কেন লিখি? || আহমদ ছফা
রিশিত || রাইজিংবিডি.কম
আহমদ ছফা
আমার বাবা ছোটবেলায় বলতেন, আমার এই ছেলেটি আগের যুগে জন্মালে অবশ্যই পয়গম্বর হতো। কথাটা শুনতে ভীষণ খারাপ লাগতো। কারণ পয়গম্বরদের আমার ভারি গম্ভীর এবং ভারিক্কি ধরনের মানুষ মনে হতো। পয়গম্বর হওয়াটা কী করে এড়িয়ে যাওয়া যায়, সেজন্য মনে মনে ফন্দি-ফিকির আটতাম।
বহু যুগ আগেই পয়গম্বরের কাল গত হয়েছে। সুতরাং আমার আর পয়গম্বর হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। তা ছাড়া ধর্মগ্রন্থে যেসব নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের কেউ এ ভারত উপমহাদেশের মানুষ নন। কাজেই সেসব কথা থাকুক। আমাকে লেখক হিসেবে পরিচিত হতে হয়েছে। আমাদের সমাজে অনেক ব্যক্তি আছেন, যারা লেখক হিসেবে পরিচয় দিতে পেরে পুলকিত হয়ে থাকেন। আমার কেন বাধো বাধো ঠেকে। আমার নাম আ-হ-ম-দ ছ-ফা। শুধু লেখক বললে আমার সবটা পরিচয় উঠে আসবে না মনে করি। তবু আমাকে তো সবাই লেখক হিসেবেই চেনেন। এ পরিচয় অস্বীকার করবো কী করে?
আমি কিন্তু লেখক না হওয়ার জন্য বার বার চেষ্টা করেছি। প্রাথমিক স্কুলে প্রথম আমার লেখার স্ফুরণ ঘটে। কিন্তু উপযুক্ত ক্ষেত্র এবং পরিচর্যার অভাবে সেটার বিকাশ হয়নি। হাইস্কুলে গিয়েই ভাবতে শুরু করলাম, আমার কাজ হবে রাজনীতি। কারণ রাজনীতির মাধ্যমে আমি দেশের মানুষের সেবা করতে পারবো। ছাত্রজীবনে আমি কৃষকের রাজনীতি করেছি এবং কৃষক রাজনীতিতে বলতে গেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। যদিও রাজনীতি করার স্বপ্ন জীবনের নানা বাঁকে আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে, কিন্তু আমার রাজনীতিতে টিকে থাকা সম্ভব হয়নি।
তারপরে আমি ভাবলাম, আমার কাজ হবে আমলা হওয়া। পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়েছিলাম। মৌখিক পরীক্ষায় পাসও করেছিলাম। ওই পেশায় যদি লেগে যেতাম, আজকে এ কথা বলার অবকাশ থাকতো না। তারপর আমি ভাবলাম, আমি জাঁদরেল পণ্ডিত হবো। নানা বিষয়ে বেশ পড়াশোনাও করতে চেষ্টা করেছি। রিসার্চ স্কলার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বাংলা একাডেমিতে বেশ কিছু দিন কাটিয়েছি। পরিবেশ-পরিস্থিতি থাকলে হয়তো আমি একটা ভয়ংকর পণ্ডিত হয়ে উঠতে পারতাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের জ্ঞান-বুদ্ধির বহর দেখে আমার সে আকাঙ্ক্ষা নষ্ট হলো। তারপর ব্যবসা করতে চেষ্টা করেছি। শুরুতে বেশ চমক সৃষ্টি করেছিলাম কিন্তু চালাতে পারিনি। এক সময় পত্রিকা করার কাজেও কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিলাম। লাভ তো কিছু হয়নি, কিন্তু কিঞ্চিত তিক্ত অভিজ্ঞতা, পয়সা নষ্ট, মেধা নষ্ট, শরীর নষ্ট- এসব নগদ লাভ আর কি!
এখন আগের কথায় ফিরে আসি। আমাকে সবাই যখন ছেড়ে যায়, সবকিছু যখন ছেড়ে যায়, তখনই আমি লেখার কাছে ফিরে আসি, ফিরে আসতে হয়। এটা যেন আমার নিয়তি। বন্ধু-বান্ধব অনেকে আছেন, তাদের নিজের লেখা সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চকণ্ঠ। কিন্তু আমার সেরকম কিছু ঘোষণা দেওয়ার সুযোগ কই? আমি তো বার বার পালিয়ে এসে লেখার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করি। সম্প্রতি আমি মুসা এবং ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ সম্পর্কে কিছু খোঁজ-খবর করছিলাম। ঈশ্বর মুসাকে যখন পয়গম্বরের দায়িত্ব গ্রহণ করতে বার বার আহ্বান করলেন, মুসা বার বার পালিয়ে গিয়ে দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছিলেন। কারণ তিনি খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ঈশ্বর মুসাকে রেহাই দেননি। চেপে ধরে দায়িত্বটা তার ওপর আরোপ করেছিলেন। আমি নিতান্ত তুচ্ছ মানুষ। তবু আমার ক্রমেই মনে হচ্ছে, আমাকে লিখতে হবে, পালিয়ে বাঁচতে পারবো না। যতদিন বাঁচি লিখতে হবে- পাঠক জুটুক আর না-ই জুটুক, ভালো কেউ বাসুক আর না-ই বাসুক।
এখন একটা বিশ্বাস মনের ভেতর হীরার মতো শক্ত হয়ে জমেছে- লেখকরা মানবসমাজের, মানব জাতির অস্তিত্বের সারবান অংশটুকু ধারণ করেন। রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, বৈজ্ঞানিক, সাংবাদিক এরা সবাই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কিন্তু লেখককে আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। বিক্রমাদিত্যের আমলের কারিগর-বিজ্ঞানী এবং অন্যবিধ বিদ্যায় পারদর্শী ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের চিন্তা না করলেও চলে। কিন্তু কালিদাসকে নিয়ে না ভাবলে চৈতন্যের শুদ্ধতা আসবে না বলে মনে করি। আমি এমন আহামরি লেখক নই; তবু যখন কলম ধরি একটা ধারণা আমার আসে। মনে হয় আমি গোটা মানবসমাজের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে আছি। আমার লেখার মধ্য দিয়ে মানুষের ব্যক্তিচৈতন্যের নতুন উদ্ভাস ঘটছে।
আবারো বলছি, আমি ছোট মানুষ। কোনো স্পর্ধিত উচ্চারণ আমাকে শোভা পায় না। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন ছন্দ দিয়ে তিনি যন্ত্র চালাবেন। গ্যেটে বিশ্বাস করতেন সমস্ত প্রাণশক্তি পঞ্জিভূত করে একটামাত্র প্রবল ফুৎকারে নতুন দেববীর্যে বলীয়ান মানুষ সৃষ্টি করবেন। আমি কিছু নই তবু জানি, এসব অতিকায় মানুষ আমার মার মতো নারীর গর্ভে জম্ম নিয়েছিলেন।
একটুখানি অতিকথা বললাম, কারণ ক্ষুদ্র সাফল্যের চেয়ে মহৎ ব্যর্থতা অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত। কথাগুলো গুছিয়ে বলার সুযোগ হলো না। যখন একা থাকি, নির্জন পথে একাকী হাঁটি, আমার বাবার কথাগুলো HAUNT করে- ‘আমার ছেলেটি আগের যুগে জম্মালে পয়গম্বর হতো’। আমি ভাবতে থাকি, হয়তো কিছু দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হবে। শেলি তো বলেছেন, ‘পোয়েটস আর দ্য আন-একনলেজড লেজিসলেটরস অব দ্য ওয়ার্ল্ড।’
আমি কতটুকু লেখক, কতটুকু কবি বা অন্য কিছু, সেটাও জানি না। তবু আমাকে লিখতে হবে। লেখাটা আমার কাছে আনন্দের নয়, অত্যন্ত গুরুভার বেদনাময় কর্তব্য। এড়িয়ে যেতে চাই; পারি না।
[ আহমদ ছফার ‘কেন লিখি?’শীর্ষক এই স্মৃতিকথা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত ‘সচিত্র সময়’ সাপ্তাহিকে। স্মৃতিকথায় আহমদ ছফা লেখক হওয়ার অন্তঃপ্রেরণার কথা বলেছেন। তার ব্যক্তি মানস তথা জীবনদৃষ্টি ও লেখকসত্তা বুঝতে লেখাটি সহায়ক হবে। এই মহাত্মা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। আজ তার জন্মদিন। গভীর শ্রদ্ধায় তাকে স্মরণ করে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় লেখাটি রাইজিংবিডি’র পাঠকদের জন্য পুনরায় প্রকাশ করা হলো। সে সময় এটি অনুলিখন করেছিলেন লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী রিশিত খান। লেখাটি তার মাধ্যমেই আমাদের হস্তগত হয়েছে। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা।]
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জুন ২০১৫/রিশিত/রণজিৎ/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন