ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ফিদেল কাস্ত্রো কেমন লোক ছিলেন?

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৭ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফিদেল কাস্ত্রো কেমন লোক ছিলেন?

মুম রহমান

এই প্রশ্নর উত্তর পাওয়ার আগে আপনাকেই ভেবে দেখতে হবে আপনি আসলে কেমন লোক। আপনি যেমন লোক ফিদোল কাস্ত্রোর পরিচয়টাও তেমন করেই দেয়া যেতে পারে। একটু বিস্তৃত ব্যাখা প্রয়োজন হয়তো আছে।

মার্কিন সরকারের উচ্চ পদস্থ অনেকেই ইতোমধ্যেই স্বস্তি জানিয়েছে বুড়োটা অবশেষে ৯০ বছরে মরলো। মার্কিন প্রশানতো বটেই নিঃসন্দেহে লোকটা যমেরও অপছন্দের ছিলো। সিআইএ এর মতো ঘাগু গোয়েন্দা সংস্থাও শত চেষ্টাতেও লোকটাকে কাবু করা যায়নি। শত বললে আসলে কম হবে, কাস্ত্রো নিজেই বলেছেন অন্তত ৬৪৩ বার তাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। নেহাতই যমের অরুচি বলেই কি লোকটা বারবার বেঁচে গেলো!

না, লোকটা আর যাই হোক তেমন সোজা লোক না। ১২ বছর বয়সে কেউ যদি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে চিঠি লিখে ১০ ডলার চেয়ে থাকে তাকে কি খুব সিধা লোক বলা যায়?

চিঠিটার ফটোকপি এখানে দিয়ে দিচ্ছি। প্রিয় পাঠক, চিঠিটা আপনাদের সুবিধার্থে একটু বাংলায় অনুবাদ করা যাক। বানান ভুল, দূর্বল ইংরেজিতে লেখা হলেও এমন একখান মজার চিঠির নজির বিশ্বে খুব কমই আছে।

 

সান্তিয়াগো, কিউবা

নভেম্বর ৬, ১৯৪০

জনাব ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, প্রেসিডেন্ট অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস

আমার সুজন বন্ধু রুজভেল্ট আমি বেশি ইংরেজি জানি না, তবে আপনাকে লিখতে যতটুক জানা দরকার ততটুক জানি। আমি রেডিও শুনতে পছন্দ করি আর আমি খুব খুশি, কারণ সেখানে শুনলাম, আপনি নতুন (কালের) জন্য প্রেসিডেন্ট হবেন। আমার বয়স বারো। আমি একজন বালক কিন্তু আমি অনেক বেশি চিন্তা করি। কিন্তু আমি চিন্তা করছি না যে আমি ইউনাইটেড স্টেটসের প্রেসিডেন্টকে লিখছি। যদি আপনি ইচ্ছা করেন, আমাকে একটা সবুজ রংয়ের দশ ডলারের আমেরিকান নোট দিয়েন, কারণ কখনো, আমি সবুজ রংয়ের দশ ডলারের আমেরিকান নোট দেখি নাই আর আমি চাই আমরা একটা এ রকম থাকুক।

 

আমার ঠিকানা হলো :

সিনিয়র ফিদেল কাস্ত্রো

কলিগিও দ্য দলোরেস

সান্তিয়াগো দ্য কিউবা

অরিয়েন্টে, কিউবা

আমি বেশি ইংলিশ জানি না কিন্তু আমি অনেক স্প্যানিশ জানি এবং আমার ধারণা আপনি বেশি স্প্যানিশ জানেন না কিন্তু আপনি বেশি ইংলিশ জানেন কারণ আপনি আমেরিকান কিন্তু আমি আমেরিকান না।

(আপনাকে অনেক ধন্যবাদ)

গুডবাই, আপনার বন্ধু

(স্বাক্ষর)

ফিদেল কাস্ত্রো

আপনি যদি জাহাজ বানানোর জন্য লোহা চান আমি তাহলে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় খনিটা দেখিয়ে দিতে পারি। সেগুলো হলো মাইরি অরিয়েন্টে কিউবাতে।’

এই চিঠি পড়ে রুজভেল্ট দশ ডলারের একটা সবুজ নোট পাঠিয়েছিলো কি-না ইতিহাসে সে তথ্য নেই। তবে ইতিহাস বলে ৪৯ বছর কিউবার শাসনতন্ত্রের প্রধান ব্যক্তি হিসাবে কাজ করেছেন কাস্ত্রো এবং এই ৪৯ বছরে ১০ জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের অদল-বদল দেখেছেন। বলা বাহুল্য, এই দশ প্রেসিডেন্টই ফিদেল কাস্ত্রো কি জিনিস তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন। নইলে নিশ্চই তাকে ভালবেসে ৬৪৩ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়নি।

কিউবার একচ্ছত্র শাসন তার হাতে এমনি এমনি আসেনি। দীর্ঘ সংগ্রাম, বিপ্লব আর গেরিলা যুদ্ধের পথ দিয়ে তাকে চলতে হয়েছে। কেমন যোদ্ধা ছিলেন লোকটা, সে কথা বিস্তৃত না-বলেই শুধু এইটুক বলি তিনি দাড়ি কাটতেন না। যৌবনে বিপ্লবের দিনগুলো যখন পাহাড়ে পাহাড়ে লুকিয়ে থেকে আকস্মিক হামলা করতেন তখন দাড়ি রাখাটা তার কাছে ফ্যাশন ছিলো, দাড়ি কাটা ছিলো সময়ের অপচয়। তিনি বলতেন, ‘তুমি যদি দিনে শেভ করার জন্য ১৫ মিনিট হিসাবে খরচ করো, তাহলে শেভের পিছনে বছরে ৫০০০ মিনিট খরচ হবে।’ এই ৫০০০ মিনিট অনর্থক ব্যয় করার সময় তার হাতে ছিলো না।

কাস্ত্রো ধনি পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার বাবার বেশ জমিজমা ছিলো। কিন্তু তিনি সব সময় কাজ করেছেন গরিবদের জন্যই। তিনি বিয়ে করেছেন ধনী পরিবারের কন্যা মির্তা ডিয়াজ বালার্তকে। মির্তা অবশ্য তাকে তালাক দেন যখন কিনা কাস্ত্রো জেলখানায়। তবে জেলখানায় কাস্ত্রোকে নাটালিয়া নামের এক নারী চিঠি লিখতেন। জেল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করেই সেই চিঠি মির্তার চিঠির সঙ্গে অদল-বদল করে দেয়। ফলে তাদের বিয়েটা ভেঙে যায়। তাদের একটি সন্তানও হয়। কাস্ত্রো পাঁচ নারীর গর্ভে নয় সন্তানের পিতা। মির্তা ও কাস্ত্রোর পুত্র ফিদেল কাস্ত্রো ডিয়াজ-বালার্ত বাবার সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছে। বিপ্লবী পিতার পথ ধরে সেও রাশিয়াতে প্রশিক্ষণ নিয়ে আণবিক বিজ্ঞানী হয়েছে।

জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়েই কাস্ত্রো সারা কিউবা ঘুরে তার বিপ্লবী দল তৈরি করেন। কিউবার বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো (তার ভাই) এবং প্রিয়তম বন্ধু চে গুয়েভারাকে নিয়ে বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটান। ১৯৫৯ সালে কিউবার প্রধানমন্ত্রী ও সামরিক প্রধান হিসাবে তিনি তার দীর্ঘ রাজত্বের সূচনা করেন।

আমেরিকার মাতব্বরি ঠেকাতে কাস্ত্রো সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলেন। এমনকি রাশিয়াকে অনুমতি দেন কিউবার দ্বীপে পারমাণবিক বোমা প্রতিস্থাপনেরও। কাস্ত্রোকে কেন্দ্র করে মার্কিন ও সোভিয়েত ঠাণ্ডা লড়াই আরো গরম হয়ে উঠেছিলো।

কিন্তু কাস্ত্রো তার ক্ষমতা ও কর্মনিষ্ঠা চালিয়ে যান। পাঁচ দশক ধরে একটি রাষ্ট্রের শাসক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। রাণী এলিজাবেথ ও থাইল্যান্ডের রাজার পর বিশ্বে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা তৃতীয় শাসক তিনি। ২০০৬ সালে শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি সাময়িকভাবে ভাই ও বিপ্লবের সঙ্গী রাউল কাস্ত্রো দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

বক্তৃতা দেয়া, মানুষকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা ছিলো তার। ১৯৬০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে টানা ৪ ঘণ্টা ২৯ মিনিট বক্তৃতা দিয়ে তিনি সবচেয়ে দীর্ঘতম বক্তৃতার রেকর্ড তৈরি করেন। অন্যদিকে ১৯৯৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে তিনি নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে সাড়ে সাত ঘণ্টা বক্তৃতা দেন।

ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতের কথা তো সবারই জানা। তিনি বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে দেখে তার হিমালয় দেখার সাধ মিটেছে।

এই ফিদেল কাস্ত্রো কিন্তু ভয়াবহ চুরুটখোর ছিলেন। কিউবার বিখ্যাত হাভানা চুরুট ছিল তার খুবই পছন্দ। ১৯৮৫ সালে তিনি এই সিগার খাওয়া ছেড়ে দিয়ে প্রকাশ্যে ধুমপানের অপকারিতা নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘এক বাক্স সিগার নিয়ে তুমি সবচেয়ে ভালো যে কাজটা করতে পারো তা হলো এটা তোমার শত্রুকে উপহার দিতে পারো।’

মার্কিন সাম্রাজ্যের সাথে যতোই খটোমটো থাকুক না কেন, কাস্ত্রোর প্রিয় লেখক ছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। কিউবায় ‘পাপা’ বলে খ্যাত এই লেখকের ‘ফর হুম দ্য বেল টোলস’ তার খুব পছন্দের বই।

ভালো-মন্দ কথা তো অনেক বলা হলো, এ থেকে আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিন ফিদেল ক্যাস্ট্রো লোকটা কেমন ছিলেন। যেমনই থাকুন না কেন গুরুত্বপূর্ণ লোক যে তাতে সন্দেহ নেই। টাইম ম্যাগাজিন যখন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১০০ লোকের তালিকা করে তখন কাস্ত্রোকেও তালিকায় রাখতে হয়।

আর কাস্ত্রোর মৃত্যু দেশে দেশে যেমন শোকের মাতম দেখা দিয়েছে। তেমনি খোদ কিউবা কিংবা আমেরিকার কোথাও কোথাও আনন্দ উৎসবও হয়েছে।

আপনাদের সুবিধার জন্য শেষমেষ ফিদেল কাস্ত্রো সম্পর্কে কথাগুলো একটু পয়েন্ট করে সাজিয়ে দিচ্ছি। শেষবার চোখ বুলিয়ে সিদ্ধান্ত নিন কাস্ত্রো কেমন ছিলেন :

১. বিশ্বে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা তৃতীয় শাসক

২.  দীর্ঘতম বক্তৃতা দানের রেকর্ড

৩. সবচেয়ে বেশি গুপ্ত-হত্যার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করেছেন

৪. আইজেনহাওয়ার, ক্লিনটন থেকে জর্জ বুশ পর্যন্ত দশজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মতবিরোধ করে টিকে ছিলেন

৫. গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী একটি গরুর একদিনে সর্বোচ্চ দুধ দেয়ার রেকর্ড হলো ১১০ লিটার। কিউবার সমবায় কৃষি উদ্যোগের নিয়ন্ত্রনেই এটি সম্ভব হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম গরু খামারের এই প্রকল্পের নাম উবরে ব্ল্যাঙ্কা, যার মালিক ও উদ্যোক্তাও ফিদেল কাস্ত্রো। 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ নভেম্বর ২০১৬/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়