এই অনাথদের চোখে এখন বড় হওয়ার স্বপ্ন
আরিফ সাওন || রাইজিংবিডি.কম
আরিফ সাওন : সুজন–সুমন দুই ভাই। তাদের মা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা রেললাইনের পাশে ইট ভাঙে। তাদের বাবা ভিক্ষা করতেন। তাদের জন্মের পর বাবা মারা যায়। এরপর রাস্তায় রাম্তায় ঘুরত তারা। কাগজ কুড়িয়ে বিক্রি করত। বছর চারেক আগে এই দুই শিশুকে নিয়ে আসা হয় নাসরিন একাডেমিতে। এরপর তাদের স্কুলে ভর্তি করা হয়। এখন তারা দুইজনই তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী। যারা একদিন কাগজ কুড়িয়ে জীবন ধারণ করত, তারা এখন স্বপ্ন দেখে অনেক বড় হওয়ার।
শুধু সুজন-সুমন নয়, এ একাডেমিতে ঠাঁই হয়েছে ২০টি অনাথ শিশুর। এদের মধ্যে কারো বাবা নেই, কারো মা নেই, কারো মা-বাবা কেউই নেই। এই একাডেমির সবাই এখন তাদের স্বজন। এখানেই তারা বেড়ে উঠছে। লেখা-পড়া করছে, খেলাধুলা শিখছে।
নাসরিন করিম প্রথমে অনাথ শিশুদের লালন পালনের উদ্যোগ নেন। এক সময় তিনি মারা যান। কিন্তু তার উদ্যোগের কথা ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন। যা তার ছেলে দেখে মায়ের আশা পূরণের জন্য ২০১১ সালে অনাথ শিশু সংগ্রহ শুরু করেন। ২০১৩ সালে বিভিন্ন স্থান থেকে ২০টি অনাথ শিশু সংগ্রহ করেন। তাদের লালন পালনের দায়িত্ব নেন নাসরিন করিমের ছেলে। ২০টি শিশুই এখন শৈলরানী দেবী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণীর শিক্ষার্থী।
বিদ্যালয়ে পড়াশুনার বাইরেও এদের আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলার উপযোগী করার জন্য আলাদাভাবে শিক্ষক রেখে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। খেলাধুলা, ইংরেজি, বাংলা, আরবি শিক্ষায় পারদর্শী করে তোলার জন্য কয়েকজন শিক্ষক রয়েছেন। জাকিয়া আক্তার প্রিয়া তাদের ইংরেজি পড়ান। বাংলা পড়ান লিজা আক্তার ও প্রিয়াংকা। আরবি পড়ান হাফেজ মো. আবুল কালাম। খেলাধুলার প্রশিক্ষণ দেন কুমিল্লা জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রশিক্ষক মো. আব্দুল মতিন। অনাথ শিশুদের রান্না করে খাওয়ানোর দায়িত্বে রয়েছেন কল্পনা রাণী। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে রয়েছেন শাহিন। শিশুদের দেখাশুনা করেন নাসরিন আক্তার। এ ছাড়া দেখভালের জন্য রয়েছেন হুরি জান্নাত ও জলি আক্তার। গার্ডের দায়িত্বে রয়েছেন হারুন।
মো. আব্দুল মতিন জানান, তিনি দুই বছর ধরে শুক্রবার বাদে প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত শিশুদের খেলাধুলার প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন। ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ও বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলা শিখান। শিশুদের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব নেই। সুমন ভালো ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলে। আরো কয়েকজন আছে বেশ ভালো খেলে।
আরবি শিক্ষক হাফেজ মো. আবুল কালাম জানান, তিনি দুই বছর ধরে শিশুদের আরবি শিখিয়ে আসছেন। এ সব শিশুরা এখন আজান ও আকামত দিতে পারে।
সম্প্রতি এ প্রতিবেদক কুমিল্লার দারোগাবাড়ীতে নূর এ ফরিদ নাসরিন একাডেমিতে অনাথ শিশুদের সঙ্গে সময় কাটান। দেখা যায়, শিশুরা সেখানে ভালো আছে। তারা যেন এক মায়ের ২০ সন্তান। জামা কাপড় থেকে শুরু করে সব একই রকম তাদের। তারা একসঙ্গে গোসলে যায়, খেতে যায় এক সঙ্গে। খেলাধুলা করে সকলে মিলে-মিশে।
সুজন জানায়, এখানে তাদের যারা দেখাশুনা করেন, তারা তাদের ভালোবাসেন। দুষ্টমি করলেও তারা বকা দেয় না। ভুল করলে বুঝিয়ে বলে। তার ইচ্ছা জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেটার হওয়া।
সুমন জানায়, তাদের খাওয়া-থাকায় অসুবিধা নেই। তারা যা চায়, তাই–ই পায়। এখন এরাই তাদের মা-বাবা। সুমনের লক্ষ্য বড় হয়ে সে ইঞ্জিনিয়ার হবে।
এখানকার পরিচালক আবুল কালাম বলেন, তিনি বিভিন্ন এলাকা থেকে ৭-৮টি অনাথ শিশুকে এনেছেন। এদের মধ্যে ইউসুফ, সিফাত, সোহাগের মা-বাবা নেই। মোট ২০টি শিশু সংগ্রহ করে লালন পালন করা হচ্ছে। তাদের অধিকাংশের বাড়ি কুমিল্লা ও তার আশপাশের জেলায়।
ঢাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করে অনাথ শিশুদের জন্য সম্প্রতি একাডেমির পাশে পাঠাগার করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে শিশুদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলাই এ পাঠাগার স্থাপনের লক্ষ্য। পাঠাগারে আছে ৬০০টি শিশু ও কিশোর উপন্যাস, গোয়েন্দা কাহিনি, ফিকশন, ছোট গল্প, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ছড়া এবং সাধারণ জ্ঞানের বই। শিশুদের উপযোগী করে সাজানো হয়েছে এ পাঠাগার।
ম্যানেজার ইফফাত নওরিন মল্লিক জানান, এ সব অনাথ শিশু প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই একাডেমি তাদের ব্যয় বহন করবে। তাদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হবে।
একাডেমির সেক্রেটারি জেনারেল নাসরিন করিমের ছেলে মিশাল করিম বলেন, মায়ের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে তিনি অনাথ শিশুদের লালন পালনের খরচ বহন করছেন। তিনি তার মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে চান।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ মে ২০১৬/আরিফ সাওন/বকুল
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন