ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ইয়াসমিন ট্র্যাজেডির ২০ বছরেও নির্যাতন পরিস্থিতি ভয়াবহ

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২৪ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইয়াসমিন ট্র্যাজেডির ২০ বছরেও নির্যাতন পরিস্থিতি ভয়াবহ

শাহ মতিন টিপু : বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও বেড়েছে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা। বেড়েছে যৌন হয়রানি, ধর্ষণসহ, অপহরণের ঘটনা। এগুলোর মধ্যে কিছু ঘটনা প্রকাশিত হলেও বেশির ভাগ ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায় লোকলজ্জার কারণে। এসব ঘটনায় নির্যাতিতদের আইনি সুবিধার্থে ২০০০ সালে সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন তৈরি করে। সে আইনকে ২০১৩ সালে সংশোধন করে আরো কঠোর করা হয়। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতনের স্টিম রোলার থামিয়ে দেওয়া যায়নি। বরং দিন দিন ভয়াবহ উদাহরণ হয়ে একেকটি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা আমাদের সামনে উপস্থাপিত হচ্ছে।

ইয়াসমিন ট্র্যাজেডির ২০তম বার্ষিকী আজ। ১৯৯৫ সালের এইদিনে দিনাজপুরে পুলিশি হেফাজতে ইয়াসমিনকে ধর্ষণ ও হত্যার মতো ঘৃণ্য ঘটনাটি ঘটে। এই ট্র্যাজেডির সূত্র ধরে দিনটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবেও পালন করা হয়। ২৪ আগস্ট দিনাজপুরের ১০ মাইল নামক স্থানে পুলিশি হেজাফতে ধর্ষিত ও নিহত হয় কিশোরী ইয়াসমিন। ঘটনায় আগের রাতে দিনাজপুর শহরের রামনগরের বাসিন্দা ইয়াসমিন ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওগামী কোচযোগে দশ মাইলে এসে নামে। স্থানীয় দোকানদারেরা তাকে কোতোয়ালি থানার টহল গাড়িতে উঠিয়ে দেয়। এরপর অসহায় কিশোরী ওই গাড়িতে থাকা পুলিশের পাশবিক লালসার শিকার হয়। ঘণ্টা খানেক পর দশ মাইল থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ইয়াসমিনের বিবস্ত্র মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় লোকজন।
 
তখন এই পৈশাচিক ঘটনায় উত্তাল প্রতিবাদ শুরু হয় দিনাজপুরে। ঘেরাও করা হয় কোতোয়ালি থানা। ২৭ আগস্ট আহ্বান করা হয় গায়েবানা জানাজা। এই জানাজা অভিমুখী জনতার স্রোতে গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। নিহত হয় ৭ জন নিরীহ মানুষ। এরপর বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ফুঁসে ওঠে জনতা। তারা পুলিশের ৪টি ফাঁড়ি, ৪টি গাড়ি, স্থানীয় ৪টি দৈনিক সংবাদপত্র অফিস, প্রেসক্লাব পুড়িয়ে দেয়। ভীতসন্ত্রস্ত পুলিশ বাহিনী আশ্রয় নেয় পুলিশ লাইনে। ২৮ আগস্ট থেকে দিনাজপুরে মোতায়েন করা হয় বিডিআর। ১২ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দিনাজপুরে গেলে জনগণ তাকে কালো পতাকা প্রদর্শন করে।
 
এই ন্যক্কারজনক ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষে সিআইডি ১৯৯৬ সালের ১৪ মে পুলিশের এসআই মইনুল, কনস্টেবল সাত্তার, ড্রাইভার অমৃত লাল, কোতোয়ালি থানার ওসি মাহাতাব উদ্দীন, এএসআই জাহাঙ্গীর আলম, এএসআই স্বপন চক্রবর্তী, এএসআই মতিউর রহমান (ওসি ওয়াচ) এবং এসপি আবদুল মোতালেবকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৬ (৪) এবং বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ২০১/৩ ধারায় চার্জশিট দাখিল করে। পরে একই বছরের ৬ জুন ইয়াসমিনের লাশের প্রথম ময়না তদন্তকারী ডাক্তার মো. মহসীনকে আসামি করে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হয়। ১২৩ দিনের শুনানি এবং ৪৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে আসামি মইনুল, সাত্তার এবং অমৃতর ফাঁসির আদেশ দিয়ে এই মামলার রায় ঘোষণা করা হয় ’৯৭ সালের ৩১ আগস্ট। অন্য আসামিদের খালাস দেওয়া হয়। হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সে নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকে। আসামিরা সুুপ্রিম কোর্টে আপিল করলেও রায় বহাল থাকে। ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর আসামিদের মধ্যে এসআই মাইনুল ও কনস্টেবল সাত্তারের ফাঁসি কার্যকর হয়। পরে ড্রাইভার অমৃত লালের ফাঁসিও কার্যকর করা হয়।

দিনাজপুর জেলা পরিষদ ইয়াসমিনের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য দশ মাইল মোড়ে একটি স্মৃতি ভাস্কর্য স্থাপন করে এবং তার পাশে ইয়াসমিনের নামে একটি পোস্ট অফিস ও যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করেছে। ইয়াসমিন স্মরণে প্রতিবছর ২৪ আগস্ট বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হচ্ছে।

প্রতিদিন শিশুহত্যা ও নারী নির্যাতনের বহু খবর প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আমরা দেখতে পাচ্ছি। পবিত্র ঈদুল ফিতর এর আগের দিন সাভারের জিঞ্জিরা এলাকায় ইলেকট্রিক টেস্টার দিয়ে সুখী নামের এক নারীর চোখ উপড়ে ফেলে তার বর্বর স্বামী রবিউল এবং তার সঙ্গে ছিল দুই ভাই আর এক বোন। বিয়ের পর থেকেই সুখীকে যৌতুকের জন্য তার স্বামী মারধর করত। উল্টো স্বামীকে বিদেশ যাওয়ার জন্য টাকা দিলেও শেষরক্ষা হয়নি। সুখীকে হারাতে হয়েছে চোখ। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মনজুরের চোখ উপড়ে ফেলে তাকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন তার পাষণ্ড স্বামী। এমন অসহায়, নির্যাতিত, নিপীড়িত নারীর বোবা কান্না আমরা দেখছি চারপাশে প্রতিদিন। এইতো সেদিন মাদারীপুরে দুই স্কুলছাত্রীকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে। নারী ও শিশুরা অসহায় এবং পরগাছা বলে নিপীড়ন, নির্যাতন, পিটিয়ে হত্যা করার মতো মধ্যযুগীয় বর্বরতা যেন তাদের জন্য নির্ধারিত।

একদিকে, নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে নারী ও শিশুদের অত্যাচারের, নির্যাতনের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। আমাদের সমাজে অস্থিরতা বেড়ে গেছে। মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে, ফলে অতি সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে তাদের নির্মম অত্যাচারের শিকার হতে হচ্ছে। ধর্ষণ, পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। এক তথ্যে জানা যায়, গত ছয় মাসে প্রায় অর্ধশতাধিক শিশু ও কিশোরকে হত্যা করা হয়েছে। অপরাধীদের বিচার সুষ্ঠু এবং যথাযথভাবে না হওয়ায় অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলেছে। অপরাধীরা এখন আর আইনের তোয়াক্কা করছে না।

প্রসঙ্গত, দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে।

অবশ্যই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধিত আইন, ২০১৩ অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করবেন। ট্রাইব্যুনাল যদি ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার কারণসংবলিত একটি প্রতিবেদন ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করতে হবে। যার একটি অনুলিপি সরকারকেও দিতে হবে। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে পাবলিক প্রসিকিউটর ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে ৩০ দিনের মধ্যে সরকারের কাছে কারণ উল্লেখপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। এ রকম দাখিলকৃত প্রতিবেদনগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিবেচিত হওয়ার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

প্রসঙ্গত, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি একটি বিশেষ আইন। এ মামলায় হাইকোর্টকে আগাম জামিন দেওয়ার এখতিয়ার দেওয়া হয়নি। বিশেষ আইনে জামিনের ক্ষেত্রে সাধারণত ফৌজদারি কার্যবিধির বিধানগুলো প্রযোজ্য হবে না। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১৯(২)(৩) ও (৪) উপধারায় জামিনের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির কোনো বিধান ১৯ ধারায় প্রযোজ্য হয়নি।

এ ছাড়া কোনো ভিকটিম যদি মামলা করতে অসমর্থ হন বা কোনো হুমকির সম্মুখীন হন, তাহলে কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে যারা আপনাকে সহযোগিতা করবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল প্রভৃতি।

দেশে যেভাবে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনার বীভৎস রূপ প্রদর্শিত হচ্ছে, বেড়েছে যৌন হয়রানি, ধর্ষণসহ অপহরণের ঘটনা, তাতে আইনের কঠোর প্রয়োগের বিকল্প নেই। আর এই দুর্বৃত্তায়নের মূলোৎপাটনে সমাজের কাউকে না কাউকে তো অবশ্যই ভিকটিমের পাশে দাঁড়াতে হবে।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ আগস্ট ২০১৫/ টিপু/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়