ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

এইডসে মারা গেছে ৩৫ মিলিয়ন মানুষ

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:০৯, ১ ডিসেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এইডসে মারা গেছে ৩৫ মিলিয়ন মানুষ

বিশ্ব এইডস দিবস ২০১৫ এর লোগো

শাহ মতিন টিপু : ইউএন এইডসের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৩৪ মিলিয়ন মানুষ এইডসে আক্রান্ত এবং এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মানুষ এ মরণঘাতি রোগে মৃত্যুবরণ করেছে। এইডস  রোগ বিশ্বমানবতার জন্যই মারাত্মক হুমকি। এইডস আক্রান্তরা সমাজে একঘরে হয়ে পড়ে।

 

এইডস কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়, অথচ এইডস রোগীকে চিকিৎসা  সেবা দিতেও অনেকে ভয় পায়। ফলে আক্রান্তরা ঠিকমতো সেবা নিতে পারছে না।

 

তা ছাড়া অনেক রোগী সমাজ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে রোগ গোপন করছে। যেসব কারণে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে,  সে বিষয়গুলোতে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে পারিবারিক বন্ধনকে। পারিবারিক বন্ধন সুসংহত হলেই এইডস ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে। ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে মনোযোগী হলেও এইডস ঝুঁকি থেকে বাঁচা সম্ভব।

 

এইডসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্ব সম্প্রদায় ১৯৮৮ সাল থেকে বিশ্ব এইডস দিবস পালন করে আসছে। ‘এইচআইভি সংক্রমণ ও এইডস মৃত্যু : নয় একটিও আর, বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়বো সবাই, এই আমাদের অঙ্গীকার’-  এই হল এ বছরের বিশ্ব এইডস দিবসের প্রতিপাদ্য। বিশ্ব এইডস দিবস আজ। প্রতিবারের মতো এবারো বাংলাদেশে দিবসটি পালন করার জন্য বিভিন্ন কমসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

 

দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী আলাদা বাণী দিয়েছেন। দিবসটি উপলক্ষে আজ সকাল ১০টায় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন।

 

দিবসটি উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও ৭টি মেডিক্যাল কলেজসহ মোট ১২টি সরকারি হাসপাতালে এইচআইভি রোগ শনাক্তকরণ, চিকিৎসা, এইচআইভিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ এবং কাউন্সিলিং সেবাসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।’

 

আফ্রিকা এ রোগের প্রধানতম অঞ্চল হলেও বাংলাদেশ এই ভয়ানক ব্যাধিটি থেকে মোটেই ঝুঁকিমুক্ত নয়। ইউএনএইডসের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তির অনুমিত সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার ৫০০। সরকারি হিসাবে, ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৩ হাজার ২১৪ জন এইডস রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪৭১ জন এই রোগে মারা গেছে। যদিও পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এইডস রোগীর সংখ্যা কম। বর্তমানে এই সংখ্যা ০.১ শতাংশেরও কম। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম এইডস রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়।

 

বেশ কিছু কারণেই বাংলাদেশ এইডস ঝুঁকির মধ্যে। প্রতিবেশি  দেশে সংক্রমণের হার উচ্চ থাকাটাই আমাদের জন্য বেশি ভয়ের। যেহেতু প্রতিবেি দেশের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ ও যাতায়াত একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার। কেবল চিকিৎসার জন্যই প্রতিদিন প্রচুর মানুষের আসা যাওয়া অব্যাহত। এ ছাড়া আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের মতো বিষয়গুলোও রয়েছে। ফলে বাংলাদেশে এইডসের হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

 

এই ঘাতক ব্যাধি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতেই প্রতিবছর ১ ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবস পালন করা হয়। প্রথম ১৯৮৭ সালের আগস্টে বিশ্ব এইডস দিবস পালনের কথা ভাবেন জেমস ডব্লিউ বান ও থমাস নেটার। এরা দুজনই এইডস বিষয়ক বিশ্ব কর্মসূচির তথ্য কর্মকর্তা। এরপর ১৯৮৮ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে প্রতিবছর দিবসটি পালিত হচ্ছে। বিশ্ব এইডস দিবস ২০১৪-এর প্রতিপাদ্য ছিল  ‘দৃষ্টিপাত, অংশীদারিত্ব, অর্জন : একটি এইডসমুক্ত প্রজন্ম’।

 

এইড্স কী ? সম্ভবত এ কথাটি এখন আর কারোর অজানা থাকার কথা নয়। এইচআইভি (Human Immune Deficiency Virus) সংক্রমিত এ রোগ ধীরে ধীরে নষ্ট করে ফেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এ রোগের কার্যকর কোন চিকিৎসা না থাকায় এ রোগের পরিণতি মৃত্যু।

 

এইচআইভি ভাইরাসটি মানবদেহের প্রতিরোধ প্রনালীর টি-হেলপার কোষে প্রবেশ করে তার ভেতরে জেনেটিক পদার্থকে স্থায়ীভাবে ধ্বংস করে ফেলে। ফলে আক্রান্ত মানুষ তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ক্রমাগত দূর্বল হয়ে পড়ে।

 

কারও রক্তে এইচআইভি পাওয়া গেলেই উক্ত ব্যক্তি এইডস দ্বারা আক্রান্ত বলা যাবে না। একজন ব্যক্তির এইডস হয়েছে তখনই বলা হবে যখন তার রক্তে এইচআইভি পাওয়া যায় এবং এক বা একাধিক সুযোগ সন্ধানী সংক্রমণে আক্রান্ত হয়। যেমন- টি বি, ক্রমাগত ডায়রিয়া ইত্যাদি।

 

কেউ এইচআইভি দ্বারা আক্রান্ত কিনা তা রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায়। শুধু লক্ষণের ওপর নির্ভর করে কেউ এইচআইভি-তে আক্রান্ত বলা যাবে না। অনেক মানুষ এইচআইভিতে আক্রান্ত, কিন্তু বহু বছর লক্ষণ বা চিহ্ন বিহীন থাকতে পারে। সাধারণত এইচআইভিতে আক্রান্ত রোগীর যেসব আলামত দেখা যেতে পারে তা হচ্ছে- মুখে ঘা, কাশি, জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, পেটের রোগ, চর্মরোগ এসব। স্বাভাবিকতার গ-ি পেরিয়ে এসব রোগ অস্বাভাবিক হয়ে উঠলেই তবে আলামত হিসাবে বিবেচনায় আনা যেতে পারে।

 

আর যেসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে তা হচ্ছে- অরক্ষিত যৌন মিলন,  আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত বা রক্তজাত পদার্থ শরীরে গ্রহণ, ব্যবহ্তৃ সূঁচ, সিরিঞ্জ ও ক্ষত সৃষ্টিকারী যন্ত্রপাতি ছুরি, ব্লেড, কাঁচি জীবণুমুক্ত না করে ব্যবহার, ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ, একই সিরিঞ্জ/সূঁই এর একাধিক ব্যবহার ইত্যাদি।

 

মনে রাখতে হবে, আক্রান্তের কাছে এলে কিংবা তাকে স্পর্শ করলেই এইচআইভি ছড়ায় না। এদের সঙ্গে আলিঙ্গন বা করমর্দন করলে, এদের টয়লেট-ল্যাট্রিন টেলিফোন থালা গ্লাস চামচ তোয়ালে কাপড় বিছানার চাদর ব্যবহার করলে কিংবা কাশি এবং হাঁচির মাধ্যমে অথবা পুকুরের পানির মাধ্যমে এইচআইভি ছড়ায় না।

 

এইচআইভি সংক্রামণ ঘটেছে সন্দেহ হলে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের পর রক্তে এইচআইভি এন্টিবডি শনাক্তকরণের জন্য কমপক্ষে ছয়মাস অপেক্ষা করতে হবে। ছয়মাস পর রক্ত পরীক্ষায় ৯৯% সঠিক হয়। ছয়মাস পূর্বে রক্ত পরীক্ষা করলে সঠিকভাবে এইচআইভির উপস্থিতি শনাক্ত করা নাও যেতে পারে।

 

এইচআইভির পরীক্ষা করা হয় এমন স্থানগুলো হচ্ছে- ভাইরোলজি ডিপার্টমেন্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা। ভাইরোলজি ল্যাবরেটরি, সাইন্স ডিভিশান, আইসিডিডিআরবি, মহাখালী, ঢাকা। রেড ক্রিসেন্ট রক্তদান কেন্দ্র, ঢাকা। সকল মেডিক্যাল কলেজ সমূহ। তা ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এইচআইভির উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়।

 

এ ছাড়া নবজাতকের শরীরে এইচআইভির সংক্রামণ চিকিৎসায় রয়েছে প্রিভেনশন অব মাদার টু চাইল্ড ট্রান্সমিশন (পিএমটিসিটি) প্রকল্প। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম  মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সহযোগিতায় এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। সরকারের এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য মায়ের শরীর থেকে নবজাতকের শরীরে এইচআইভি সংক্রামণ প্রতিরোধ করা।

 

বর্তমানে তিনটি সংগঠনের মাধ্যমে দেশে এইচআইভি আক্রান্ত রোগীরা ওষুধ ও চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন। এগুলো হলো- আশার আলো সোসাইটি, মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ এবং ক্যাপ। এ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ওষুধ ও সেবা গ্রহণ অনেক সহজ ও গোপনে সম্পন্ন করা যায়।

 

এ রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন সচেতনতা ও সাবধানতা অবলম্বন। এইডস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার আগেই আমাদের তা প্রতিরোধ করতে হবে। ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধকে জোরদার করে এইচআইভি থেকে যেমন দূরে থাকতে হবে, তেমনি আক্রান্তদের যথাযোগ্য চিকিৎসার মাধ্যমে দেশকে এ ঘাতক রোগ থেকে মুক্ত রাখার প্রয়াস চালাতে হবে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ ডিসেম্বর ২০১৫/উজ্জল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়