ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কাঁঠাল চোর || ইবনুল কাইয়ুম

ইবনুল কাইয়ুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩১, ২৯ জুন ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কাঁঠাল চোর || ইবনুল কাইয়ুম

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

দখিণা হাওয়া বইছে। ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আকাশে ভরা জোস্নার গোল চাঁদ; নরম আলো যেনো গলে গলে পড়ছে। নারকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের সেই অপরূপ আলো চুইয়ে চুইয়ে এসে পড়ছে তিন বন্ধুর গায়ে। গ্রামের শেষ প্রান্তে মাঠের শুরু যেখানে, সেখানে দূর্বা ঘাসের ওপর পাশপাশি শুয়ে আছে ওরা। খানিক দূরে নদী। নদীর জল ছুঁয়ে উড়ে আসা বাতাস জলীয়কণায় সমৃদ্ধ। ফলে বাতাসটা বেশ শীতল। সেই বাতাস গায়ে মেখে গালগপ্পের ঝুড়ি খুলে বসেছে ওরা তিনজন।

হঠাৎ গপ্প থামিয়ে দেয় কবির। নাসারন্ধ্র কুঁচকে ওঠে তার। জৈষ্ঠ্যের বাতাসে নাকে যে ঘ্রাণটা এসে লাগে তা অনুভব করার চেষ্টা করে সে। ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হয়ে ওঠে তার। কবিরের এই ভঙ্গি চোখ এড়ায় না ঈশান ও শরিফুলের। তারাও বাতাসে সেই ঘ্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করে। আউলা বাতাস বইছে। ফলে ঘ্রাণটা ঠিকভাবে পায় না তারা।

তবে কবিরের নাকে যখন কিছু অনুভূত হয়েছে, তখন বিষয়টি দারুণ কিছু একটা না হয়ে যায় না। সে বিশ্বাস ওদের আছে। ওদের মধ্যে কুবুদ্ধির লেনদেন আজকে থেকে নয়, বেশ পুরনো। শুধু লেনদেনে তা সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রায়ই সেসব বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়। সেগুলো গ্রামের ফলদাতা গাছ আর প্রতিদ্বন্দ্বী শেয়াল ছাড়া আর কেউ জানে না। সবাই জানে ওরা তিন জনই গ্রামের সবচেয়ে ভদ্র আর ভালো ছেলে। এটাই ওদের সবচেয়ে বড় সুবিধে। এতে অন্যের গাছের ফল আর মুরগী যে তাদের পেটে যায় সেটা ঘুণাক্ষরেও কেউ আঁচ করতে পারে না। বরং সকালে ভালোমানুষী চেহারা দেখে ওদের কাছেই নালিশ নিয়ে আসে ভুক্তভোগীরা। তাই নিয়ে কত হাসাহাসি চলে ওদের মধ্যে!

দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে বাতাসের ঝাপটা এসে লাগে। সজাগ হয়ে ওঠে তারা। আবছা অন্ধকার চারপাশে। সেই অন্ধকার ভেদ করে ভাবের আদান প্রদান হয়ে যায় তিন জনের মধ্যে। এসব ব্যাপার কাউকে তাদের বলে দিতে হয় না। এ যেন টেলিপ্যাথি! না বললেও তিন জনই নিজেদের মনের ভাব সহজেই বুঝে ফেলে। ঠিক এই মুহূর্তে কবির যা ভাবছে, ঈশান আর শরিফুলও একই কথা ভাবছে। কার গাছে কাঁঠাল পেকেছে সেটা এখুনি পরীক্ষা করে দেখার বাসনা তাদের তিনজনেরই রক্তে বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়ে।

কবির বলে, ‘বাতাস তো বলছে এখুনি কাঁঠালটার সদগতি না করলে কাল পঁচে যাবে।’ সমর্থন দিয়ে ঈশান বলে, ‘গাছটা শুভদের বাগানেরই হবে।’ শরিফুল আর বসে থাকে না। সে কিছু না বলেই উঠে হাঁটতে শুরু করে। অল্প কথার মানুষ সে।  বাকিরা তার পেছনে মৌন মিছিলে অংশ নেয়।

শুভদের বাগানটা বেশ বড়। শুধু যে কাঁঠাল গাছই আছে সে বাগানে সেরকমটা ভাবা মোটেও সমুচিত হবে না। নানা ধরনের গাছ আছে সেখানে। নদীর ঠিক পাড় ধরে বেশ বিস্তৃত একটা বাগান। দিনের বেলায় এখানে বেশ আরাম। ঘন গাছে ভরা ছায়া সুশীতল পরিবেশ। পাশে নদী থাকায় এই গরমে এখানে দারুণ স্বস্তি মেলে। তবে রাতের এই বিজন প্রহরে সেখানে এক আধিভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। চাঁদের আলো সেখানে লুকোচুরি খেলছে। মাটিতে পড়ার সুযোগ তার এখানে নেই বললেই চলে। যাও বা একটু আধটু পড়ছে বাতাসের বেগে গাছের দুলুনিতে সেই আলো সরে সরে যাচ্ছে।

সঠিক গাছটা চিনতে ওদের মোটেও অসুবিধে হয় না। অন্ধও ঠিকঠাক চিনে নিতে পারবে গাছটি। এমনই সুঘ্রাণ কাঁঠালের। এখন শুধু গাছে উঠে টুপ করে পেড়ে নেওয়া। অন্তত দুজনকে গাছে উঠতে হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় তারা। কথা না বাড়িয়ে শরিফুল মালকোচা মেরে উঠে যায় আগে। তাকে অনুসরণ করে শাখামৃগের বংশধর প্রমাণ করতে কবিরও লাফ দিয়ে নিচের একটা ডাল ধরে ঝুলে পড়ে। আর ওমনি ধপ্‌ করে শব্দ ওঠে। শব্দ শুনে ঈশান ভাবল কাঁঠালটা বুঝি শরিফুলের হাত থকে পড়ে গেছে। তবে আবছা আলোয় নড়াচড়া দেখে সে বুঝে নেয়, ওটা কাঁঠাল নয়, কবির; হাত-পাওয়ালা কাঁঠাল! যে ডালটা ধরে কবির ঝুলেছিল সেটা শুকনো ছিল, ধরতেই ভেঙ্গে গেছে!

পড়ে গেলেও কবিরের উৎসাহ কমেছে এমন অপবাদ কেউ দিতে পারবে না। তারও লুঙ্গি পরা। মালকোচা মেরে হাতে থুথু লাগিয়ে অস্ফুট স্বরে হেইও বলে সে পুনরায় গাছে ওঠার চেষ্টা করে। দাঁড়িয়ে না থেকে নিচ থেকে ঈশান তাকে ঠেলা দিতে শুরু করে। কিন্তু তাল সামলাতে পারে না। একে অন্ধকার, তার ওপর কবিরটা বেশ নাদুস-নুদুস। ফলে বাধ্য হয়েই বসে পড়ে সে। বসে হাফাতে থাকে। আর ঠিক তখুনি সড়াৎ করে কবির এসে ঈশানের মাথার ওপরে ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো নেমে আসে। ঈশান সরে যাওয়ার সুযোগ পায় না। কবিরকে মাথায় নিয়ে গাছের কাণ্ডের সঙ্গে ঘসা খেতে খেতে প্রায় শুয়ে পড়ে সে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দুই বন্ধু এভাবেই বসে থাকে কিছুক্ষণ।

তাদের বসার ভঙ্গিটা ছিল দেখার মতো। দুপা সামনে প্রসারিত করে বসে আছে ঈশান। তার ঘাড়ে চেপে বসে আছে কবির। তার লুঙ্গি ঈশানের মাথাকে তাবুর মাঝখানের দণ্ড ভেবে তরুণীর এলোকেশি চুলের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। নদী থেকে আসা বাতাসে সেই লুঙ্গী উড়ছে ইচ্ছেমত।

একটা মাঝারি সাইজের কাঁঠাল নিয়ে দস্তুরমতো হাঁসফাঁস করতে করতে নেমে আসে শরিফুল। গাছের মাথায় থাকার দরুণ নিচের কাণ্ডখানা সে দেখতে পায়নি। তবে গাছের গোড়ায় শব্দের বিচিত্র খেলা এবং ঘটনা আঁচ করতে পেরে তার বেগ পেতে হয়নি। গাছ থেকে নেমে কাঁঠালটি একপাশে রেখে দেয় সে। এরপর হোজ্জা নাসিরউদ্দিনের গাধায় চেপে বসে থাকার মতো ঈশানের ঘাড়ে চেপে বসে থাকা কবিরকে টেনে উঠায়। এরপর ঘটনার আকস্মিকতায় হঠাৎ করেই তিন বন্ধু হো হো করে হেসে ওঠে। পাশে গাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা কাঁঠালটিও বুঝি সেই হাসিতে যোগ দিয়ে পাশে গড়িয়ে পড়ে।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুন ২০১৫/সনি/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়