ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

এক পা উপরে || পঞ্চম পর্ব

হামিদ রায়হান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৭, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এক পা উপরে || পঞ্চম পর্ব

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার


|| হামিদ রায়হান ||

আমার চারপাশে বেরসিক সন্ধ্যেবেলা লটকে আছে। এমন স্বজন-বান্ধবহীন সন্ধ্যেবেলা আমি আর কখনও দেখিনি।
‘কেন এই বৃষ্টির মধ্যে আসতে গেলাম?’ মনে মনে উচ্চারণ করলাম। কিন্তু  উত্তর পেলাম না। মনে হলো, এ রকম আরও কিছু কিছু সাধ অপূর্ণ রয়ে গেছে। মনে পড়ে, এমন বৃষ্টিতে আমি ইরাদের ছাদে ভিজেছিলাম। সেই দিনটা এখনও আমার চোখের মধ্যে গেঁথে আছে। কিন্তু কোনো গাঁয়ের মাঠে, কোনো শস্যকাটা দিনে, গরু-ভেড়া চরে বেড়াবে, আর আমি এই মাঠের কোনো সুশীতল গাছের ছায়ায় সারা দিন বাঁশি বাজাব, পাশে বয়ে যাওয়া নদীর কুলকুল ধ্বনি শুনব, এ সব সাধ আমার কখনও মেটেনি। তবু কখনও-কখনও বুকের ডানা মুচড়ে জেগে ওঠে।

হঠাৎ টের পেলাম, কে যেন আমার পেছনে পেছনে ছায়ার মতো আসছে। হরিণের মতো দুটো কান মুহূর্তে খাড়া হয়ে ওঠল; সাথে জেগে ওঠল ঘুমিয়ে থাকা শিরা উপশিরা, প্রতিটি লোমকূপ। হাঁটার গতি ক্রমশ কমে গেল এবং মেয়েটির সাথে আমার দূরত্বের ব্যবধান কমে এলে, পেছনের দিকে বড় চোখ করে তাকালাম। দেখি ছাব্বিশ, সাতাশ বছরের মতো এক নারী আমার পেছনে পেছনে আসছে। সে যে আমাকে অনুসরণ করেছে তা বেশ বুঝতে পারলাম। মনে মনে হাসি পেল; কিন্তু  হাসতে পারলাম না। তবু কষ্টের হাসি মুখের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। ভেতরে লাল-নীল কৌতূহল খেলে গেল। পেছনে ফিরে আবার তাকালাম। পেছনে চোখ নিতেই, মেয়েটার চোখের ওপর চোখ পড়লে, শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। কিন্তু  হাসলাম না। মুখে কাঠিন্য আনার চেষ্টা করলাম, যাতে মেয়েটা বুঝতে না পারে তার ইশারায় আমি রাজি। মেয়েটার পরনে ঘি রঙের মেচিং করা শাড়ি, মাথার ওপর একটা কালো ছাতা।

কারও সম্পর্কে না জেনে মন্তব্য করা ঠিক নয়। মানুষের এই এক স্বভাব, কারও সম্পর্কে কিছু না জেনে চট করে জিভে যা আসে, তাই বলে বসে। মুখে কোনো কিছু বাধে না তাদের। মেয়েটা হয়ত ভালো্ও হতে পারে। তাহলে মেয়েটা আমাকে দেখে ওমন করে হাসল কেন?
মনে হতেই, মাথায় ঝিলিক খেলে গেল। আমার মতো কেরানির এ সব ভাবা ঠিক নয়। ইরা হয়ত ভেতরে ভেতরে রেগে ধৈর্যের শেষ সীমানায় আছে, এখন নিশ্চয়ই তার পাকা ডালিমের মতো ফেটে পড়ার অবস্থা। রাগ করারই কথা। কোনো স্বামী কি আমার মতো এমন রাত করে ঘরে ফেরে? জানি না।

মেয়েটা কি আমার চেনা কেউ? হয়ত আমাকে চেনা ভেবে, সে আমার পিছু নিয়েছে; কিংবা এমনও হতে পারে, সে আমার মত চেনা-অচেনা এমন অবস্থায় দোদুল্যমান। সে না পারছে বলতে; না পারছে আমার পেছন ছাড়তে। একরকম মোহ হয়ত তাকে পেয়ে বসেছে। অথবা এমন হতে পারে, এমন থমথমে একা পরিবেশে সে ভয় পাচ্ছে। কোনো জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বেরিয়েছে; চারদিকে যে অবস্থা, আর আজকাল কখন কী ঘটে যায়, তার কোনো মা-বাবা নেই। পরিস্থিতির কাছে সব মানুষই অসহায়। আমার মুখে হাসি দেখে, হয়ত সে ভদ্রতার খাতিরে সৌজন্য-হাসি বিনিময় করেছে। হঠাৎ মনে হলো, আমি বোধ হয় তাকে চিনি।
তাহলে সে কি আমার চেনা কেউ? কিন্তু কিছুই মনে করতে পারলাম না।

শরীরে কেমন হুহু করা মরুভূমির নির্জন বাতাস বয়ে যাচ্ছে। নিজেকে দারুণ একা একা লাগছে। হঠাৎ কী মনে করে জানি না, হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। পেছনে ফিরে আর তাকালাম না। তাকাব, এমন কোনো উৎসাহ পেলাম না, যেন বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত গতিসম্পন্ন ট্রেন আমি। ছুটছি তো ছুটছি। একের পর এক দৃশ্য আমার সামনে থেকে সরে যাচ্ছে। কিন্তু  উদ্বাস্তু ভাবটা কাটছে না। ছায়ার মতো পেছনে লেগে রয়েছে। মনে পড়ে, যুবক তখনও আমি রাজধানীতে পা রাখিনি, মফস্বল শহরে পড়ছি, সে সময় ঘরের দেয়াল ঘড়িটার শব্দ আমি কোনো সময় খেয়াল করে শুনতাম না; কিন্তু  সারা বাড়ি নির্জন হয়ে এলে কিংবা গভীর রাতে হঠাৎ শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে, রুমের এদিক-ওদিক তাকাতাম। এ রকম অদ্ভুত আওয়াজে চমকে উঠতাম। ভাবতাম কিসের শব্দ, কোনো খারাপ কিছুর সংকেত না তো? গায়ের প্রতিটা লোম সজারুর কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে যেত মুহূর্তে। ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়ে যেত এক ধরনের। হঠাৎ চোখ পড়লে ঘড়ির ওপর, বুঝতে পারতাম, এটা ঘড়ির শব্দ। আর কোনো কিছুর নয়। প্রথম দিন তো ভয়ে একেবারে বরফ হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর আর কোনো ভয় থাকল না, ভয়ের শব্দের সাথে পরিচিত হয়ে গেলাম। আজ তেমনি, সেই প্রথম দিনের মতো হঠাৎ নির্জন নিঃশব্দ হয়ে গিয়ে, আমি সেই দিনের ভয়ের মতো ভয়ংকর, যন্ত্রণা-কষ্ট অনুভব করলাম। বিষণ্নতার মধ্যে দিয়ে আমি হঠাৎ আমার অদূরে এসে থেমে যাওয়া গাড়ির দরজায় পা রাখলাম, ইরার উদ্দেশে। মেয়েটা গাড়িতে উঠতে পারছে কিনা, কোনো কিছু খেয়াল করলাম না কিন্তু  ওর জন্যে এক আশ্চর্য কষ্ট ঠাণ্ডাস্রোতের মত সারা শরীরে বয়ে গেল।

বাস যাচ্ছিল দ্রুতগতিতে। কোথাও কোথাও যাত্রী নামিয়ে দিলেও মুহূর্তে আবার সেই গতি। বাসটা লক্কর-ঝক্কর মার্কা না হলেও খুব একটা ভাল ছিল না এর বডি। হয়ত ইঞ্জিনটা ভালো ছিল। এর জংধরা, লোহালক্কড়ের শব্দ, টিনের শব্দ আর ঢিলেঢালা নাটবল্টুর শব্দ, সিটের ঝাঁকুনি, অবিরাম আমার শরীরের মধ্যে থেকে উঠে আসতে থাকে। হঠাৎ উল্টোমুখি বাসের ভৌতিক জানালায় কার হিম হাত ছুঁয়ে যায়। কার কাছে বাইরের অন্ধকার প্রকৃতির বিকৃত দোমড়ানো মোচড়ানো প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেই চোখের নিমিষে মিলিয়ে গেল।

আকাশে একটা চাঁদ চোখে পড়ে। এই চাঁদ দেখার জন্য কতদিন আমার আর ইরার মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়েছে, আর কতদিন আমি-ইরা, শুধু দুজন, ওদের বাড়ির ছাদে উঠে এই চাঁদ দেখেছি। স্বপ্নের বিনি সুতোর মালায় আমরা কত ফুল গেঁথেছি। পূজোর সব ফুল বাসি হয়ে ঝরে গেল কবে, মনে পড়ে না। আগে যখন এই চাঁদ কখনও আমার চোখে পড়ত, তখন একেই আমার ইরা মনে হতো। ইরাকে এই কথা বলতাম; ইরা তো আমার কথা শুনে, হেসে কুটিকুটি- ‘তুই না একটা...’। ইরা কখনও বাক্যটা শেষ করতো না। সে ইচ্ছে করেই শেষ করত না, না এমনিতে করা হতো না, এটা আজও আমার কাছে রহস্য হয়ে আছে। মেয়ে মাত্রই রহস্যময়ী। রহস্য করতে তারা ভালোবাসে।

‘কি!’ ওর কথায় বলতাম আমি। আর হা করে তীর্থের কাকের মতো ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম; কিন্তু  উত্তর আমার কোনো দিনও পাওয়া হতো না। ও আমার কথায় হাসত আর হাসত; এবং হঠাৎ থেমে, ‘আমার মাথা’, বলেই আবার হাসিতে ফেটে পড়তঅ
দ্বিতীয় পর্বের হাসির গতি প্রথমটার চেয়ে বেড়ে যেত। আমিও বোকার মতো ওর দিকে চেয়ে থাকতাম এবং তিমি মাছের মতো বিশাল হা করে; শারীরিকভাবে না হলেও যেন অলৌকিকভাবে ওর সৌন্দর্য পিপাসার্ত মানুষের মতো পান করতাম। হঠাৎ যখন ওর চোখ পড়ত আমার দিকে, হাই স্পিডের গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষলে যে অবস্থা হয় ইরার সে-রকম হতো। তখন গম্ভীর করে বলত, ‘এই, এসব কী হচ্ছে!’
তারপর আমাকে হালকাভাবে ধাক্কা দিয়ে বলত,‘ এখনই এই অবস্থা! আর না জানি...’
সে আর উচ্চারণ করত না। এ পর্যন্ত বলেই আমার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকত।
‘কী!’ ওর চোখে চোখ রেখে আমিও বলতাম।
‘বোকা কোথাকার।’বলেই ও হাসিতে লুটিয়ে পড়ত। আমিও ইরার সঙ্গে যোগ দিতাম। আরও ঘনিষ্ঠ হতাম। ওর আঙুল নিয়ে খেলতে খেলতে হঠাৎ ইরার মুখের কাছে মুখ এনে সুযোগ বুঝে ঠোঁটে চুমু এঁকে দিতাম। ওর মসৃণ লাল মুখটা আরও লাল হয়ে উঠেছে, বেশ বুঝতে পারতাম।

স্মৃতিগুলো মনে হতেই, হো হো করে হেসে উঠলাম রাতে পাওয়া মানুষের মতো। রাস্তা জনমানবহীন হলেও দু’একজন লোকের আসা যাওয়া চোখে পড়ে। ওদের কেউ কেউ আমার দিকে ঘুরে ফিরে তাকায়। কেউবা আড়চোখে। কেউবা আবার বড় চোখ করে-বুঝতে পেরে আমি দ্রুত বাসার দিকে পা বাড়ালাম।

একটু রাত করেই মুরগির খুপরির মতো ছোট্ট বাসায় ফিরলাম আমি। দরজা খুলে দিতে দিতে ইরা অস্পষ্ট, যেন স্বপ্নের মাঝে থেকে কথা বলছিল, হয়ত এ সময় সে একটা স্বপ্ন দেখছিল, ওর কথায় জড়ানো ভাব। আমি ইরা যেরুমে থাকি, সেখানে পা রাখতেই চোখে পড়ল দেয়ালের ক্যালেন্ডারে দূর সূর্যাস্তের দিকে একটা বহমান নৌকার ছবি, আর নৌকার দুপাশে গর্ভবতী শস্যের সবুজ সমাহার। পরিচিত অপরিচিত মানুষের কোলাহল থেকে এসে বাসার দরজায় পা দিয়ে আমি নিজেকে আলাদা অনুভব করলাম। একটা ব্যাখ্যাহীন গভীর কিন্তু  লক্ষ্মী প্রতিমার সুন্দর সুখানুভূতি আমার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে।
ইরা আমার পেছনে। ও প্রথমেই প্রয়োজনীয় কথা কয়েকটি বাক্যে শেষ করে ফেলেছে। এখন ও শব্দহীন। জনমানবহীন নীরব নদীর মতো।

‘ভাত খেয়েছ?’জিজ্ঞাসা করলাম।
ইরা চুপ। কোনো কথা বলে না। আড়চোখে ওর দিকে তাকালাম, ওর মুখে সর্বত্র অভিযোগের ছাপ আকাশে জমে ওঠা কালো মেঘের মতো লেপ্টে আছে, এখনই বুঝি মুষলধারে বৃষ্টি হবে। ভেতরে প্রচণ্ড ধাক্কা লাগে। ঢালু রক্তক্ষরণের তুমুল কালোস্রোত। আমার প্রতি ওর অভিযোগ আছে ঠিক কিন্তু  কী গভীর ভালোবাসা আমার প্রতি ওর! অনেক দিন বলেছি, আমার জন্যে অপেক্ষা করার দরকার নেই। তুমি সময়মত খেয়ে নিও। আমার কি ফেরার ঠিক ঠিকানা আছে! না খেয়ে খেয়ে শরীরের কী শ্রী বানিয়ে বসেছ, সে দিকে কি কোনো খেয়াল আছে উনার।’বলে থামলাম। তারপর ওর দিকে তাকালাম, কী তার অনুভূতি, হাবভাব বোঝার জন্য।

ও আমার কথায় চোখ তুলে আমার দিকে ভাবলেশহীনভাবে তাকাল। আমি তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিলাম অন্যদিকে। ‘যখন একটা কিছু বাধিয়ে বসবে, তখন বুঝবে, নিজে কষ্ট পাবে, এতে আমার কি।’ দম নিয়ে চারদিকে পরিবেশ বুঝে কথাগুলো বললাম।
এতেও ওর কোনো ভাবান্তর হলো না। ও শব্দহীন। চরের থৈ থৈ নীরব সমুদ্রের মতো। ওর নীরব ভূমিকায় নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো। কোনো রকম উচ্চারণ ছাড়া সামনে এগিয়ে খাটের ওপর বসলাম।
‘গায়ের কাপড় ছেড়ে এসো খাবে; আমি ভাত বাড়ছি’ বলে ও রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। যাওয়ার সময় আলনা থেকে লুঙ্গি-গামছা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল।
আমি একবার অপেক্ষায় ছিলাম। দু’জনের কেউ কথা বলছিলাম না, এতে সারা রুমটা যেন গমগম করছিল স্তব্ধতায়। ও কথা বললে, সারা রুমটা যেন হেসে ওঠে, বাসার বালিশ, আলনা, কাপড়-চোপড়, চেয়ার-টেবিল, সব- সব কিছু যেন মাঘের সকালের রৌদ্রের মতন কোমর দুলিয়ে জেগে ওঠে।
হাত মুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে নিতে নিতে ধীরে ধীরে আমি স্বাভাবিক বোধ করলাম। ইরা খেতে বসলে দু’একটা কথা বললাম আমি।
তারপর কী কথা হলো সব ভুলে গেলাম।

খাটের ওপর বিছানায় শুয়ে আমি দেখলাম, ইরা আমাকে কিছুটা দূরত্বে রেখে শুয়ে পড়বার পূর্বে ডিমলাইট জ্বেলে মশারির মাঝে মশা আছে কিনা দেখছে। এক সময় লাইট নিভিয়ে দিলে এবং রুমটা অন্ধকার হয়ে গেলে আমি চোখ বুজবার আগে ওকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘শুনছ, ইরা?’
ইরার মেজাজ আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। ঠিক আছে বুঝে আবার শুরু করলাম, ‘বুঝলে ইরা, ঠিক করেছি, এবার বছরের প্রথম দিকে আমরা দু’জন ঢাকার বাইরে অন্য কোথাও বেরিয়ে আসব। অবশ্য, এবার বছরের শেষের দিকে কিছু বোনাস পাব। তুমি কি বলো?’ বলে জবাবের জন্য ওর দিকে ফিরে তাকালাম।
‘সময় হলে দেখা যাবে।’ বলেই ইরা চুপ করে গেল। কথার যে ধরন, আমিও আর এগোনোর সাহস পেলাম না।

অনেক রাতে কী একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল আমার। কিছুক্ষণ আমি কোথায় কীভাবে আছি না বুঝে মশারির দিকে বোবার মতো চেয়ে রইলাম। পাশে ইরা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ওর একটা হাত আমার বুকের ওপর। মাথার ভেতরে একটা সচল করাতের শব্দ ঘুরে ঘুরে চলতে থাকে। আমি টের পেলাম আমার হাত-পা, মাথা, শরীর, সব ভয়ংকর অদ্ভুত ভঙ্গিতে ছড়ানো, ছিটানো; এবং চিৎ হয়ে শোয়ানো, দুটো হাত বুকের ওপর। কারও যেন চোরাবালিতে পরিত্যক্ত নির্জনের একটা ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে রেখে আমার জন্যেই কেবল অপেক্ষা করছিল; আর আমি গলির সেই তিমি হাঁ-করা ম্যানহোলের দিকে পা বাড়িয়ে হঠাৎ কী তুমুল আকর্ষণের কোনো এক ফাঁকে শূন্যতা ও সময়হীনতার মাঝে গড়িয়ে পড়লাম। আর একটা দুঃস্বপ্নে আমার ভেতরের ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল শুয়ে গেল। বৃদ্ধ নাবিক নই, তবু গল্পের সেই বিখ্যাত বৃদ্ধ নাবিকের মতো বেকায়দা অবস্থায় পড়লাম যেন। বিশাল সমুদ্র। এর মাঝখানে আমি আর আমার সাথী বন্ধুরা। ঈশ্বর প্রদত্ত পাখিকে মারার দায়ে আমার সাথীরা অনাহারে, রোগে মারা গেছে। পাখি ও সাথীদের অভিশাপে শুধু আমি একা-এই অকূল সমুদ্রে বেঁচে আছি। আমার চারদিকে সমুদ্রের হিমালয় সমান উথাল-পাতাল করা ঢেউ আছড়ে পড়েছে। প্রতিটা  ভেঙে আসা ঢেউয়ের সাথে পেন্ডুলামের মতো হৃৎপিণ্ডটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। সাথীদের মৃতদেহের দুঃসহ বিশ্রী গন্ধে নৌকার পরিবেশ ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছে। নাভিশ্বাস ফেটে পড়ে। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি গ্রীষ্মের ফেটে যাওয়া শস্যহীন মাঠের বুকের মতো চৌচির। সারা শরীর ডিমের শাদা অংশের মতো হয়ে যাচ্ছে। পেটটা পিঠের সঙ্গে লেগে যাচ্ছে। খাবার যা ছিল, সব ফুরিয়ে গেছে। খাবারপাত্র খাঁ খাঁ করছে শূন্যতায়।

 ‘অসহ্য আর থাকা যাচ্ছে না।’ মনে মনে বললাম- ‘এখন কী করব? এবার বুঝি, অন্যায়ভাবে জীবহত্যার কী ফল?
প্রায়শ্চিত্তের কি আরও বাকি আছে?’
‘অপেক্ষা করো।’ একটা কণ্ঠ ভেসে এলো দূর থেকে।
‘আর সহ্য হচ্ছে না। এভাবে কী বাঁচা যায়?
‘না।’
‘তবে?’
‘খুব সোজা। পথ খুঁজে বের করো।’
‘কীভাবে?’
‘চিন্তা করো।’
‘মাথার মাঝে এক হাজার একটি মৌমাছি উড়ছে।’
‘উড়ুক।’
‘আমাকে মৃত্যু দাও।’
‘না।’
‘কেন?’
‘তোমার প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করো।’
‘তাহলে মোকাবেলার অবলম্বন দাও।’
‘না।’
‘আমি নাবিক, আমি কারও দাসত্ব মানি না, করি না। যে কোনো পরিস্থিতিকে কেবল সাহসী মানুষেরা মোকাবেলা করতে জানে। সব বাধাই তাদের কাছে তুচ্ছ। পথ চলাতে তাদের আনন্দ। পথ চলতে তারা ভালবাসে। ফেরার অভ্যাস নেই। ও আল্লাহ, আমার সাথে তোমার এ কী ছলনা! এখন কীভাবে বুকের জ্বালা মেটাই।’
‘মেটাও, তোমার কাছে তা আছে।’
‘কী?’
‘পায়ের কাছে দ্যাখো।’
‘কই, কিছুত দেখতে পাচ্ছি না।’
‘ভালো করে দ্যাখো।’
‘কই, একটা ধারালো ছুরি ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’
‘আর কিছুর দরকার আছে?’
‘মানে, আমি আত্মহত্যা করব!’
‘এরচেয়ে ভাল আর কি আশা করো?
মরা পচা দুর্গন্ধ কীট পোকা ক্রমশ আমার দিকে লাল হিংস্র বন্য পিপীলিকার মতো এগিয়ে আসছে। যেন অনেক দিন ধরে এরা ক্ষুধার্ত, আমার সাহসহীন অস্থি মজ্জা খেয়ে এদের ক্ষুধা মেটাবে। কিন্তু  আমার আর মরা হলো না। খুব বেঁচে গেলাম আমি।

ঠিক সময়ে ঘুম না ভাঙলে সেই গর্তে, অন্ধকারে, পচা গন্ধে নগণ্য জীবের মতো মৃত্যু হতো নির্ঘাৎ আমার। ধীর গতিতে ঘূর্ণায়মান ফ্যানের বাতাসের মাঝেও সারা শরীর জবজব করে তেল দেয়ার মতো ঘামে চকচক করছে। অস্থিরতা টের পেয়ে উঠে বসলাম আমি।
‘ইরা ও ইরা।’অচেনা গলায় ডাকলাম।
কোনো উত্তর পেলাম না। সারা রুমে আশ্চর্য নীরবতা ছাপিয়ে আছে।
‘ইরা, ইরা’ আবার ডাকলাম রুমের নীরবতা ভেঙে। এবার গলার স্বরটা পূর্বের চেয়ে গম্ভীর শোনাল।
কিন্তু  কেউ জাগল না। কারও জেগে উঠবার শব্দ আমার শুনতে ইচ্ছে করছিল। কারও মানে ইরা। ইরা জাগল না। ওর দিকে তাকালাম। আহা! বেচারি, কী সুন্দর ঘুমাচ্ছে। আলোহীন অন্ধকারে ওর ঘুমটা স্পষ্ট দেখতে পারছি না। তবে উপলব্ধি করতে পারছি। ইচ্ছে করছে, ওর কপালে একটা প্রগাঢ় চুমু এঁকে দেই। মুখটা নিয়ে গেলাম ওর কপালের কাছে। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস মৃদু লয়ে ওঠা-নামা করছে। ও ঘুমিয়ে থাক। এখন ঘুমন্ত অবস্থায় ওকে বেশ লাগছে। তাছাড়া শুধু শুধু এখন ওকে জাগিয়ে লাভ কী? চুমু দিতে গিয়েও মুখটা সরিয়ে আনলাম। (চলবে)

 


রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়