ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কবিগুরু যেভাবে নোবেল পেয়েছিলেন

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১২ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কবিগুরু যেভাবে নোবেল পেয়েছিলেন

অলংকরণ : নাজিব তারেক

তাপস রায় : সুখে-দুঃখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরদিনই অনুদ্বিগ্নমনা। এমনকি নোবেল পুরস্কারের সংবাদ শুনেও তিনি কোনোরূপ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন নি। তিনি যেন অপ্রমত্ত।

 

১৫ নভেম্বর ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেলপ্রাপ্তির খবর শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছে। প্রমথনাথ বিশী সেদিনের বর্ণনায় লিখেছেন: ‘একদিন সকালে শান্তিনিকেতনের ছাত্রেরা রান্নাঘরে খেতে বসেছে, এমন সময় শিক্ষক অজিতকুমার চক্রবর্তী উচ্ছ্বাসে ছুটি এসে বললেন, গুরুদেব নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন!

 

শুনে এ নিয়ে নানারূপ গবেষণা শুরু হলো। একজন বলল, গুরুদেব Noble অর্থাৎ মহৎ। আরেকজন বলল, গুরুদেব Novel অর্থাৎ উপন্যাস লিখেছেন, তাই পুরস্কার পেয়েছেন।

 

যাই হোক, টেলিগ্রাম এসে যখন পৌঁছল, কবিগুরু তখন আশ্রমের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কথা বলছিলেন। টেলিগ্রামটি পড়ে তিনি একজনের হাতে দিয়ে বললেন, নেপালবাবু, এই নিন আপনার ড্রেন তৈরি করবার টাকা। পাঠককে এই অবসরে জানিয়ে রাখি, শান্তি নিকেতনে তখন অর্থের বেজায় টানাটানি চলছিল।  

 

এবার কবির নোবেল জয়ের গল্পটা বলি। এ কথা আজ সবাই জানেন, ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পান। কিন্তু একে ‘গীতাঞ্জলি’র হুবহু অনুবাদ বলা যাবে না। কারণ ‘গীতাঞ্জলি’ থেকে ৫৩টি গান; পূর্ববর্তী দশকে কবির লেখা ‘গীতিমাল্য’ থেকে ১৬টি, ‘নৈবেদ্য’ থেকে ১৬টি, ‘খেয়া’ থেকে ১১টি, ‘শিশু’ থেকে ৩টি এবং ‘কল্পনা’, ‘স্মরণ’, ‘চৈতালী’ ও নাটক ‘অচলায়তন’ থেকে একটি করে কবিতা নিয়ে ইংরেজিতে বইটি প্রকাশ করা হয়।

 

১৯১২ সালের ১২ জুন কবি লন্ডন পৌঁছান। বিলেত যাওয়ার সময় তিনি ‘গীতাঞ্জলি’র বেশ কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। লন্ডনে পৌঁছে সেগুলো রোটেনস্টাইনকে পড়তে দেন। রোটেনস্টাইনের মাধ্যমে কবিতাগুলো আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের কাছে পৌঁছালে কবিতাগুলো পড়ে তিনি মুগ্ধ হন। পরবর্তীতে আগ্রহী হয়ে ইয়েটস সং অফারিংসের ভূমিকা লিখে দেন। এটিই গীতাঞ্জলির ইংরেজি নাম।

 

১৯১২ সালের ১ নভেম্বর রোটেনস্টাইনের উৎসাহে ইংরেজিতে ‘সং অফারিংস’ নামে লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে মাত্র সাড়ে সাতশ কপি বই প্রকাশ করা হয়। ১৯১৩ সালের মার্চে ম্যাকমিলান বইটি প্রকাশ করলে নোবেল পাওয়ার আগেই বইটির ১০টি সংস্করণ বের হয়। ১৯১২ সালের ১৬ জুন লন্ডনে রেলস্টেশন থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে যায়। অনেক চেষ্টার পর সেই পাণ্ডুলিপি ফেলে যাওয়া মালামালের অফিস থেকে উদ্ধার করা হয়।

 

ভাগ্যিস সেটি পাওয়া গিয়েছিল। নেইলে বাঙালি লেখক-কবির কপালে নোবেল অধরাই থেকে যেত। যাই হোক, এবার এটুকু জানিয়ে রাখি, নোবেল পুরস্কার নিতে কবি সুইডেন যাননি। কর্তৃপক্ষ মেডেল ও ডিপ্লোমা তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের কাছে পাঠিয়ে দেয়। ১৯১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি লাট সাহেব কলকাতায় লাটভবনে এক অনুষ্ঠানে নোবেল পুরস্কারের স্মারকগুলো কবির কাছে হস্তান্তর করেন। 

 

এবার এই ‘গীতাঞ্জলি’ নিয়ে একটি গল্প বলি। এটি মিথ্যা গল্প নয়, সত্যি গল্প। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন প্যারিসে। তার সঙ্গে কথা বলার জন্য, তাকে এক পলক দেখার জন্য লোকের ভিড় লেগেই আছে। সুজান কার্পেলেস্ (কবির প্রাইভেট সেক্রেটারি) দর্শনপ্রার্থীদের কোনোরকম ঠেকিয়ে চলেছেন। এক দুপুরে হঠাৎ এক বৃদ্ধা এসে কবির সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন বিশ্রাম করছিলেন। সুজান তাকে সেকথা জানিয়ে আস্তে কথা বলতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু কে শোনে সে কথা! বৃদ্ধা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, আমি এতদূর থেকে এসেছি ‘গীতাঞ্জলি’ তে তার অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য।

 

রবীন্দ্রনাথ ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন। কবিকে দেখেই বৃদ্ধা নতজানু হয়ে তার সামনে ‘গীতাঞ্জলি’ বাড়িয়ে ধরলেন। কবি সেখানে অটোগ্রাফ দিতেই বৃদ্ধার আনন্দ দেখে কে! বৃদ্ধা খুশি মনে চলে যেতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুজানের দিকে ফিরে বললেন, ভদ্রমহিলার কণ্ঠে গীতাঞ্জলির আভাসমাত্র ছিল না।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ অক্টোবর ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ