ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কমরেড মণি সিংহ আজও অবিস্মরণীয়

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২৮ জুলাই ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কমরেড মণি সিংহ আজও অবিস্মরণীয়

কমরেড মণি সিংহ

শাহ মতিন টিপু : কমরেড মণি সিংহ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রাণপুরুষ এবং গণমানুষের নেতা। সারা জীবন তিনি লড়াই করে গেছেন এ দেশের খেটে খাওয়া-মেহনতি মানুষের জন্য। দেশের স্বাধীনতা অর্জন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তার অবদান অবিস্মরণীয়।

 

কমরেড মণি সিংহের জন্মদিন আজ। ১৯০১ সালের ২৮ জুলাই কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। তার বাবা কালী কুমার সিংহের মৃত্যু হলে, মা সরলা দেবী সাত বছরের মণি সিংহকে নিয়ে নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে চলে আসেন। এখানে সরলা দেবী তার ভাইদের জমিদারির অংশীদার হয়ে বসবাস শুরু করেন।

 

স্কুলজীবনেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন মণি সিংহ। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ‘অনুশীলন’ দলে যোগ দিয়ে ক্রমেই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে স্থান করে নেন। ১৯২৮ সাল থেকে কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিজেকে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে উৎসর্গ করেন মণি সিংহ। এ সময় তিনি কলকাতায় শ্রমিক আন্দোলনে একনিষ্ঠভাবে কাজ করতে থাকেন।

 

১৯৩০ সালের ৯ মে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৫ সালে জেল থেকে মুক্তি পেলেও নিজ গ্রাম সুসং দুর্গাপুরে তাকে অন্তরীণ করে রাখা হয়। এ সময় কৃষক-খেতমজুরদের পক্ষ নিলে নিজ মামাদের জমিদার পরিবারের সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি হয়। পাটের ন্যায্যমূল্য দাবি করে কৃষকদের পক্ষে ভাষণ দিলে তার দেড় বছরের জেল হয়।

 

১৯৩৭ সালে জেল থেকে বেরিয়ে দুর্গাপুরে মায়ের সঙ্গে দেখা করে কলকাতার শ্রমিক আন্দোলনে ফিরে যেতে চাইলেও এলাকার মুসলমান কৃষক ও গারো হাজং প্রভৃতি আদিবাসী মণি সিংহকে ‘টংক প্রথা’র বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য বারবার অনুরোধ করতে থাকেন। এরপর মণি সিংহ সর্বতোভাবে টংক আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন এবং কালক্রমে তিনি এ আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ১৯৪১ সালে মণি সিংহকে আবার গ্রেপ্তার করে ১৫ দিন আটক রাখা হয়। ছাড়া পেয়ে তিনি আত্মগোপনে চলে যান।

 

টংক মানে ধান কড়ারী খাজনা। ফসল হোক বা না হোক কড়ার মতো ধান দিতে হবে। টংক জমির ওপর কৃষকদের কোনো স্বত্ব ছিল না। ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে কলমাকান্দ, সুসং-দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী থানায় এই প্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথা বিভিন্ন নামে ওই সময়ের পূর্ববঙ্গে প্রচলিত ছিল। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এই টংক আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নারী-পুরুষ-শিশুসহ অনেক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। কৃষকদের শত শত বাড়ি ধূলিস্মাৎ করা হয়েছে। পুড়িয়ে ছারখার করা হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। ১৯৫০ সালে টংকের পরিবর্তে টাকায় খাজনা প্রবর্তিত হয় এবং জমিতে কৃষকের স্বত্ব স্বীকৃত হয়।

 

১৯৪৪ সালে মণি সিংহ সারা বাংলার কিষান সভার প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কিষান সভার ঐতিহাসিক সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মণি সিংহ ছিলেন সম্মেলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক। ১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রাম করতে গিয়ে কমরেড মণি সিংহকে অসংখ্যবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে।

 

১৯৫১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে তিনি আত্মগোপন অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সম্মেলনে পুনরায় পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

 

১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের চাপে অন্যান্য রাজবন্দীর সঙ্গে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। এ বছর ২৫ মার্চ পুনরায় সামরিক আইন জারি হলে তিনি জুলাই মাসে আবার গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় অনেক নেতাকে মুক্তি দিলেও, ইয়াহিয়া সরকার কমরেড মণি সিংহকে মুক্তি দেয়নি।

 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বন্দিরা রাজশাহীর জেল ভেঙে তাকে মুক্ত করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন-সাহায্য-সহযোগিতা আদায়ে কমরেড মণি সিংহের অবদান ছিল অবিসংবাদিত। তিনি ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে তাকে নির্বাচিত করা হয়।

 

স্বাধীনতার পর কমরেড মণি সিংহ পূর্ণ গণতান্ত্রিক এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে সোচ্চার হন। ’৭৩ সালে অনুষ্ঠিত সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেস এবং ’৮০ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় কংগ্রেসে মণি সিংহ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৮৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কমিউনিস্ট পার্টি আবার বেআইনি ঘোষিত হয়। জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসন চলাকালে ’৭৭ সালের মাঝামাঝি ৭৭ বছরের মণি সিংহ আবার গ্রেপ্তার হন। জিয়ার শাসনামলে তাকে ছয় মাস কারাগারে অন্তরীণ থাকতে হয়।

 

কিংবদন্তি এই বিপ্লবী ৮৪ বছর বয়স পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে পার্টির দায়িত্ব পালন করেন। তার পুরো জীবনটাই ছিল আন্দোলন-সংগ্রামে পূর্ণ। ১৯৮৪ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর তার দীর্ঘ বিপ্লবী জীবনের অবসান ঘটে।

 

বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের শোষণমুক্তির লড়াই-সংগ্রামের পুরোধা কমরেড মণি সিংহ। যে নামটির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রে তিনি প্রবাদতুল্য বিপ্লবী কমরেড।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুলাই ২০১৬/টিপু/এএন

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়