ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

এক রাতে কাছারি বাগানে || ইবনুল কাইয়ুম

ইবনুল কাইয়ুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫০, ২৭ জুন ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এক রাতে কাছারি বাগানে || ইবনুল কাইয়ুম

প্রতীকী ছবি

নাহার টকিজে দারুন এক সিনেমা এসেছে। যেরকম নাচ-গান, সেরকম নাকি ফাইটিং। একেবারে মারমার কাটকাট অবস্থা! কাতাড়ের মুখে সিনেমার এমন আকর্ষণীয় গল্প শুনে নিজেকে স্থির রাখা খুব মুশকিল হয়ে গেলো জাহাঙ্গীরের। এ সিনেমা তাকে দেখতেই হবে। যে করেই হোক।

 

জাহাঙ্গীরের সিনেমার নেশা আছে সেটা জানে কাতাড়ে। সে নিজেও সিনেমাটি দেখেনি। লোকের মুখে শুনে আর কল্পনার রং লাগিয়ে বাড়িয়ে বাড়িয়ে জাহাঙ্গীরকে শোনাতে তার ভালই লাগে। গল্প শুনতে শুনতে কেমন মুখ হা হয়ে যায় জাহাঙ্গীরের। সেটা দেখে দারুন মজা পায় কাতাড়ে।

 

সিনেমা দেখতে চাইলেই তো আর হয় না। টিকিটের টাকা জোগাড়ে খুব সমস্যা। চাইলে কেউ দেবে না। অনোন্যপায় হয়ে তাই বিকল্প পথ খুঁজতে থাকে জাহাঙ্গীর। হঠাৎ করে দেখা গেলো বাড়ির মুরগীগুলো আর ডিম পাড়ছে না। তাহলে ডিম যাচ্ছে কোথায়? অন্য কোথাও ডিম দিচ্ছে মুরগীগুলো! জাহাঙ্গীরের মা সচেতন হয়ে ওঠে। নিজের মুরগীর ডিম সে ভালই চেনে। খুঁজতে খুঁজতে একদিন গ্রামের শেষ মাথায় মোকছেদের মায়ের দোকানে পাওয়া গেলো তার মুরগীর ডিম!

 

ততদিনে সিনেমার টিকিটের টাকা হাতে চলে এসেছে জাহাঙ্গীরের। সন্ধ্যায় ছেলেকে এক হাত নেবে বলে মুখিয়ে আছে জাহাঙ্গীরের মা। কিন্তু কোথায় সে? বাড়ির সবাই খেয়ে দেয়ে ঘুমাতে গেছে। তবু দেখা নেই ছেলের। ভালই হয়েছে, আজ ভাতের বদলে প্যাদানি জুটত ওর কপালে। গজ গজ করতে করতে ঘুমাতে যায় জাহাঙ্গীরের মা।

 

রাত নটা থেকে বারোটার শো দেখবে বলে ঠিক করে রেখেছে জাহাঙ্গীর। তবু নিজেকে স্থির রাখতে পারেনি বলে আগেই চলে এসেছে। সিনেমা হলের আশপাশে ঘুরঘুর করে সে। বিভিন্ন সিনেমার পোস্টার দেখে। বাদাম-চানাচুর ওয়ালার হাঁক ডাক শোনে। খেতে মন চায়, তবু নিরুপায়। পয়সা কম।

 

সে একা আসতে চায়নি, সঙ্গে কাতাড়েকেও নিতে চেয়েছিল। তবে কাতাড়ে বলেছে নিজের খরচে সে একই সিনেমা দুবার দেখবে না। তাকে দেখাতে হবে। তখন জাহাঙ্গীর বাধ্য হয়ে একা আসে। একজনের পয়সা জোটাতেই তার কাহিল অবস্থা, সেখানে আবার আরেকজনের খরচ সে কিভাবে বহন করবে! বাধ্য হয়েই সে একা এসেছে। ওদিকে কাতাড়ে মনে মনে খুব আশা করেছিল জাহাঙ্গীরের খরচে সিনেমাটা দেখবে। তা আর হলো না। দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে নিজেকে সান্তনা দেয়, জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে গল্পটা পরে শুনে নেবে।

 

রাতে সিনেমা দেখে ফিরছে জাহাঙ্গীর। সঙ্গে বেশ কয়েকজন ছিল। তবে কাছারি বাগানের কাছাকাছি এসে সবার পথ আলাদা হয়ে গেল। আজ ওদের গ্রাম থেকে কেউ আসেনি। এতো রাতে বাগানে ঢুকতে গলা শুকিয়ে যায় জাহাঙ্গীরের। কিন্তু কিছু করারও নেই। বাড়ি ফিরতে হলে এ পথ দিয়েই তাকে যেতে হবে।

 

এখানে নাকি জমিদারেরা অনেক মানুষকে মেরে পুঁতে রেখেছিল। তাই নিয়ে অনেক ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। অবশ্য এখন আর ওসব মনে করতে চায় না সে। তাই বললে চলে? দুরু দুরু বুকে বাগানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরে যেনো জয় ঢাক বাজতে থাকে। বুকের খাঁচার সাথে হৃদপিণ্ডের বাড়ি যেনো ড্রাম বাজাচ্ছে। সেই শব্দ তার কানে আসছে। কেমন যেনো ধক ধক দ্রিম দ্রিম।

 

এখন তার আফসোস হয়, কেনো সে ছয়টা-নয়টা দেখল না। ইশ একজনও যদি থাকত সঙ্গে! তাহলে আর এই নিকষ কালো রাতে একা একা বাড়ি যেতে হতো না। সারা পথে তার কোনো ভয় নেই ভয় শুধু এই কাচারি বাগানে। জমিদারদের কাচারি বাড়ি ছিল এখানে। এখন আর নেই। আছে কেবল বাগান আর নানা ভৌতিক গল্প।

 

সিনেমার কথা মনে হয় তার। কাতাড়ের খবর আছে। ধাপ্পা মারার আর যায়গা পায়নি হারামিটা। যেমন যেমন বলেছে তেমন তেমন মোটেও নয়। সিনেমার কাহিনি মনে আসতে তার ভয় কিছুটা কমে আসে। তবে সরসর করে ঝোপের ভিতর থেকে একটা শব্দ হতেই আবার তার মনে ভয়ের স্রোতটা ফিরে আসে।

 

দোয়া দুরুদও মনে আসছে না ঠিক মতো। কি নিকষ কালো অন্ধকার। নিজের হাতটাও দেখা যায় না। হঠাৎ কাছে কোথাও কে যেনো গুনগুনিয়ে গান গেয়ে ওঠে। ভয়ে একটা হার্টবিট মিস করে সে। তবে সাহসে ভর করে বলে ওঠে, ‘কে, কে ওখানে?’ ‘আমি’ জবাবটা একটা ঠান্ডা বাতাসের মতো ভেসে এলো। ‘আমি অতুল বৈরাগি।’ আবার বললো লোকটি।

 

জবাব শুনে জাহাঙ্গীরের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। ‘আমি’ শব্দটার মধ্যে কি যেনো আছে। লোকটির গাওয়া গানের সুরটা পরিচিত মনে হয় জাহাঙ্গীরের। আরে, যে সিনেমাটা সে দেখে এলো এটাতো সেই সিনেমারই গান। তবে লোকটাও মনে হয় তার মতো সিনেমা দেখে ফিরছে। সাহস ফিরে পায় সে।

 

জাহাঙ্গীর বলে, ‘সিনেমা দেখে ফিরছেন বুঝি? আমিও দেখলাম, খুব ভালো না হলেও বেশ লেগেছে, তাই না?’ সমর্থনের আশায় সে চুপ করে থাকে। লোকটি বলে, ‘তা বেশ। তা আপনি যাবেন কোথায়? এতো রাতে এই বাগানে ঢোকা কি ঠিক হলো ভাই?’ জাহাঙ্গীর তার গ্রামের নাম বলে। শুনে লোকটি বলে, ‘হুম তাতো ঠিক। এ ছাড়া ওখানে যাবার আর তো কোনো পথও নেই। আমিও ওদিকেই যাবো। বেশ হলো, দুজনে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।’

 

মনে মনে খুশি হয়ে ওঠে জাহাঙ্গীর। চেহারা না দেখা গেলেও যে একজন সঙ্গী পেয়েছে তাতিই খুশি সে। হঠাৎ তার বিড়ির কথা মনে হয়। আরে, এতক্ষণ মনে আসেনি কেনো? ভেবে নিজেই অবাক হয়। ট্যাক থেকে বিড়ির প্যাকেট আর দেশলাই বের করে সে। লোকটিকে একটা বিড়ি সাধে। লোকটি বলে সে বিড়ি খায় না। একটা বিড়ি মুখে দিয়ে ফস করে দেশলাই জ্বালে জাহাঙ্গীর। সাথে সাথে আশপাশে একটা ঝড়ের মতো বয়ে যায়। বেশ অবাক হয় জাহাঙ্গীর। আশপাশে তাকিয়ে কি ঘটল বোঝার চেষ্টা করে সে। তবে অতুলকে কোথাও দেখতে পায় না। সে অতুলের নাম ধরে ডাকে। ম্যাচের আগুনের আলোর সীমার বাইরে একটু দূরে ঝোপের মধ্যে থেকে অতুলের কণ্ঠ ভেসে আসে।

 

আগুন নিভে গেলে কাঠিটি হাত থেকে ফেলে দেয় জাহাঙ্গীর। তার পর বিড়িতে কষে একটা সুখটান দেয়। লাল আগুনের আভায় তার মুখটি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সেই আলো ভেদ করে অনেকগুলো লাল চোখের মতো আলো দেখতে পায় সে। তবে তা মুহূর্তের জন্য। আবার দেখা যায়, আবার মিলিয়ে যায়। জাহাঙ্গীর ভাবে এটা হয়ত জোনাকির আলো। তবে সেতো সবুজাভ হবে আর এতো বড়ও হওয়ার কথা নয়।

 

অতুলের কথায় হুশ হয় তার। আবার কাছে চলে এসেছে কণ্ঠটা। সে বলে, ‘এই বাগানে কত গাছ, আরো যে কত কি আছে- কে তার হিসেব রাখে। তুমি সে কথা জানো তো?’ ‘কোন কথা?’ জাহাঙ্গীর জিজ্ঞেস করে। ‘আরে সেই যে, জমিদারদের অত্যাচারের কথা। এই বাগানে কত জনকে ধরে নিয়ে এলো। আর তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। তারা এখন কোথায় আছে জানো?’

 

‘ধূর ওসব কথা এখন বলো না তো অতুল দা। ভয় করে।’ বিড়িতে টান দেয় সে। অতুলের হাসির শব্দ ভেসে আসে বেশ দূর থেকে। হাসিটা কেমন যেনো, গায়ে কাঁটা ধরিয়ে দেয়। বিড়ির আগুনের আভা কমে এলে আবার তার কণ্ঠস্বর কাছে পাওয়া যায়। একবার কাছে, একবার দূরে, একবার সামনে একবার পেছনে। এভাবে নানা যায়গা থেকে অতুলের কণ্ঠ পাওয়া যায়। জাহাঙ্গীর ওসব নিয়ে ভাবে না। সে গল্প করে যেতে থাকে।

 

বাগানের শেষ প্রান্তে এসে আরো ঘন ঘন ঘটতে থাকে এই ঘটনা। আশপাশে কারা যেনো ফিসফিস করে ষড়যন্ত্র করছে। অনেকে এক সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে, দৌড়াচ্ছে, পড়ে গিয়ে আবার উঠছে। ঝোপের সঙ্গে বাড়ি খাচ্ছে, দুদ্দাড় শব্দ হচ্ছে। অতুল দা বলে ডাক দেয় জাহাঙ্গীর। অনেক দূরে তার গলা পাওয়া যায়। কণ্ঠ শুনে মনে হয় সে কারো সঙ্গে লড়াই করছে। পরক্ষণেই আবার মনে হয় কাছাকাছিই আছে।

 

কিছু একটা আঁচ করে জাহাঙ্গীর। আবার একটা বিড়ি বের করে সে। ফস করে ম্যাচ জ্বালায়। নিকষ অন্ধকারে ম্যাচের আগুনের আলো তীব্র ছুরির ফলার মতো আঘাত হানে। মুহূর্তে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে স্বস্তিদায়ক আলো। তবে আশপাশ দিয়ে রীতিমতো ঝড় বয়ে যায় তার। জ্বলন্ত কয়লার মতো কয়েকশ জোড়া চোখ দূর থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। অবশ্য সেগুলো তার চোখে পড়ে না। ‘জলদি পা চালাও হে, বাগানের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। আর একটু গেলেই আর কোনো ভয় নেই।’ অতুলের কথায় চমক ভাঙ্গে তার। জোর কদমে পা চালায় সে।

 

‘কি হয়েছে তোমার? ওরকম ছুটোছুটি করছিলে কেনো?’ জাহাঙ্গীর জিজ্ঞেস করে। ‘ওদের সঙ্গে একটু লড়তে হলো আজ। যা পাজি হয়েছে একেকটা। কথা শোনে না। অনেকদিন পরে তো... দিয়েছি কয়েকটাকে টেঁসে...’ আচমকা থেমে যায় সে। কেমন যেনো হাঁপাতে থাকে। ফোস ফোস শব্দ পায় জাহাঙ্গীর। সে বলে, ‘কাদের সাথে লড়তে হলো? কি বলছ এসব?’ কোনো জবাব দেয় না অতুল, কেবল হাসে।

 

সে রাতে জাহাঙ্গীরকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যায় অতুল। যাওয়ার আগে বলে যায়- রাতে আর যেনো সে একা একা ওই পথে চলাচল না করে। তার সাবধান বাণী মাথায় নিয়ে বাড়ি ঢোকে জাহাঙ্গীর। খালি পেটে আর শ্রান্ত দেহে সহজেই ঘুমিয়ে পড়ে সে।

 

সকালে উত্তেজিত কথাবার্তা শুনে ঘুম ভাঙে জাহাঙ্গীরের। কাচারি বাগানে অনেকগুলো কাক মরে পড়ে আছে। এটাই সবার আলোচ্য বিষয়। এতো কাক নাকি এর আগে তাদের এলাকাতে কখনো একসঙ্গে দেখাই যায়নি।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৫/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়