরিকান এয়ারের পৌঢ়া এয়ার হোস্টেজ একটা ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিলেন। এটা কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য প্রয়োজন হবে। এর আগে ২০০১ সালে যখন আমি প্রথমবার আমেরিকা আসি তখন এটা ছিল না। ইমিগ্রেশন পার হবার জন্য পৃথিবীর একেক দেশে একেক নিয়ম। ভারতে যেতে যেমন কোথায় থাকবো, কার কাছে থাকবো, যেখানে থাকবো তার ফোন নাম্বার  কত -এসব লিখে ইমিগ্রেশন পার হতে হয়। লন্ডনের ইমিগ্রেশনের জন্য সেরকম কিছুর প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এখানে এটা লাগবে।

কাস্টমস-এর ডিক্লারেশন ফর্মে লেখা আছে ফলমূল, বীজ, চারা, খাবার, পোকামাকড়, মাংস, প্রাণী, প্রাণীর খাবার, মাটি, সার এসব নিয়ে এসেছো কিনা উল্লেখ করতে হবে। আমি ঘরপোড়া গরু, সিঁদুর রাঙা মেঘ দেখলেই ডরাই। ১৪ বছর আগে হিউস্টন বিমানবন্দরে এক ছোকরি ৪টা সাতকরার জন্য আমাকে যে পরিমাণ নাকানি-চুবানী খাইয়েছিল, আমার মনে আছে। পঞ্চাশ ডলার জরিমানার কথা সারা জীবনেও ভুলব না। সুতরাং এসবে আমি নেই। আমি ঢাকা থেকে শুঁটকি, শুকনো সাতকরার ফুটি এসব অনেক নিয়ে এসেছিলাম। হিথরো দিয়ে নির্বিঘ্নে পার হয়ে লন্ডনে সব উপহার দিয়ে এসেছি। আমেরিকার জন্য কিছু নাই। সুতরাং আমার ডিক্লারেশন ফর্ম ‘নো’ তে ভরা। আমি আছি ফুরফুরা। কিন্তু এই নিয়ে বিপদে পড়েন আমার এক সহযাত্রী কাস্টমসের আগেই, ইমিগ্রেশনের লাইনে। তিনি সম্ভবত স্প্যানিশ। প্রথমবার এসেছেন আমেরিকা।
 
ইমিগ্রেশনে এসে দেখি নতুন নিয়ম হয়েছে আমেরিকায়। আমেরিকান, ক্যানাডিয়ান আর ব্রিটিশ পাসপোর্টধারীদের জন্য আলাদা কাউন্টার, আলাদা সারি। বাদবাকি দেশের জন্য আলাদা। এই দ্বিতীয় সারির জন্য নিয়মকানুন বেশ কড়া। এখানে লাইনও বেশ লম্বা। এই লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় বড় খরগোশের আকারে একটা কুকুর মহাশয়কে নিয়ে কালো কোর্ট পরা এক মহিলা হেঁটে এলেন। সব যাত্রীকে বললেন, হাত ব্যাগ ফ্লোরে নামিয়ে রেখে এক পায়ে দাঁড়াতে। বলেই তিনি সারমেয় শাবককে নিয়ে হেঁটে চললেন। সেই শাবক হেলেদুলে হেঁটে যেতে যেতে আমাকে অতিক্রম করার পরেই আমার পাশের স্প্যানিশ মহিলার হাতব্যাগ ধরে বসে পড়লো। সে আর নড়ে না।

কালো কোটওয়ালি সেই ব্যাগ তুলে যাত্রীকে বললেন, আপনার ব্যাগ খুলে দেখান কী আছে?
স্প্যানিশ মহিলা ব্যাগ খুলে দেখালেন। দেখা গেল সেখানে দুটি আপেল আছে। কোটওয়ালি বললেন, আপনার কাস্টমার ডিক্লারেশন ফর্ম দেখান।
তাকে ফর্মটি দেখানো হলো। সেখানে ‘ফুড’-এর ঘরে ‘নো’ তে টিক মার্ক দেয়া। এটা দেখে ক্ষেপে গেলেন কোটওয়ালি। বললেন, তুমি এখানে ভুল ডিক্লারেশন দিয়েছ। এটা বলে ফর্মের ওপর লাল কালিতে কী একটা সংখ্যা লিখে তাকে অন্য একটা কাউন্টারে রিপার্ট করতে বললেন।
অন্য মানুষের দুর্দশা দেখার মধ্যে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ আছে। ১৪ বছর আগে আমার দুর্দশা দেখে কিছু লোক নিশ্চয়ই আনন্দ পেয়েছিল। এবার আমি পেলাম।

সেই মহিলা কীভাবে পার পেলেন আমার দেখার সুযোগ ঘটেনি। আমার ডিক্লারেশনে সব জায়গায় ‘নো’ লেখা থাকার পরও ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে জেরা করতে লাগলেন। কত বোতল এলকোহল আছে কিংবা কত কার্টুন সিগারেট নিচ্ছি, কী পরিমাণ ডলার আমার সঙ্গে আছে জানতে চাইলেন। আমি বললাম। এরপর আমাকে সীল মেরে, দুই বুড়ো আঙুল আর ডান-বাঁ হাতের চার আঙুলের ছাপ নিয়ে আমাদের তিনজনকে ছেড়ে দেয়া হলো।


মালপত্তর বুঝিয়ে পেতে ঢাকা বিমানবন্দর ছাড়া আর কোথাও কোনো অভিযোগ আমার নাই। তারপরও মালামাল নিয়ে বেরিয়ে যাবার পরেই আরেকটা ঝামেলায় পড়ে যাই। আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য মিশিগানের ডেট্রোয়েট। সেটা আমেরিকান এয়ারের সঙ্গে কানেকটেড ডমেস্টিক ফ্লাইট। কথা ছিল ভেতরে থেকেই লাগেজপত্র ট্রান্সফার লাউঞ্জে গছিয়ে দেবো। ভেতরে ট্রান্সফার লাউঞ্জ না পেয়ে বাইরে এসে খবর পাই, ওটা ভেতরেই ছিল। আমরা আবার ভেতরে যেতে চাই। কিন্তু দরোজার সামনে দাঁড়ানো কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী আমাদের বলল, এই দরজা দিয়ে কেবল বেরুনো যায়, এখানে ঢোকার সুযোগ নেই।
আমি বলি, দরোজা তো খোলাই আছে। আমরা তো এই মাত্র বেরুলাম। ভেতরে ঢুকে জিনিসগুলো দিয়ে আবার বেরিয়ে আসব।  
হবে না।
তাদের ‘না’ মানে না-ই। কোনো কিছু দিয়ে ‘হ্যাঁ’ করানো যাবে না। ঢাকা হলে করিয়ে ফেলতাম। এখানে পারবো না। এখন যা করতে হবে, ট্রেন ধরে ৫ নাম্বার টার্মিনাল থেকে এই ৫টা চেক-ইন করা লাগেজ নিয়ে ৩ নাম্বার টার্মিনালে যেতেই হবে। এবং সেখানে গিয়ে আমেরিকান এয়ার-এর চেক ইন কাউন্টারে গছাতে হবে এইসব জিনিসপত্র।

সমস্যা নাই। আমাদের হাতে অফুরন্ত সময়। আরো সাড়ে চার ঘণ্টা পরে আমাদের লোকাল ফ্লাইট। আমরা ৩ নাম্বার টার্মিনালে এসে ৫টা বোচকা বুঝিয়ে দিয়ে বসে থাকি। চার ঘণ্টা সময় কাটানোর জন্য আমার কাছে একমাত্র উপভোগের কাজ ইন্টারনেট ব্রাউজিং। কিন্তু  এখানে সেরকম কিছু দেখছি না। লন্ডনে বিমানবন্দরে নামতেই ১২ জিবি ইন্টারনেটসহ একটা সিমকার্ড ধরিয়ে দিয়েছিল আমার ছোট ভাই রাসেল। এখানে কে দেবে? যার কাছে যাচ্ছি আমার ছোটবোন নুরু, তার সঙ্গে দেখা হবে ডেট্রয়েট বিমানবন্দরে।

ইবন, আমার পনেরো বছর বয়েসী পুত্র আমার চেয়ে ভালো ইংরেজি বলে। তাকে বলি, ঐ কাউন্টারে গিয়ে জেনে আয়, ওদের ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড আমাদের দেবে কিনা।
আমি যাবো না। কারণ ওরা আমাকে পাসওয়ার্ড দেবে না।
কেন?
ওরা মনে করেছে আমি আন্ডার টুয়েলভ!
কেমনে?
দেখো নাই, চেক ইনের সময় সিকিউরিটি চেকিংএ তোমরা সবাই জুতা খুলছো, আমাকে জুতা খুলতে বলেনি।
কেন বলেনি?
ওখানে লেখা ছিল, বারো বছরের নিচের বাচ্চাদের জুতা খুলতে হবে না। আমাকে ভেবেছে বারো বছরের  কম। এখন আমাকে ওরা ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড দেবে না।

এবার আমি উঠে গিয়ে কথা বলি। ঘটনা প্রায় সত্য। নো ফ্রি ওয়াইফাই। প্রতি পনেরো মিনিটের জন্য পনেরো ডলার দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যাবে। এমন সময় ইবন এসে বলল, ঐ বুথে ইন্টারনেট সিম পাওয়া যায়। তুমি চাইলে কিনতে পারো। ২০ ডলার দাম।
আমি বুথের কাছে যাই। কিন্তু বিশ ডলারের নোট পাই কোথায়? পাশে একটা স্যুভেনির শপ। ওখানে এক বৃদ্ধা দোকানদারী করছেন। তাকে অনুনয় করে বলি, আপনি কি আমার একশ ডলারের নোটটা ভাঙিয়ে দিতে পারবেন? আমার বিশ ডলারের একটা নোট লাগবে।
বৃদ্ধা মুখের মধ্যে মুচকি হাসি চেপে বললেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আমার দোকান থেকে কিছু না কিনলে আমি কখনো ভাংতি দিতে পারি না।
বৃদ্ধাকে বললাম, আমি ঐ বুথের ভেতরে ২০ ডলার ঢুকিয়ে সিমকার্ড নেবো। আমি ১০০ ডলার ঢুকালে বাকিটা কি ফেরত আসবে?
বৃদ্ধা বলল, আমি এটা জানি না।

বিরক্ত হই মহিলার ওপর। এই বুথের পাশে চাকরি করতে করতে এই মহিলা বুড়ি হয়েছেন সে কি এটা জানবে না? কেনো জানবে না? আমার কমন সেন্স বলছে, বাকি টাকা ফেরত আসবে। কিন্তু যদি না আসে।
আমার বিরক্তির বিষয়টা মহিলা টের পেলেন। তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন, পাশে একটা ব্যাংক আছে। সেই ব্যাংক আমার নোট ভাঙিয়ে দিতে পারবে।

পরের দেশে এসে মেজাজ দেখানো যাবে না। আমি লক্ষ্মীছেলের মতো কথা শুনি। সেই ব্যাংকে গিয়ে নোট ভাঙাই এবং ২০ ডলার ঢুকিয়ে দিতেই একটা কার্ড বেরিয়ে আসে। সেখানে ৩ রকমের সিমকার্ড। আমার ফোনের জন্য প্রয়োজনীয় ‘নেনো’ সাইজের সিমও আছে। এবং এটা ঢুকিয়ে মিনিট পাঁচেকের মাথায় আমার ফোনটা ইন্টারনেট যুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু কপাল ভালো না। মাত্র ১৫ মিনিট ব্রাউজিংয়ের পর দেখি ২০ ডলারের ব্যালেন্স শেষ। এটা একটা আন্তর্জাতিক সিমকার্ড। এটা পৃথিবীর সব দেশে চলে কিন্তু গলাকাটা রেট। সব কিছু বুঝে ওঠার আগেই ২০ ডলার শেষ!

এবার দিনের সর্বশেষ ধাক্কা ডেট্রয়েট বিমানবন্দরে। এখানে নামতেই ফূর্তি ফূর্তি ভাব। প্রথমত কোনো ইমিগ্রেশনের ঝামেলা নাই। শিকাগো থেকে ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটের ফ্লাইটে ডেট্রয়েট নেমে আমরা ব্যাগ খুঁজে হাতে নেই। আমাদের নামার আগেই ব্যাগ এসে হাজির। ইবন সাহেব নাচতে নাচতে ট্রলি আনতে যান। আমাদের লাগে তিনটা ট্রলি এবং এই ট্রলি ঠেলার কাজে তার আনন্দ অনেক বেশি। এর আগে হিথরো বা শিকাগোতে টান দিয়ে খুলে এনেছেন একসঙ্গে তিন ট্রলি। কিন্তু এখানে তিনি সুবিধা করতে পারছেন না। মুখ পানসে করে বলছেন, বাবা ট্রলি তো লক।
আমি জানি কেন লক।
এর আগেও এমন হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল এরাইভাল ছেড়ে ডমেস্ট্রিক ব্যাগেজ ক্লেইমে এসে এমন ঝঞ্জাটে পড়েছিলাম আগেও। তখন ছিল এক ডলার ভাড়া। এবার গিয়ে দেখি ১৪ বছরে এটা বেড়েছে ৪ গুণ, ৪ ডলার হয়েছে।

বলি, একটা ট্রলি নেই। ভারিগুলো গাদাগাদি করে একটায় রাখি। বাকিগুলো হাতে টানবো। আমি পাঁচ ডলারের নোট ফেলি। সঙ্গে সঙ্গে এক ডলার ফেরত আসে। এবার ইবন টান দিতেই তার হাতে চলে আসে একটা ট্রলি।
ইবন ভাবে, সব ট্রলিই এমন হবে। সে আরেকটা ট্রলিতে টান দেয়। আর কোনো ট্রলি নড়ে না। আবার কড়ি ফেললে আবার মাখার তেল আসবে। নো কড়ি, নো তেল- এই হচ্ছে আমেরিকা।

ডেট্রয়েট বিমানবন্দরের এরাইভাল লেখা দরোজা দিয়ে বেরোতেই দেখি দুটো বড় গাড়ি নিয়ে এসেছে নুরু, সঙ্গে তার স্বামী মহিবুব, কন্যা শাপলা, সাদিয়া, পুত্র শাহরিয়ার দেবর বাবলু আর আত্মীয় সুলেমান। ১৪ বছর আগে একা একা আমেরিকা ঘুরে দেখেছিলাম এবার স্ত্রী-পুত্র নিয়ে এসেছি। দেখি না এ ক’বছরে আমেরিকার কী পরিবর্তন হয়েছে।



৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ডেট্রয়েট, মিশিগান




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ অক্টোবর ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়