ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

এক অস্বীকৃত বীরশ্রেষ্ঠ

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৩, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এক অস্বীকৃত বীরশ্রেষ্ঠ

শাহেদ হোসেন : যুদ্ধে যাওয়ার আগে মাকে বলে গিয়েছিলেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে স্বাধীন দেশে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।’ যুদ্ধ শেষ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মায়ের সঙ্গে দেখা করতে ফিরে আসেননি জগৎজ্যোতি দাস।

 

ভাটি অঞ্চলের এই অকুতোভয় যোদ্ধা ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম ঘোষিত এবং অস্বীকৃত এক বীরশ্রেষ্ঠ। জাতির শ্রেষ্ঠ এই সন্তানকে সর্বোচ্চ খেতাব দিয়ে কেনইবা তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো সেই রহস্য আজো অজানা।

 

১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে জন্ম জগৎজ্যোতি দাসের। ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর সুনামগঞ্জ কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউজে অবস্থান নেয় পাক বাহিনীর একটি দল। স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা সার্কিট হাউজ ঘেরাও করলে পাকবাহিনীর ওই দলটি পালিয়ে যায়। তবে ১০ মে পাকবাহিনী পুনরায় আক্রমণ করে সুনামগঞ্জ শহরসহ আশপাশের এলাকা দখল করে নেয়। পরবর্তীতে সুনামগঞ্জ থেকে ১১৪ জনের একটি দলকে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের শিলংয়ে পাঠায় স্থানীয় মুক্তিসংগ্রাম কমিটি। অকুতোভয় মানসিকতা, কঠোর পরিশ্রমী এবং ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় দক্ষতা থাকার কারণে এই দলটির নেতা করা হয় জগৎজ্যোতি দাসকে।

 

৩২ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে ১১৪ জনের এই দল তিন ভাগে ভাগ করা হয়। বাছাই করা ৪২ জন যোদ্ধাকে নিয়ে গঠিত হয় জ্যোতির দল। পরবর্তীতে এই দলটিই ‘দাস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

 

হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের সুবিশাল এলাকা ভাটি অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। সড়ক পথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের কারণে পাকবাহিনী তাদের অস্ত্র ও রশদ এই ভাটি অঞ্চলের নৌপথের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যাম্পে পৌঁছে দিত। ফলে এ অঞ্চলে নৌপথ দিয়ে প্রবেশ করা মুক্তিবাহিনীর জন্য দুরহ হয়ে পড়ে। ফলে দিরাই, শাল্লা, ছাতক, আজমিরিগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার নৌপথ পাকবাহিনীর দখলমুক্ত রাখতে পাঠানো হয় জ্যোতির দলটিকে।

 

বানিয়াচং অভিযানের পূর্বে কুশিয়ারা নদীতে পাকিস্তানিদের একটি গানবোট ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয় দাস পার্টি। ওই রাতেই মাত্র ১৩ জন যোদ্ধাকে নিয়ে বানিয়াচং থানা আক্রমণ করেন জগৎজ্যোতি। এই অভিযানে শত্রুপক্ষের ৩৫ জন প্রাণ হারায়। যুদ্ধ শেষে হস্তগত হয় ৫৩টি রাইফেল ও বিপুল পারিমাণ গোলাবারুদ। এরপর ভাটি অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক সফল আক্রমণ পরিচালনা করেন জ্যোতি। দাস পার্টির তীব্র আক্রমণের মুখে কিছুদিনের জন্য ঢাকা-শেরপুর রুট দিয়ে পাকবাহিনীর যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার রেডিওতে ঘোষণা করে এই রুট দিয়ে চলাচলকারীদের দায়দায়িত্ব সরকার নেবে না।

 

১৭ আগস্ট আজমিরীগঞ্জের পাহাড়পুরে সফল অভিযান চালায় দাস পার্টি। এরপর লিম্পেট মাইন দিয়ে ভেড়ামোহনায় একটি কার্গোবহর ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয় তারা। হাতে একটি এলএমজি নিয়ে একাই আজমিরীগঞ্জ থানা দখল করতে সক্ষম হন জ্যোতি। এখান থেকে আটক করেন চার রাজাকারকে। কোনো ধরনের গোলাগুলি ছাড়াই দিরাই-শাল্লায় অভিযান চালিয়ে কৌশলে আটক করতে সক্ষম হন ১০ রাজাকারকে । এই দলটি এলাকায় নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ ও লুটপাট চালাচ্ছিল। ২৯ জুলাই জামালগঞ্জ থানা ও নৌবন্দর সাচনাবাজার শত্রুমুক্ত করে আলোচনার শীর্ষে চলে আসেন জ্যোতি ও তার দল। জামালপুর মুক্ত করার অভিযানে হারাতে হয় সহযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামকে। একের পর এক সফল অভিযানের কারণে জ্যোতি ততদিনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সাহস ও অনুপ্রেরণার উৎস বনে গেছেন।

 

নভেম্বর নাগাদ পাকবাহিনীর কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়ায় দাস পার্টি। জগৎজ্যোতির বাহিনীকে ধরতে শেষ পর্যন্ত কৌশলের আশ্রয় নেয় পাকবাহিনী। তার অবস্থান সম্পর্কে রাজাকারদের মাধ্যমে জেনে নিয়ে তাদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে হানাদাররা।

 

রানীগঞ্জ, কাদিরগঞ্জ অভিযান শেষে দিরাই-শাল্লা অভিযান ও আশুগঞ্জ শাহাজ়ীবাজার বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে দাস পার্টি ১৬ নভেম্বর সকালে হবিগঞ্জের ভেড়ামোহনা নদীতে পৌঁছে। বদলপুর ইউপি অফিসের সামনে পৌঁছে তারা দেখতে পান ৩-৪ জন রাজাকার ব্যবসায়ীদের নৌকা থেকে চাঁদা আদায় করছে। জ্যোতি রাজাকারদের ধরে আনতে নির্দেশ দেন। দু’জন মুক্তিযোদ্ধা এদের ধরে আনতে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে রাজাকাররা পালাতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পিছু ধাওয়া না করে নৌকায় ফিরে আসেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন জ্যোতি। ‘আজ ওদের রক্ষা নেই’ বলে তিনি ১০-১২ জনের একটি দলকে প্রস্তুত হতে বলেন। সঙ্গে একটি মর্টার শেল, একটি এসএমজি ও দুটি মেশিনগান নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। সহযোদ্ধা ইলিয়াস তখন বলেছিলেন ‘পুরো শক্তি নিয়ে গেলে ভালো হতো দাদা।’ জ্যোতি তাকে বলেন, ‘তুই কিতা আমার তাকি বেশি বুঝছনি বেটা। রাজাকার মারতে কিতা তুই কামান লওয়ার কথা কছ। ইতারে শায়েস্তা করতে আমার এসএমজি অই বউত্তা।’

 

দলের সবাইকে ব্যাকআপ দেওয়ার কথা বলে এগিয়ে যায় দাস পার্টির ১২ জনের দল। রাজাকারের দল যখন নৌকা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রাশফায়ারে তখন তিনজন মারা যায়। দুইজন লাফিয়ে পড়ে পাশ্ববর্তী গ্রামে আশ্রয় নিলে তাদের উদ্দেশ্যে একটি মর্টার শেল নিক্ষেপ করে মুক্তিযোদ্ধারা। মর্টার শেলের শব্দে হানাদার বাহিনী দাস পার্টির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা ততক্ষণে বিলের মাঝখানে চলে এসেছে। পিটুয়াকান্দি, পিরোজপুর, খইয়াগুপিতে অবস্থান নেওয়া হানাদার ও রাজাকাররা এ সময় তিনদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে।

 

জ্যোতি বিলে যাওয়ার আগে নদীতে থাকা মূল দলটিকে প্রয়োজনে ব্যাকআপ দেওয়ার কথা বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু শত্রুপক্ষ তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলায় জ্যোতির দলটিকে ব্যাকআপ দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। তাই ব্যাকআপ না পাওয়ায় জ্যোতির দলটির গোলাবারুদের মজুদ কমে যায়। সামানা সামনি যুদ্ধ করতে করতে ১০০ গজের মধ্যে চলে আসে পাকবাহিনী।

 

অবস্থা বেগতিক দেখে সহযোদ্ধা ইলিয়াস জগৎজ্যোতিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী করব দাদা?’ জ্যোতি বলেন, ‘তোর যা ইচ্ছা তুই কর। পিছু হটলে কেউ রেহাই পাবে না। তারা আমাদের তিন দিকে ঘিরে ফেলেছে। যুদ্ধ করতে হবে।’ সবাইকে বাঁচাতে তার সঙ্গে থাকার জন্য ইলিয়াসকে নির্দেশ দেন জ্যোতি। বিকাল তিনটার দিকে দুটি বিমান উড়ে যায় দাস পার্টির মাথার ওপর দিয়ে।

 

এর কিছুক্ষণ পরই একটি গুলি এসে লাগে সহযোদ্ধা আইয়ুব আলীর শরীরে। গুলিবিদ্ধ আইয়ুব আলী ছটফট করতে থাকেন। তাঁকে নিয়ে ব্রাশফায়ার করতে করতে পিছু হটে দুই মুক্তিযোদ্ধা। আরেকজন তখন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়লে ১২ জনের দল এসে দাঁড়ায় পাঁচজনে। বিকেল সাড়ে ৩টায় বাম পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হন ইলিয়াস। জ্যোতি তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘কী বাঁচবি তো?’ নিজের মাথার লাল গামছা খুলে ইলিয়াসের ক্ষতস্থানে বেঁধে দেন তিনি। এ সময় সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দেন তোমরা যেভাবে পারো আত্মরক্ষা করো। আমরা তোমাদের ব্যাকআপ দিচ্ছি। একে একে সবাই চলে যান। গুলি সরবরাহকারীরাও ছোটাছুটি করতে থাকেন নিরাপত্তার জন্য। বিলের পাড়ে শুধু গুলিবিদ্ধ ইলিয়াস আর জগৎজ্যোতি। ইলিয়াসের শরীর থেকে তখনো রক্ত ঝরছে, পিছু হটারও সু্যোগ নেই। ইলিয়াস নিচু স্বরে বলেন, ‘চলো আমরা আত্মরক্ষা করি।’ তেজোদীপ্ত হয়ে বীরকণ্ঠে জগৎজ্যোতি বলেন, ‘পালাবো না, সব ক’টাকে শেষ করে তবে যাব।’ একে একে ১২ জন পাকসেনাকে একাই গুলি করে পরপারে পাঠান জগৎজ্যোতি। তার নির্ভুল নিশানার কারণে সামনের দিকে আর এগুতে পারেনি পাক হায়ানার দল। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ছে, পর্যাপ্ত গুলিও নেই। ইলিয়াস বলেন, ‘দাদা, যে পরিমাণ গোলা-বারুদ আছে বড়জোড় সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই করা যাবে।’ দু’জনে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্বান্ত নেন। অন্ধকার হলে অন্য যোদ্ধাদের নিয়ে ফের আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান দুই বীর। বিকাল ৫ টার দিকে একটি গুলি এসে লাগে জ্যোতির শরীরে। শেষ বারের মতো চিৎকার করে ওঠেন ‘আমি যাইগ্যা’।

 

ইলিয়াস পেছনে ফিরে দেখেন বিলের পানিতে ডুবে যাচ্ছে তার প্রিয় কমান্ডারের দেহ। ডুবন্ত দেহটিকে শেষ বিকেলের রক্তিম আভায় শেষবারের মতো তুলে ধরেন। কোমর পানিতে কাদার মধ্যে নিজের হাতে ডুবিয়ে দেন সহযোদ্ধার দেহ। যেন সুযোগ পেলে পুনরায় এসে লাশ তুলে নিতে পারেন। এরপরই ইলিয়াস দ্রুত পিছু হটে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন।

 

জগৎজ্যোতির মৃতদেহকেও ভয় পেয়েছিল পাক হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। তাই রাতেই তারা জ্যোতির লাশ তুলে আনে বিল থেকে। ভোর হওয়া মাত্র জ্যোতির নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে দেয় রাজাকারেরা। আজমিরীগঞ্জ বাজারে নিয়ে আসা হয় তার লাশ। জনসম্মুখে থু থু দেওয়া হয় লাশের উপর। যতো ধরনের বর্বরতা ছিল তার সবই করে তারা ওই নিথর দেহে।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের পরিণতি মানুষকে দেখাতে জ্যোতির মৃতদেহ এরপর বেঁধে রাখা হয় বাজারের বিদ্যুতের খুঁটির সাথে। তারপরও ওই মৃতদেহের ওপর আক্রোশে চালানো হয় ভয়াবহ নির্যাতন। ধারালো অস্ত্র দিয়ে তারা খোঁচাতে থাকে জ্যোতির শরীর। ক্ষতবিক্ষত করেও সাধ না মেটায় তারা এক পর্যায়ে বিবস্ত্র করে জ্যোতিকে। সেখানে লাশ ফেলে রাখা হয় আরও একদিন। তিনদিন পর রাজাকাররা জ্যোতির মৃতদেহ ভাসিয়ে দেয় ভেড়ামোহনা নদীর জলে। স্বাধীনতা যুদ্ধের এই বীর সেনানির মৃতদেহ চিরদিনের জন্য বুকে টেনে নেয় বাংলার শ্যামল নদী। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি তাঁর মৃতদেহ।

 

জ্যোতির বীরত্বগাথা আর আত্মত্যাগ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদানের  ঘোষণা দেয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সেই খেতাব আর তাঁকে দেওয়া হয়নি। বরং দেওয়া হয় বীরবিক্রম খেতাব । ঘটনার এখানেই শেষ নয়। এই খেতাবের কথা জানতেনই না জগৎজ্যোতির পরিবারের সদস্যরা। প্রায় দুই যুগ পর ১৯৯৮ সালের ৭ মার্চ  তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জগৎজ্যোতির বউদি ফনিবালা দাসের হাতে এ সম্মাননা ও ক্রেস্ট তুলে দেন।


তথ্যসূত্র :

 

অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি - অপূর্ব শর্মা

দৈনিক সমকাল ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬ সংখ্যা

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়