ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

করগাঁও লাহুন্দ জমিদারবাড়ি

রুমন চক্রবর্ত্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ১ জানুয়ারি ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
করগাঁও লাহুন্দ জমিদারবাড়ি

কিশোরগঞ্জের করগাঁও লাহুন্দ জমিদারবাড়ির সামনের অংশ

করগাঁও লাহুন্দ জমিদারবাড়ি। ১৭৮ বছরের প্রাচীন এ জমিদারবাড়িটি জরাজীর্ন স্থাপনা হয়ে আজো কালের সাক্ষী বহন করে যাচ্ছে। বর্তমানে জমিদারবাড়িটির ঐহিত্য বলতে টিকে রয়েছে এর সামনের জরাজীর্ণ একটি অংশ।


প্রায় ১৭৮ বছর আগের এ জমিদারবাড়িটি তার নিজস্ব জৌলুস হারিয়েছে অনেক আগেই। এখন সেটি ক্রয় সূত্রে ভোগদখলে রয়েছে। তেমন কোনো নিদর্শন না থাকলেও রয়েছে ইতিহাস। এ এলাকার অনেক বয়োবৃদ্ধ রয়েছেন, যারা এ জমিদারবাড়ির অনেক হারিয়ে যাওয়া কথা মনে রেখেছেন আজো।


জমিদারি করতে প্রয়োজন হয় তালুক। আর তাই সর্বশেষ এ তালুক হারিয়ে করগাঁও লাহুন্দ জমিদারবাড়ির তালুকদারী ও জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটে।

 

                                     করগাঁও লাহুন্দ জমিদারবাড়িতে প্রবেশের প্রধান ফটক


সংক্ষিপ্ত  ইতিহাস : ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৩৬ সালে এ অঞ্চলে প্রথম জমিদারি প্রথা চালু হয়। কটিয়াদীর আচমিতা গ্রামের কৃষ্ণ কান্ত রায় নিকলী উপজেলা ও আশেপাশের বিভিন্ন জমিজমা ক্রয় করে এখানে জমিদারি প্রথা শুরু করেন।
এ অঞ্চলের মানুষজনকে তিনি খামারে বর্গা দিয়ে জমি চাষ করাতেন।


কৃষ্ণ কান্ত রায়ের দুই ছেলে ধরণী কান্ত রায় ও রজনী কান্ত রায়। তন্মধ্যে ধরণী কান্ত রায় ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন অনারিয়ম ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। যার ফলে এ অঞ্চলের মানুষ তাকে খুব সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। কৃষ্ণ কান্ত রায়ের মৃত্যুর পর মুলতঃ রজনী কান্ত রায় জমিদারি ও তালুকদারি দেখাশুনা করতেন।


শচিকান্ত রায়, রাখাল কান্ত রায় ও পিন্টু কান্ত রায় নামে রজনী কান্ত রায়ের তিন পুত্র সন্তান ছিলেন। তার মধ্যে শচিকান্ত রায় তৎকালীন সময়ের একজন নামি ফুটবলার ছিলেন। আর রাখাল কান্ত রায় ছিলেন তৎকালীন কটিয়াদী সিও অফিসের সুপার ভাইজার। স্বাধীনতার পর জমিদারি প্রথা ও তালুকদারী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে এ দেশ ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান।  

 

                                     জমিদারবাড়ির ভেতরের সিড়ি


জমিদারি প্রথা শেষলগ্নে : ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে লাহুন্দ জমিদারবাড়ির জমিদারি কার্যক্রম বিলুপ্ত হতে শুরু করে। পর্যাপ্ত খামার না থাকায় ধীরে ধীরে তালুকদারি চলে যেতে থাকে। ধাপে ধাপে তারা সকল তালুক বিক্রি করতে শুরু করেন। পরের প্রজন্ম পরবর্তী ১৯ বছর কিছু তালুক নিয়ে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করে। বংশের কেউ কেউ বিভিন্ন পেশায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেন। আবার কেউ কেউ কৃষি জমিতে হালচাষ শুরু করেন। তবে এ এলাকার লোকমুখে এখনো শোনা যায় তাদের দাপটের কেচ্ছা কাহিনী।


বর্তমান বংশধর : বর্তমানে লাহুন্দ জমিদারবাড়ির কোনো বংশধর এ দেশে নেই। ১৯৭৪ সালের পর তৃতীয় বংশধর যারা ছিলেন তারা বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে ভারতের কলকাতায় পাড়ি জমান। এলাকার সূত্র মতে সে সময় জমিদার বাড়িটি কিনে নেন জমশেদ উদ্দিন আহমেদ। তার সঙ্গে পত্রযোগে কলকাতায় অবস্থানকারী জমিদারদের বংশধরদের যোগাযোগ রক্ষা হতো। কিন্তু তিনি মারা যাবার পর আর কেউ খোঁজ খবর রাখেনি। এ ছাড়া ১৯৭৪ সালের পর আজ পর্যন্ত কেউ আর দেশে ফিরে আসেননি।


বর্তমান চিত্র : জেলার কটিয়াদী উপজেলার করগাঁও ইউনিয়নের লাহুন্দা গ্রাম অবস্থিত। তবে যেতে হয় কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে নিকলী উপজেলার সড়ক পথে। এ পথে ২০ কিলোমিটার দূরে করগাঁও ইউনিয়ন। সেখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে হাওড়ের কোন ঘেঁষে অবস্থিত এ জমিদারবাড়িটি।  বর্তমানে এর বাহ্যিক অবকাঠামো খুব নাজুক। খসে খসে পড়ছে পুরোনো ইট-পাথর-চুনের গড়া বিভিন্ন অংশ। এ ছাড়া এক প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙ্গে পড়ে এ জমিদারবাড়ির বড় ভবনগুলো। এখন টিকে আছে শুধু সামনের দরবার খানা, ছোট মাঠ, জমিদারি আমলের ভাঙ্গাচোরা একটি পুকুর ঘাট ও পুকুর।

                         করগাঁও লাহন্দ জমিদার  ভেতরের একটি অংশ বর্তমানে স্থানীয় ছেলে-মেয়েদের পাঠদানের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে


তবে এ পুকুর ঘাটে এখনও বিভিন্ন দরবার সম্পাদন করে থাকেন এ অঞ্চলের প্রাক্তন চেয়ারম্যান। বাড়ির প্রবেশ মুখেই দেখা যায় বিলীন হয়ে যাওয়া দুটি বিশাল মঠ। তবে তার একটির ৯৯ ভাগ ভেঙ্গে জেগে উঠেছে এক বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছ। আর অন্যটির নিচের অংশ ছাড়া পুরোটাই ভেঙ্গে পড়ে গেছে। মঠদুটি জমিদারবাড়ির বিভিন্ন পূজা অর্চনায় ব্যবহৃত হতো।


বর্তমানে এ জমিদারবাড়িটি ভোগ দখল করছেন পৈত্রিক সূত্রে মালিক, আবুল খায়ের মো. সিদ্দিক (দুলাল)। তিনি করগাঁও ইউনিয়নের পর পর দুইবার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। তিনি ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত করগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন।


জানা যায়, ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে এ জমিদারবাড়ির ৮ একর সম্পত্তি ক্রয় করেন তৎকালীন করগাঁও ইউনিয়ন কমিটির চেয়ারম্যান জমশেদ উদ্দিন আহমেদ। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করার পর তাঁর চার ছেলে- আবুল খায়ের মো. সিদ্দিক, আবু সাঈদ মো. সাদেক, আবুল খায়ের মো. সাবের ও আবু নাঈম মো. জুবায়ের এ জমির মালিক ও দখলখার হন।

 

                                         করগাঁও লাহুন্দ জমিদারবাড়ির বাঁধানো পুকুর ঘাট


প্রাক্তন করগাঁও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিদারবাড়ির মালিক আবুল খায়ের মো. সিদ্দিক (দুলাল) রাইজিং বিডিকে বলেন, ‘সংক্ষেপে বলব পুরাতন নিদর্শনের সাক্ষী এ জমিদারবাড়িটি। পৈত্রিক সূত্রে আমরা মালিক বটে, তবে এর ইতিহাস কখনো মোছা যাবে না। এখনো এর সামনের যতটুকু অংশ বিদ্যমান, সেটি এলাকার ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনার কাজে ব্যবহার করছে।’

 

 



রাইজিংবিডি/কিশোরগঞ্জ/রুমন চক্রবর্ত্তী/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়