ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ঈদের দিন রিজেন্টস পার্কে

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৪৭, ৩১ আগস্ট ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঈদের দিন রিজেন্টস পার্কে

রিজেন্টস পার্ক

ফেরদৌস জামান : কোনো এক ঈদের দিন। নামাজ পড়তে যাব স্টাডলি রোডের শেষ প্রান্তে গ্রিণ স্ট্রিট সংলগ্ন মসজিদে।

 

মসজিদটি কয়েকদিন আগেই দেখে এসেছি। ঠিক করেছি নামাজ এখানেই পড়ব। কনকনে শীত, সঙ্গে বাতাস। নামাজের প্রস্তুতি শুরু করলাম। প্রথমেই গোসল করা চাই, ঈদের দিন বলে কথা। গ্রামীণ জীবনে ঈদের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে যেন এ এক অনুসঙ্গ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। আশপাশের দুচার বাড়ির সকলে মিলে নদী অথবা পুকুরটায় যাওয়া এবং দেশি-বিদেশি সুগন্ধ সাবানে গোসল। কার সাবান কত উন্নত সে নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। এমনও দেখা যায়, দামি অথবা বিদেশি সাবানটা ঈদের গোসলের জন্য ছয়-সাত মাস পর্যন্ত যত্মে রেখে দেওয়া হয়। সাবানের ধরন বা মানের চেয়ে মুখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হত দাম, সুগন্ধ অথবা কোন দেশ থেকে আগত।

 

যাই হোক, গোসল সেরে বাড়ি ফিরে পোশাক পরিধানের পর চলে আতর, সুরমায় নিজেকে সাজানোর পর্ব। এমন সব স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে নদী পুকুরের-বদলে ইয়োরোপীয়ান বাথরুমটায় গোসল সেরে দ্রুত গিয়ে উপস্থিত হই মসজিদে।

 

মুসল্লির সংখ্যা কম নয় অথচ, কেউ যেন কাউকে চেনে না। তাদের মধ্যে পাকিস্তানির সংখ্যাই বেশি। বাংলাদেশি একেবারেই হাতে গোনা। নামাজ শেষে যে যার মত প্রস্থান করায় ব্যাস্ত। জীবনে মনে হয় এই প্রথম এমন একটা ঈদ ছিল। যেদিন নামাজের পর একজন মানুষের সাথেও শুভেচ্ছা বিনিময় হয়নি।

 

অথচ, নামাজ শেষে গ্রামের ঈদগাহ থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতেই পেরিয়ে যেত এক ঘণ্টা। কতজনের সঙ্গে মোলাকাত আর শুভেচ্ছা বিনিময় হত তার ঠিক নেই!

 

শীত পড়েছে। সুতরাং, পাঞ্জাবি-চাঁদরে আর হবার নয়। বাসায় ফিরে সমস্ত পোশাক পরিবর্তনের পর গায়ে চড়াতে হল একাধিক কাপড়। ফোন এল, রুমমেট আজিজের আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াত খেতে যেতে হবে। সিলেটের মানুষ হওয়ায় লন্ডনে তার অনেক আত্মীয়-স্বজন রয়েছে।

 

vromon

 

দাওয়াত খেতে গেলাম আনোয়ার ভাইয়ের বাসায়। লন্ডনে পদার্পনের পর প্রথম খাবার গ্রহণ করেছিলাম তার বাসায়। টেবিল ভরা খাবার, আফগানি আতপ চালের পোলাও, জাফরানি জর্দা, মাংসের রেজালা, কেক, পুডিং আরো কত কি!

 

হরেক পদের খাবারের মাঝে আমার দুচোখ যে জিনিসটি বারবার খুঁজে ফিরল তা হল, লাচ্ছা সেমাই। বাঙ্গালি জিহ্বা বলে কথা, যেখানেই যাক না কেন সুযোগ বুঝে আসল জিনিসটি খুঁজে নিতে চাইবেই। লাচ্ছা সেমাইয়ের খোঁজে ব্যর্থ হয়ে চোখ জোড়াকে গুটিয়ে নিয়ে আস্বাদন করলাম বাঙ্গালি, পাকিস্তানি আর ইংরেজি, আফগানি খাবারের স্বাদ। মুরগী অথবা ভেড়ার মাংসের সমুচা হল প্রধান পদ। বাঙ্গালি মাত্রই এই পদটি অবধারিত। মচমচে ভাজা সমুচা খেয়েই বোধহয় আধপেট ভরিয়ে ফেললাম। একে একে তিন-চারটি বাসায় দাওয়াত খাওয়া হল। পেট পূজোর পর্ব শেষ, তারপর বাসায় ফেরা। পকেট থেকে হাত বের করে দেখি মাঝখান দিয়ে সেলামি হিসেবে যোগ হয়েছে প্রায় একশ পাউন্ড। ঈদের উপহার হিসেবে আজিজের কোনো এক আত্মীর কাছ থেকে মিলেছিল বাড়তি এক জিনিস। খাওয়া শেষে টেবিলে রাখা পিরিচ থেকে এক দানা সুপারি তুলে মুখে দিয়েছিলাম। তা দেখে পরিবারের বয়োজষ্ঠ্য মহিলাটি একটি ছোট্ট পোটলা এনে হাতে ধরিয়ে দিযে বলেন, সুপারি খাওয়া ভালো, বাসায় নিয়ে যাও এবং মাঝেমধ্যে দু-এক দানা করে খেয়ো, বেশ মজা পাবে। হাতে নিয়ে দেখি ওজন কম করে হলেও দুই-আড়াইশ গ্রাম হয়ে থাকবে। এত কি করব? বলেন, আরো আছে দেশ থেকে কয়েক কেজি করে আনিয়ে নেই। জীবনে কমবেশি অনেক উপহার পেয়েছি, যার মধ্যে অনেকগুলোর কথা স্বাভাবিকভাবে ভুলেও গেছি কিন্তু এই উপহার ভুলবার নয়।

 

মনে আছে সেই সুপারি শেষ করতে প্রায় ছয়মাস লেগেছিল। সেই সুপারি খাওয়ার অভ্যাস, সুযোগ পেলে ভাত খাওয়ার পর আজও দু-এক দানা মেরে দেই। দুপুর নাগাদ যে যার মত হলাম। আমার যাওয়ার কথা মনোরম এক পার্কে। সে লক্ষে ম্যানঞ্চেস্টারে থেকে রওয়ানা করেছে সেলিম। আমার এক সময় ঢাকার রুমমেট। এক সপ্তাহ আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছে ঈদের দিন একসাথে ঘুরব। ফোন এল, সে ইতিমধ্যেই লন্ডন পৌঁছে গেছে এবং অবস্থান করছে হোয়াইটচ্যাপল নামক জায়গায়। দেখা হল অনেকদিন পর। অল্প বয়সে টাক পড়ে যাওয়ায় মাথাটা যেন আরো বেশি চকচকে হয়ে গেছে। রয়াল হাসপাতালের পেছনটায় তার আরো পাঁচ ছয়জন বন্ধু অপেক্ষায় রয়েছে। সকলে মিলে যাওয়া হবে রিজেন্টস পার্কে।

 

দ্বিতল বাসের ওপর তলায় জানালার পাশের একটি আসনে বসে পড়লাম। অনেকদিন পর একত্র হতে পেরে অন্যরা গল্পগুজবে মেতেছে। আমি জানালা দিয়ে দেখতে থাকলাম লন্ডন শহরের পথ, পথের ধারের গাছ আর দালানকোঠা। ঢাকাতেও এই একই কাজ করতাম।

 

যখন প্রথম ঢাকায় আসি শহরের পথে পথে চলতাম আর ভাবতাম, এই ঘিঞ্জি শহরটায় গাছপালা থাকাটা কি অন্যায়? থাকতাম মিরপুর এগার নম্বর এলাকায়। টিকিট কেটে দ্বিতল ভলভো বাসগুলোর ওপরে কোনো এক আসনে জায়গা করে নিতাম। রোকেয়া স্বরণির ডিভাইডারে বেড়ে ওঠা গাছগুলোর ডালপালার স্পর্শে এগিয়ে যেত ভলভো। মনে হত যেন কোনো অরণ্যের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছি।

 

vromon1

 

লন্ডন শহরে তেমনই পথের ধারে অনেক গাছ। দুপাশে পুরনো গাছ, হলুদ, সবুজ, কচি এবং কত রকমের পাতা ও ফুলে রাঙ্গিয়ে থাকে তার ঠিক নেই। অচেনা পথ তাই বাকিদের ওপরেই ভরসার সবটুকু, যেদিকে নিয়ে যাবে সেদিকেই যেতে হবে। বাস থেকে নেমে পড়ি নিরিবিলি এক স্টপেজে। প্রবেশ করি রিজেন্টস পার্কের সীমানায়। কত রকমের গাছ আর ফুল শোভা পাচ্ছে তা না দেখলে বোঝাবার নয়। প্রতিটি গাছে যেন শিল্পের ছোঁয়া। এত সাজানো গোছানো হতে পারে তা ভাবাই যায় না! পার্কটি উত্তর-পশ্চিম লন্ডনে অবস্থিত, যা কিনা আবার একই সঙ্গে ওয়েস্টমিনিস্টার সিটির অংশ। ১৬৬ হেক্টর আয়তনের রিজেন্টস পার্ক। ১৫৩৮ সালে রাজা হেনরি-৮ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। প্রথমে ব্যবহৃত হত রাজার শিকারের জায়গা হিসেবে। পরবর্তীতে যুবরাজ রিজেন্টেসের নাম অনুসারে পার্কের নামকরণ হয় রিজেন্টস পার্ক। গোল আয়তনের পার্কে রয়েছে তিনটি প্লে-গ্রাউন্ড। উন্মুক্ত থিয়েটারও রয়েছে। বছরে মাত্র পনের সপ্তাহ ধরে চলে পরিবেশনা, জুন থেকে সেপ্টেম্বর।

 

পার্কে রয়েছে ঝর্না, লেক ইত্যাদি। এ ছাড়া পার্কের অন্যতম আকর্ষণ হল ফুল বাগান। রাজ পরিবারের একাধিক সদস্যের নামে একেকটি বাগান। কুইন ম্যারি গোলাপ বাগানের বিশেষত্ব হল, এই অংশে রয়েছে চারশ প্রজাতির ত্রিশ হাজার গোলাপ গাছ। এত অধিক প্রজাতির এবং একসঙ্গে এত পরিমাণ গোলাপ গাছ পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে বলে মনে হয় না।

 

নানা রঙের গোলাপে যেন পৃথিবীর বৃহৎ ও বর্ণিল কার্পেটটি বিছিয়ে রাখা হয়েছে রিজেন্টস পার্কের একটি অংশজুড়ে। লেকের পানিতে ভেসে বেড়ায় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও হাস। রংবেরং এর পাখিগুলো মানুষের আনাগোনায় মোটেও ভয় পায় না। একেবারে কাছ দিয়ে ভেসে বেড়ায়। তাদের বিচরণে ব্যাঘাত ঘটাতে ঢিল ছোরার মত ঘটনা তো দূরের কথা, কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করে না। সৌন্দর্যের প্রতি যত্মশীলতার  কারণে পৃথিবীজুড়ে ইংরেজদের নাম রয়েছে।

 

লেকের সৌন্দর্যে আমাদের উচ্ছ্বাস আর মুগ্ধতা প্রত্যক্ষ করে এক বৃদ্ধ দম্পতি নিজ থেকেই নিকটে আসেন এবং বলেন, এই লেকের ইতিহাসে যুক্ত রয়েছে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। ১৮৬৭ সালে লেকটি বরফের স্তুপে ঢাকা পড়লে অসাবধানতার বসে প্রায় দুইশজন মানুষ বরফের চাই ভেঙ্গে নিচে পড়ে গেলে চল্লিশ জনের মৃত্যু হয়। দম্পতির কথা শুনে মনে হল, কে জানে হয়ত এদের কোনো পূর্বপুরুষও নিহতদের মধ্যে থেকে থাকবে হয়ত?

 

যে কোনো ধরনের শিল্প বা সৃজনশীলতার প্রতি তাদের সম্মান, শ্রদ্ধা এবং যত্মের তারিফ করতে হয়। কখনও পাথরখণ্ডের সলিং, পিচঢালা পথ তো কখনও কংক্রিট অথবা ছোট ছোট পাথর বিছানো পথ, সমস্ত পার্কজুড়ে যেন মাকড়শার জালের মতে পেঁচিয়ে রয়েছে।

 

প্রতিটি গাছ, প্রতিটি স্থাপনায় সার্বক্ষণিক যত্মের ছোঁয়া লেগেই আছে। মানুষগুলোও তেমন, গাছের একটি পাতা পর্যন্ত ছিড়বে না।

 

vromon2

 

অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, প্রথম থেকেই আমাদের অন্যসব সহযাত্রীর আচরণকে পার্কের নিরবতা আর শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী বলে মনে হচ্ছিল। এই যেমন হৈ চৈ, ধুমপান করা অধিকন্তু যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা। এসব করে তারা নিজেদের বীরত্বের বহিপ্রকাশ ঘটাতে চাচ্ছিল কি না জানি না। তাতে যে শুধু অস্বস্তি লেগেছিল তা নয় বরং লজ্জায় নিজের কাছে ভিষণ ছোট হয়ে গিয়েছিলাম। আরো বেশি অপমানিত বোধ হয়েছিল যখন লক্ষ করি আশপাশ দিয়ে চলা লোকগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আমাদের এই কর্মকাণ্ড। এ ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে রকমের শিক্ষা।

 

পার্কে প্রবেশের কোনো প্রবেশ মূল্য দিতে হয় না। সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে ভোর পাঁচটা থেকে রাত আটটা বা সাড়ে আটটা পর্যন্ত। সমস্ত পার্কজুড়েই অনেক মানুষ অথচ, যেন কেউ নেই। ক্রমেই রাতের আঁধার ঢেকে ফেললো সমস্ত পরিবেশটাকে। জ্বলে উঠল নানা রঙের অসংখ্য বাতি। পার্কের একেকটি জোনে একেক প্রজাতির গাছ বা ফুলের বাগান, মাঝে মাঝে অসাধারণ সব ভাস্কর্য ও ফোয়ারা। প্রত্যেকটি জিনিসের মেজাজ ও প্রকৃতির সাথে মিল রেখে বাতি জ্বালানো রয়েছে। গছের পাতা, ফুল এবং সমস্ত আয়োজনকে আরো বেশি পরিপাটি করে তোলে রাতের অন্ধকারে বাতিগুলো থেকে বিচ্ছুরিত মিটমিটে আলোর রঙ্গিন রেখা।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ আগস্ট ২০১৬/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়