ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কার প্রতিমা কত সুন্দর প্রতিযোগিতা হতো || রামেন্দু মজুমদার

রামেন্দু মজুমদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৫, ২০ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কার প্রতিমা কত সুন্দর প্রতিযোগিতা হতো || রামেন্দু মজুমদার

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

ছোটবেলার কথা আমার আজো খুব মনে পড়ে। বিশেষ করে আমাদের প্রাইভেট টিউটরের কথা । প্রাইভেট টিউটর হিসেবে আমি এক অসাধারণ মানুষকে পেয়েছিলাম। তিনি লাবণ্য সেনগুপ্ত। সবাই বলত ‘লাবণ্য বাবু’। আমরা বলতাম ‘মাস্টার মশাই’। তারা ছিলেন দুই ভাই, দুই বোন। কেউ বিয়ে করেননি। তার বড়ভাই ছিলেন কবিরাজ। দু’বোন লক্ষ্মীপুরের গার্লস স্কুলে পড়াতেন। তাদের অসামান্য প্রচেষ্টায় এই স্কুলটি গড়ে উঠেছিল। তারা শেষদিন পর্যন্ত এই স্কুলের সাথেই ছিলেন। আর লাবণ্যবাবু কিন্তু কম যাননি। ভাল ইংরেজি জানতেন। পড়ানোর ধরনটাও সুন্দর। আমাদের ভাইবোনদের ইংরেজির ভীত তিনিই গড়েছিলেন।

তবে ছাত্র পছন্দ না হলে তিনি পড়াতেন না। আমাদের পড়াতেন সন্ধ্যায়। আমাকে ও আমার ছোটবোন রত্নাকে একসাথে পড়াতেন। পড়া না হলে শাস্তি দেবার ধরনেও ছিল ভিন্নতা। আমাদের দুজনের উপর রাগ হলে তিনি চলে যেতেন। আর একজন না পারলে তার দিকে হ্যারিকেনের আলো একটা বই দিয়ে ঢেকে দিতেন। বেশিরভাগ সময়ই দেখা যেত আমার দিকটি বেশ অন্ধকার। ইংরেজি ব্যাকরণ ও অনুবাদ শেখাতেন খুব সুন্দর করে। উচ্চারণ ছিল চমৎকার। একবার আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ক্লাসের স্যার অনুবাদ করতে দিলেন, `২০ হাজার লোক ২২ বছর পরিশ্রম করে তাজমহল নির্মাণ করিয়াছিল’।

আমি অনুবাদে লিখলাম,  ‘The labour of 20 thousand people built the Tajmahal in 22 years.`

স্যার অনুবাদটি ঠিক হয়নি বলে কেটে দিলেন। আমি লাবণ্যবাবুকে দেখাতেই তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, তুমি তো চমৎকার ইংরেজি করেছ। এটা মোটেও অশুদ্ধ নয়। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ছিলেন স্যার জে এস টারনার। মাস্টারমশায় বললেন, ‘তুমি তাকে চিঠি লেখো’। তিনিই চিঠির মুশাবিদা করে দিলেন। কয়েকদিন পর টারনার সাহেবের চমৎকার হাতের লেখায় জবাব এলো, ‘তোমার অনুবাদ খুব সুন্দর ছিল। তোমার শিক্ষক হয়তো খেয়াল করেননি’।
স্যারের সেই চিঠির মূল্য সেদিন বুঝতে পারিনি। কিন্তু আজ বুঝি। কোথায় যে হারিয়ে গেছে সে দিনগুলি, আজ ভাবতে খুব খারাপ লাগে।

এদিকে লাবণ্যবাবু আমাদের আরও ক্লোজ হয়ে উঠেছেন। সব পূজা পার্বণেও তার দাওয়াত থাকতো। তিনি চমৎকার বাঁশি বাজাতেন। এই বাঁশি শেখার জন্য তাকে নাকি বম্বে ও লাহরে বেশ কিছুদিন থাকতে হয়েছে। স্কুল ছুটি হলে মাঝে মাঝে আমরা তার সাথে মাছ ধরতে যেতাম।

আমাদের স্কুল বছরে দুবার ছুটি হতো। একবার বার্ষিক পরিক্ষার ফল বেরুবার পর আর অন্যবার বছরের মাঝখানে। যেদিন স্কুল অনেকদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে সেদিন ক্লাস বসতো খুব সকালে। সেদিন স্কুলে অনেক হৈ চৈ করে আমরা বাড়ি ফিরতাম। পূজাতে আমরা খুব আনন্দ করতাম স্যারের সাথে। বিশেষ করে ছোটবেলায় সবচেয়ে মজা হতো সরস্বতী পূজার সময়। স্কুলের আয়োজনের পাশাপাশি বড় আকারে পূজা হতো মুকুন্দবাবুর বাসায়। যেখানে আমরা সবাই অঞ্জলী দিতে যেতাম। সরস্বতী বিদ্যার দেবী। তাই প্রত্যেকে যার-যার পড়ার বই নিয়ে আসতাম। অঞ্জলীর ফুলের পাপড়ি বইয়ের ভেতর রেখে দিতাম অনেক দিন। আর উঁচু ক্লাসে না ওঠা পর্যন্ত বাবা-মা, দাদার সাথেই কাটত পূজার সময়। বাইরে খুব দূরে যেতে পারতাম না। একটু বড় হয়ে আমরাই আমাদের পাড়ায় পূজার আয়োজন করতাম। অনেক পাড়াতেই পূজা হতো। কাদের প্রতিমা কত সুন্দর, কে কত সুন্দর করে প্যান্ডেল সাজাতে পারে তার প্রতিযোগিতা হতো।

পূজার মাসখানেক আগেই আমরা রসিদ বই  ছাপিয়ে চাঁদা তুলতে নেমে যেতাম। চারআনা আর আটআনা-ই বেশি মিলত। পূজার এই কয়দিন আমাদের বয়সি সবাই খুব করে মেতে থাকতাম পূজা নিয়ে। কিন্তু আজ সেসব দিন কোথায় গেল। মাঝে মাঝে কেমন আনমনা হয়ে যাই। খুব মনে পড়ে দিনগুলো।

অনুলিখন : অহ নওরোজ

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ অক্টোবর ২০১৫/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়