ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

কাজী নজরুল ইসলাম প্রেমিক ও বিদ্রোহী

মারুফ রায়হান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০২, ২৭ আগস্ট ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কাজী নজরুল ইসলাম প্রেমিক ও বিদ্রোহী

মারুফ রায়হান : নজরুল, কাজী নজরুল ইসলাম, এক হতদরিদ্র পরিবার থেকে এসে কঠোর জীবিকার সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করে বাঙালির জন্যে চিরস্থায়ী গান ও সাহিত্য রচনা করে গেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের তিনি জাতীয় কবি, যদিও বিভাগপূর্ব বাংলায় বাঙালির কাছে তিনি ‘জাতীয়’ কবিই ছিলেন।

 

সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের মানববিরোধী তৎপরতার কালে কবিতার মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন নজরুল; স্পষ্টত জানিয়ে দিলেন উৎপীড়িতের কান্না না থামা পর্যন্ত, অত্যাচারী স্তব্ধ না হওয়া অবধি তিনি শান্ত হবেন না।

 

তাঁর উচ্চারণ ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলো অত্যাচারী শাসকশ্রেণীর, স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও সাহসী করে তুলেছিলো সাধারণ মানুষকে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এভাবেই নজরুল হয়ে উঠলেন অখণ্ড বাংলার প্রাণের কবি; বললে ভুল হবে না, জাতীয় কবি।

 

একাত্তরের বিজয়ের পর রণসঙ্গীত, অর্থাৎ সশস্ত্রবাহিনীর উদ্দীপনামূলক গান হিসেবে বেছে নেয়া হলো নজরুলের ‘চল্ চল্ চল্ ঊর্ধ্বগগণে বাজে মাদল’ গানটি। স্বাধীন দেশের বাঙালি এভাবেই সম্মাননা জানালো তাঁদের প্রিয় কবিকে। কিন্তু সত্য প্রকাশের দায়বোধ থেকে বলতে হবে, মূলতঃ এর কিছু কাল পর থেকেই সূচনা হলো নজরুলকে খণ্ডিতভাবে দেখার। এর নেপথ্যে যে আমাদের একাংশের সাম্প্রদায়িক মনোভাব জড়িত সেই সত্যকে আমরা কিছুতেই ঢাকতে পারবো না।

 

নজরুল কেবল মুসলমান বাঙালির কবি- এই ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করার জন্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে শুরু হলো পরিকল্পিত উদ্যোগ। তাই গণমাধ্যমে নিষিদ্ধ হয়ে গেল শ্যামাসঙ্গীত, এমনকি নজরুলের ভালোবাসার গান ও কবিতার চাইতে বেশি-বেশি বাজতে শুরু হলো গজল, হামদ ও অন্যান্য ইসলামি গান ও কবিতা। ভাগ্যিস প্রকৃতি আগেই বাকহারা করে ফেলেছিলো কবিকে, তা না হলে হয়তো ক্রোধে-চিৎকারে ছিন্ন হতো তাঁর কণ্ঠনালি।

 

বাঙালির মূঢ় অংশ বিস্মৃত হলো নজরুলের উত্থানকাল। তাঁর সৃজনসত্তা তারা অসম্মানিত করলো। সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা অনিবার্য ছিলো শ্রেণী ও কালসচেতন কবি নজরুলের জন্যে। তাঁর কবি-স্বভাবের ভেতরেই ছিলো মানবকল্যাণচেতনা। একটি জাতির ইতিহাস ও পূরাণে মেলে তার সাংস্কৃতিক উপাদান। বাঙালি সংস্কৃতির শেকড় রয়েছে হিন্দু ও আরব-পারস্যের পূরাণে, এমনকি ইংরেজবাহিত গ্রীক ও ইউরোপীয় পূরাণসমূহেও।

 

শত হাজার বছর ধরে বাঙালি সেগুলো আত্মীকরণ করেছে। ধর্ম-গোত্র-শ্রেণী নির্বিশেষে বাঙালির ভেতর যে বহমান সংস্কৃতি তার সমগ্রতা আত্মস্থ করায় ব্রতী ছিলেন নজরুল। আর তাই তো আজরাইল আর যম, কুরুক্ষেত্র আর কারবালা, ইস্রাফিলের শিঙ্গা, তূর্যনিনাদ আর অর্ফিয়াসের বাঁশরি, যশোদা আর আমেনা একীভূত হয়ে যায় তাঁর সৃষ্টিভাণ্ডারে। বাংলার একই বৃন্তে দুটি ফুলের মতো হিন্দু-মুসলমানকে সমভাবে উপলব্ধি করার জন্যে প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে হয়।

 

নজরুল ছিলেন তা-ই। যদিও আত্মপরিচয় ভোলেননি নজরুল, অনুধাবন করলেন সমগ্র বাঙালির মানস বুঝতে হলে প্রধানত দুটি ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বহমান জীবনের অন্তরঙ্গ পরিচয় জানতে হবে। এই অন্বেষণের সাধনায় তিনি মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের বাঙালির জন্যে বোধগম্য ভাষায় রচনা করে যেতে থাকলেন সাহিত্য ও গান।

 

সবচেয়ে বড় কথা তিনি ছিলেন মৌলিক প্রতিভার অধিকারী একজন বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীল লেখক। সৃষ্টিসুখের উল্লাসে তিনি রচনা করে গেছেন বাঙালির জীবন, জীবনসংগ্রামের চালচিত্র। হিন্দু-মুসলমান- এই ভেদনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না বলেই যে-কলমে গজল ও হামদ লিখেছেন, সেই একই কলমে সৃষ্টি করেছেন শ্যামাসঙ্গীত। প্রিয়ার কানে মন্ত্রোচ্চারণের মতো আবেগ থরথর ছন্দিত পঙ্‌ক্তি যে-খাতার পৃষ্ঠায় উৎকীর্ণ হয়েছে, সেই একই খাতার অন্য পাতায় ঢেলে দিয়েছেন অত্যাচারী শাসকের মর্মমূল দীর্ণ করার মতো তপ্ত শব্দ।

 

এমন প্রাণোদ্দীপ্ত প্রতিভা বিংশ শতক আর দেখেনি। একই সঙ্গে প্রেমিক ও বিদ্রোহী, পূজারী ও প্রার্থনাকারী বান্ধব-লেখক বাঙালি আর দ্বিতীয়টি পায়নি। অর্থকষ্টের নিয়তি নজরুলের পিছু ছাড়েনি, তাই সুস্থিরভাবে অধ্যয়নের অবকাশ তাঁর হয়নি। হলে তাঁর কাছ থেকে আরো অনেক কালজয়ী রচনা, গভীর দার্শনিকতাবোধসম্পন্ন সাহিত্য পাওয়া সম্ভব হতো। সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য। যা হয়নি, তা হয়নি। কিন্তু যা পেয়েছি তার অনেকখানি লুকিয়ে রেখে কেন হীনম্মন্যতার পরিচয় দেবো!

 

আরো একটি ব্যাপার আছে, নজরুলকে স্বভাবকবি বলে তাঁর উচ্চতা খর্বের একটা প্রয়াস আছে উন্নাসিক পণ্ডিত মহলের। এই অপপ্রচারের একটা মোক্ষম জবাব উদাহরণসহ দিয়েছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলছেন, ‘নজরুল স্বভাব কবি নন, মোটেই না; কিন্তু অবশ্যই স্বতঃস্ফূর্ত কবি। স্বভাব কবির অশিক্ষিত পটুত্ব তাঁর ছিলো না, ছিলো প্রখর একটি সৌন্দর্যবোধ, যার সাহায্যে উচ্ছ্বাসকে তিনি কাব্য করেছেন, উত্তেজনাকে বশ করেছেন শিল্প দিয়ে, বন্ধনহীন হবার আবেগকে শৃঙ্খলিত করে ফেলেছেন ভাষার নিষেধে। তাঁর বিদ্রোহী কবিতার কথাই ধরি না কেন। দেখা যাবে এই কবিতার সকল উত্তেজনার ভেতরে রয়েছে যুক্তির একটি শক্ত পারম্পর্য। রয়েছে বিজ্ঞানমনস্কতাও। এটি কোনো উত্তেজিত যুবকের স্বগতোক্তি নয়, এটি একটি সুসংগঠিত কবিতা। শৃঙ্খলা তাই বলে স্বতঃস্ফূর্ততা যে নষ্ট করে দেবে তাও ঘটেনি।’

 

ছন্দগবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, নজরুল কী কুশলী ছন্দসচেতন কবি ছিলেন। প্রথম কাব্য ‘অগ্নিবীণা’-য় নজরুল মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দের বাইরে যাননি। গদ্যছন্দে মাত্র একটি কবিতা আছে তাঁর। ‘কবির মুক্তি’ কবিতাটি কেউ পড়লেই বুঝবেন এখানেও কী আশ্চর্য মিল আর ঝংকৃত ছন্দের স্বাক্ষর রেখেছেন এই অমর কবি।

 

নজরুল-পরবর্তী প্রজন্মের কবি জীবনানন্দ দাশ বাঙালির চিরকালের কবি। বাঙালির ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন বলে নয়, বাংলা ভাষায় লিখেছিলেন বলেও নয়; বলেছেন বাঙালি হয়ে, বাঙালির বয়ানে, বাঙলার প্রকৃতিতে মিশে থেকে, সে-কারণে। বহিরঙ্গে তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর বাঙালি, ভেতরের মানুষটাও ভিন্ন ছিলো না। নজরুলও তাই। কাজী নজরুল ইসলাম যখন রণতূর্য বাজান, তখন শুনি: ঝড়-ঝড়-ঝড়- আমি- আমি ঝড়/শন্-শন-শনশন শন্ ক্বড়ক্বড়/কাঁদে মোর আগমনী আকাশ-বাতাস বনানীতে।

আবার যখন প্রেমিকের বাঁশিতে সুর তোলেন তখন শুনি : মোর প্রিয়া হবে এস রানি দেব খোঁপায় তারার ফুল।

 

নদীমাতৃক আর গাছ-গাছালি-ভরা ভূঅঞ্চলের ঝড়ের শব্দের সঙ্গে ভিন্ন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত লোকালয়ের ঝড়ের গর্জনে অবশ্যই পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য ধরার জন্যে অসাধারণ শ্রুতির দরকার পড়ে না, কিন্তু কবিতায় চিত্রনের জন্য শেকড়ের কবি হতে হয়। বাঙালি পুরুষই তার প্রেয়সীর খোঁপায় ফুল গুঁজতে চাইবে, যেমন চাইবে কৃষিনির্ভর অঞ্চলের দীর্ঘকেশী নারীর প্রেমাষ্পদ। আধুনিক ইউরোপীয় রমণীর খোঁপা বাঁধার মতো কেশসম্পদ কোথায়? প্রায় অনুরূপ অবস্থা তো আজকের বাংলাদেশের অতিআধুনিক নারীরও। আকাশ থেকে তারা ছিঁড়ে এনে যে-পুরুষ কাঙ্ক্ষিত নারীর খোঁপায় জড়াতে চায় তাকে আমরা খুব সহজেই রোম্যান্টিক ও কবি বলে সনাক্ত করে উঠতে পারি।

 

১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে "বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি"র রজত জয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতিরূপে নজরুল অভিভাষণ দান করেন। দুরারোগ্য ব্যাধিতে চিরজীবনের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যাবার পূর্বে এই ছিল তাঁর সর্বশেষ বক্তৃতা। যাঁরা সম্যকরূপে নজরুলকে চিনতে চান, তাঁদের জন্য এই বক্তৃতার চেয়ে উত্তম কিছুই হতে পারে না।

 

নজরুলের প্রেমিক সত্তার কী অপূর্ব বয়ানই না পাই এই বক্তব্যে : ‘যদি আর বাঁশী না বাজে, আমি কবি বলে বলছি নে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম, সেই অধিকারে বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন। আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি। আমি নেতা হতে আসিনি। আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী হতে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’

 

নারীর প্রতি কবির দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে একটি কবিতাই যথেষ্ট। নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ করেননি কবি। সমানাধিকার ও সমঅবদানের বিষয়টি তাঁর মতো এত স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে আর কে বলেছেন! ‘নারী’ কবিতায় বলছেন :

সাম্যের গান গাই-

আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।

বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,

অর্ধেক তার করিয়েছে নারী, অর্ধেক তার নর।

 

আজকের দাবি সুলভমূল্যে জাতীয় কবির সমগ্র রচনা পাঠকের হাতে তুলে দিতে হবে। আর শ্রোতাদের দাবি নজরুলের হাজার গান না হোক, প্রাথমিকভাবে বিচিত্র আঙ্গিক ও বিষয়সমৃদ্ধ নির্বাচিত শত গান গুণী শিল্পীদের কণ্ঠে ধারণ করে সিডি ও ক্যাসেটে প্রকাশ করা হোক। নজরুলের যে-গানগুলো আর শোনা যায় না সেই সব গান সরকারী ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রচারমাধ্যমে প্রচার করা হোক। খণ্ডিত নজরুল নয়, আমরা চাই সম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ নজরুলকে।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ আগস্ট ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়