ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে একদিন

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে একদিন

ছবি: অন্তিম মেঘালয়

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : ৬ ডিসেম্বর পড়ন্ত বিকেল। রাজধানীর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। কুয়াশা আচ্ছন্ন আকাশ আলোছায়ায় অন্যরকম আবহ। বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল মানুষের কলোহল। নানা বয়সের মানুষ। কিশোরেরা ব্যস্ত খেলাধুলায়, কেউ খেলছে ফুটবল, কেউবা ক্রিকেট, কেউ উড়াচ্ছে রঙিন ঘুড়ি। তরুণ-তরুণীরা বাদামের খোসা ছড়াছেন সঙ্গে গল্প গুজব। বটতলায় বয়সীরাও ব্যস্ত আড্ডায়। চা, ফুচকা, ঝালমুরি, বাতাসা বিক্রিতে ব্যস্ত হকারেরা।

 

সজীব উদ্দিন বয়স বারো। সে রাজধানীর লালমাটিয়ায় একটি মার্কেটে কাজ করে। সজীব জানায়, মঙ্গলবার তার সাপ্তহিক ছুটি। মঙ্গলবারেই সে বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে ঘুড়ি উড়াতে আসে। সজীব বলতে পারেনি, কি কারণে এ জায়গা বধ্যভূমি? কেন এ স্মৃতিসৌধ? সজীবের বয়সী অনেক ছেলেরা প্রতিদিন বধ্যভূমিতে ঘুড়ি উড়ায়। 

 

স্মৃতিসৌধের প্রধান প্রবেশপথ চত্বরের দক্ষিণ-পূর্ব একটি বটগাছ। বটগাছ ও আশেপাশের গাছতলায় বিভিন্ন পেশার বয়স্ক মানুষেরা আড্ডা দিচ্ছেন আয়েশী ভঙ্গিতে। এই আদি বটগাছের নিচে বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে প্রথমে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে পরে ইটখোলায় নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হতো। গাছতলায় আড্ডারত বাবুল ফকির (৫৫)। পেশায় তিনি প্রাইভেটকার চালক। বাবুল ফকির বলেন, মুক্ত হাওয়া খেতে এখানে আসি, এখানে এক ঘণ্টা বসলে মনটা ফ্রেশ হয়ে যায়। পরিবেশ আরো পরিচ্ছন্ন হলে ভালো লাগতো।

 

অনেকেই অবসর সময় কাটাতে পুরো পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন বধ্যভূমিতে, ফুচকা আর ঝালমুরি খেয়ে সময় পার করছেন ফুর্তিতে। আট বছরের সন্তানকে নিয়ে বধ্যভূমিতে এসেছেন এডভোকেট আলী খান (৪২)। তিনি বলেন, ‘আমি সময় পেলেই সন্তানকে নিয়ে এখানে আসি, যাতে আমার পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারে।  স্মৃতিসৌধের পাশে বধ্যভূমির ইতিহাস ডিসপ্লে করলে ভালো হতো, এতে আগত দর্শনার্থীরা বধ্যভূমি সম্পর্কে জানতে পারতো।’ দিবসভিত্তিক আয়োজন থাকলেও ঐতিহাসিক স্থানটি বছরের বাকিদিনগুলোতে থাকে অবহেলিত।

 

‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই/আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,/ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে/এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দু:স্বপ্নের রাত,/সেই রক্তাক্ত সময়? - কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।

 

সত্যিই কি আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের ইতিহাস, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। সেই শহীদদের, যাদের আত্মত্যাগে প্রিয় বাংলাদেশ। প্রিয় লাল সবুজের পতাকা। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে এ বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল এদেশের অগনিত সূর্য সন্তানকে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চিরস্মরণীয় করে রাখতে ১৮ কোটি টাকা খরচ করে ১৯৯৯ সালে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিসৌধ।

যাদের স্মরণে এই স্মৃতিসৌধ

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো সময়টাতেই, পাকিস্তানী সৈন্যরা এবং তাদের স্থানীয় দোসর আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, কবি ও লেখকদের ক্রমে হত্যা করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী যৌথ দলের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাত্র দুই দিন আগে, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ সংখ্যক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতে অধ্যাপক, সাংবাদিক, ডাক্তার, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখকসহ পূর্ব পাকিস্তানের ২০০ জন বুদ্ধিজীবীদের ঢাকায় একএিত করা হয়েছিল। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগ এবং শহরের বিভিন্ন স্থানের নির্যাতন সেলে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদের রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে বাংলাদেশে শোক প্রকাশ করা হয়।

মার্চ ২৫ থেকে ১৬ ডিসেম্বর-এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন অংশে যে সকল বুদ্ধিজীবী নিহত হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, গোবিন্দ চন্দ্র দেব (ঢাবি এ দার্শনিক, অধ্যাপক), মুনীর চৌধুরী (ঢাবি এ সাহিত্যিক, নাট্যকার, অধ্যাপক), মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক), আনোয়ার পাশা (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক), ডঃ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি (হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ), ডা. আলীম চৌধুরী (চক্ষুরোগের), শহীদুল্লাহ কায়সার (সাংবাদিক), নিজামউদ্দিন আহমেদ (রিপোর্টার), সেলিনা পারভীন (সাংবাদিক), আলতাফ মাহমুদ (গীতিকার ও সুরকার), ড. হাবিবুর রহমান (গণিত অধ্যাপক, রাশিয়া), সুখরঞ্জন সমাদ্দার (সংস্কৃত অধ্যাপক, রাশিয়া), মীর আব্দুল কলিম (মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক, রাবি), ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (রাজনীতিবিদ), রনাদা প্রসাদ সাহা (মানবপ্রেমিক), লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোয়াজ্জেম হোসেন (প্রাক্তন সৈনিক), মামুন মাহমুদ (পুলিশ অফিসার ) এবং আরো অনেকে।

 

যেভাবে নির্মিত হল বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ

১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সরকার এ নৃশংস হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ার স্থানে স্মৃতিসৌধটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশ সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস যৌথভাবে স্মৃতিসৌধের নকশা প্রণয়নের জন্য জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা আহবান করে। ২২টি নকশার মধ্যে স্থপতি ফরিদউদ্দীন আহমেদ ও স্থপতি জামি-আল-শফি প্রণীত নকশাটি নির্বাচিত হয়। গণপূর্ত বিভাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব লাভ করে। এ কাজ ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিন বছর সময়ে সম্পন্ন হয়।

 

সমগ্র স্থানটি ৩.৫১ একর আয়তনবিশিষ্ট। এটি ১৫.২৪ মিটার বর্গাকার একটি গ্রিড দ্বারা বিভক্ত হয়েছে। মূল বেদিটি রাস্তা থেকে ২.৪৪ মিটার উঁচু। স্মৃতিসৌধের প্রধান অংশটি ১৭.৬৮ মি উঁচু, ০.৯১ মি পুরু ও ১১৫.৮২ মি দীর্ঘ একটি বাঁকানো দেয়াল। এটি রায়েরবাজারের আদি ইটখোলার প্রতীক, যেখানে বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহগুলো পড়েছিল। দেয়ালটির দুদিক ভাঙা। এ ভগ্ন দেয়াল ঘটনার দুঃখ ও শোকের গভীরতা নির্দেশ করছে। দেয়ালের দক্ষিণ-পশ্চিম পার্শ্বে একটি ৬.১০ মিটার বর্গায়তনের জানালা আছে। এ জানালা দিয়ে পেছনের আকাশ দেখা যায়।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ ডিসেম্বর ২০১৬/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়