ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ক্যাথিড্রাল || রেমন্ড কার্ভার

অভিজিৎ মুখার্জী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩২, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ক্যাথিড্রাল || রেমন্ড কার্ভার

আমার স্ত্রীর পুরনো বন্ধু এই প্রবীণ আমাদের সঙ্গে একটা রাত কাটাতে আসছেন। ওর স্ত্রী গত হয়েছেন। প্রয়াতা স্ত্রীর আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে উনি এসেছিলেন কানেকটিকাটে। তাদের বাড়ি থেকেই আমার স্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। ব্যবস্থা হয়ে গেল। ট্রেনে আসবেন, ঘণ্টা পাঁচেক লাগবে, আমার স্ত্রী স্টেশনে গিয়ে নিয়ে আসবে। সেই যে বছর দশেক আগে সিয়্যাটলে এক গ্রীষ্মে ওর কাছে কাজ করেছিল, তার পরে আমার স্ত্রীর আর ওকে দেখে নি। কিন্তু ওদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। কথা টেপ করে চালাচালি করতো। উনি যে আসছেন এতে আমার উৎসাহ তেমন কিছু ছিল না। একে তো চিনিই না, তার ওপরে অন্ধ, কেমন একটা লাগছিল। অন্ধদের সম্বন্ধে আমার যাবতীয় ধারণা সিনেমা দেখে। ওরা ধীরে ধীরে হাঁটে, কখনও হাসে না। কুকুরেরা এদের পথ নির্দেশ করে নিয়ে যাচ্ছে-এরকমও দেখেছি। আমার বাড়িতে একজন অন্ধ লোক, এটা খুব একটা কাঙ্ক্ষিত ছিল না।

সিয়্যাটলে সেই গ্রীষ্মে একটা কাজ পাওয়া আমার স্ত্রীর পক্ষে জরুরি হয়ে পড়েছিল। হাতে তখন পয়সাকড়ি একদম নেই। গ্রীষ্মের শেষে বিয়ে হবে একজনের সঙ্গে, সেই ব্যক্তি তখন সামরিক অফিসারের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তার কাছেও কোনো পয়সা নেই। অথচ আমার স্ত্রীও তখন তার গভীর প্রেমে, সেও আমার স্ত্রীর প্রেমে, যেমন হয় আর কি। খবরের কাগজে একটা কিছু চোখে পড়ল। অন্ধকে পড়ে শোনানোর জন্য সহকারী চাই, সঙ্গে একটা ফোন নম্বর। ফোন করে চলে গেল এবং তৎক্ষণাত কাজটায় বহাল হয়ে গেল। গ্রীষ্মজুড়ে এই অন্ধ ভদ্রলোকের কাছে কাজ করেছিল আমার স্ত্রী। নানা জিনিস পড়ে শোনাতে হতো, একেকটা কেসের খুঁটিনাটি, রিপোর্ট, এইসব। কাউন্টির স্যোশাল সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের অফিসটা ওঁর সহায়তায় ভদ্রলোক আরেকটু গুছিয়ে নিলেন। ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গেল ওদের মধ্যে; সেই অন্ধ ভদ্রলোক আর আমার স্ত্রী। এসব আমি জানলাম কী করে? স্ত্রী বলেছে আমাকে। আরও একটা জিনিস বলেছে। ভদ্রলোকের অফিসে কাজের শেষ দিনে অন্ধ ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, উনি ওর মুখটা ছুঁয়ে দেখতে পারেন কি না? ও রাজি হয়েছিল। ও আমাকে বলল যে, ভদ্রলোক আঙুল দিয়ে মুখের সর্বত্র স্পর্শ করলেন, ওর নাক, এমনকি গলা!

আমার স্ত্রী এটা ভুলতে পারেনি। এমনকি একটা কবিতা লেখারও চেষ্টা করেছিল এ নিয়ে। সব সময় কবিতা লেখার একটা তাগিদ থাকত ওর মধ্যে। বছরে একটা কি দুটো কবিতা ও লিখতোই, সাধারণত ওর পক্ষে একটু গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটলেই।


আমরা ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ার পর প্রথম দিকেই ও আমাকে কবিতাটা দেখিয়েছিল। কবিতাজুড়ে ও স্মৃতিচারণ করছে সেই আঙুলগুলোর, কীভাবে সেগুলো ওর মুখের ওপর নড়াচড়া করছিল। আর ছিল সেই সময় ওর কী রকম অনুভূতি হচ্ছিল, বিশেষ করে যখন অন্ধ ভদ্রলোকের আঙুল ওর ঠোঁট আর নাক ছুঁয়ে গেল, তখন কী মনে হয়েছিল। এটুকুই মনে আছে যে, আমি কবিতাটির মধ্যে তেমন কিছু পাইনি। অবশ্যই সেটা ওকে বলার প্রশ্নই ওঠে না, আমিই সম্ভবত কবিতা জিনিসটা বুঝি না। এটুকু স্বীকার করছি যে, কিছু একটা পড়তে চাইলে মোটেই আমি প্রথমেই কবিতার দিকে হাত বাড়াই না। যাই হোক, এদিকে আমার স্ত্রীর কৃপা প্রথম যে লোকটির ওপর বর্ষেছিল, সেই হবু সামরিক অফিসার, সে কিন্তু ওর একেবারে বাল্যপ্রেমিক। সুতরাং ঠিকই আছে। অর্থাৎ গ্রীষ্মের শেষে আমার স্ত্রী সেই অন্ধটিকে মুখের ওপর হাত বোলাতে দিল, তারপর তার থেকে বিদায়, বাল্যপ্রেমিক ইত্যাদিটিকে বিয়ে করলো, সে এখন কমিশনড্ অফিসার, তারপর সিয়্যাটল ছেড়ে গেল। কিন্তু যোগাযোগ ছিল, আমার স্ত্রীর আর সেই অন্ধ ভদ্রলোকের মধ্যে। প্রায় একবছর পরে ও-ই প্রথম যোগাযোগ করে। অ্যালাবামার এক এয়ারফোর্স ঘাঁটি থেকে একদিন রাতের বেলা ফোন করে ভদ্রলোককে- কথা বলতে চেয়ে। কথা হলো। কেমন কাটছে জানিয়ে সেটা টেপ করে পাঠাতে অনুরোধ করলেন ভদ্রলোক। তা-ই করে পাঠালো ও। টেপে সেই অন্ধকে ও জানালো ওর স্বামীর কথা এবং সৈন্যাবাসে দাম্পত্যজীবন সম্পর্কেও। জানালো যে, স্বামীকে ও খুবই ভালোবাসে কিন্তু থাকার জায়গাটা ওর একদম পছন্দ নয়, তদুপরি স্বামী যে মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত সেটাও ভালো লাগছে না। ও যে একটা কবিতা লিখেছে, তাতে যে উনি আছেন সেটাও জানানো হলো, এয়ারফোর্স অফিসারের স্ত্রী হওয়াটা যে কেমন তা নিয়ে ও তখন আরেকটা কবিতা লিখছিল তা-ও জানালো। কবিতাটা অবশ্য তখনও শেষ হয়নি, তখনও লিখছে। অন্ধও একটা টেপ তৈরি করলেন। পাঠালেন সেটা আমার স্ত্রীকে। আমার স্ত্রীও একটা টেপ পাঠালো। বছরের পর বছর এরকম চললো। স্ত্রীর সেই অফিসার তখন একটার পর একটা নানা বিমানঘাঁটিতে বদলি হচ্ছে। মুডি এ.এফ.বি. থেকে ম্যাকগোয়াইর, ম্যাক-কানেল এবং শেষটায় স্যাক্রামেন্টোর কাছে ট্র্যাভিস থেকে স্ত্রী টেপ পাঠাল। আর এই ট্র্যাভিসেই এক রাতে ওর মনে হলো যে, ও খুব একা এবং এই ভ্রাম্যমান জীবনে যেসব লোকের থেকে দূরে যেতে হচ্ছে তারা সবাই হারিয়েই যাচ্ছে। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না, এটাও ওর মনে হলো। ওষুধের আলমারি খুলে যত রকম বড়ি, ক্যাপসুল ছিল, গলায় একটু জিন ঢেলে, সেসবই গিলে ফেললো। তারপর হটবাথ নিতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।


অথচ মরল না, তার জায়গায় খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়লো। বমি হয়ে গেছিল সব। ওর ঐ অফিসার- নাম দিয়ে আর কী হবে? বাল্যপ্রেমিক, এর বেশি আর কী চাই? কোথাও গিয়েছিল, বাড়ি ফিরে দেখে ঐ অবস্থা, তক্ষুণি অ্যাম্বুলেন্সে খবর দেয়। যথাসময়ে সবকিছুই টেপে ধরে ও সেটা অন্ধ ভদ্রলোকের কাছে পাঠিয়ে দেয়। বেশ ক’বছর ধরে হেন কিছু নেই যা ও টেপে জানাচ্ছিল না, এমনকি বিচ্ছেদও যে হতে পারে তা-ও জানিয়েছিল। আমার মনে হয়, কবিতার পরেই ওর কাছে বিনোদনের মুখ্য উপায় হয়ে উঠেছিল ঐ টেপ। কোনো একটা টেপে ও অন্ধকে জানালো যে, এবার ও ঠিক করেছে কিছুদিন ঐ অফিসারের থেকে দূরে অন্যত্র কাটাবে। তারপর আরেকটার মাধ্যমে গেল ডিভোর্সের খবর। এবার ওর ঘনিষ্ঠ হলাম আমি এবং সেটা যথারীতি ওর অন্ধের কানে উঠলো। যাবতীয় কিছু লোকটিকে বলা চাই, অন্তত আমার তা-ই মনে হয়েছিল। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আমি অন্ধ ভদ্রলোকের টেপ শুনতে চাই কি না; বছরখানিক আগে। এও বলল, আমি নাকি সেই টেপে আছি। অগত্যা আমি বললাম, ঠিক আছে শুনবো। পানীয়-টানিয় নিয়ে দুজনে শোবার ঘরে গিয়ে জাঁকিয়ে বসলাম। শোনার জন্য তৈরি। প্রথমে টেপটা প্লেয়ারের মধ্যে ঢুকিয়ে ও কয়েকটা ডায়াল ঘুরিয়ে ঠিকঠাক করে নিল। তারপর একটা হাতলে চাপ দিল। যন্ত্রটা একটা তীক্ষ্ম শব্দ করে উঠতেই কেউ একজন বেশ জোরালো গলায় কথা বলতে লাগলো। ও গিয়ে আওয়াজটা একটু কমালো। কয়েক মিনিট নিরীহ একথা সেকথার পরই একবার আমি এই সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকটির কণ্ঠে আমার নিজের নাম শুনলাম- এক অন্ধ যাকে আমি চিনি না পর্যন্ত। আর তার পরেই: ‘তুমি যা যা বলেছো ওর সম্বন্ধে, তাতে এটুকুই বলতে পারি...।’ কিন্তু তখুনি কী একটা বিঘ্ন ঘটলো, দরজায় কেউ টোকা দিল, বা অন্য কিছু তারপরে আর ফিরে এসে টেপটা শোনা হয়ে ওঠেনি, হয়তো ওইটুকুই। যতটুকু দরকার হয়তো শোনা হয়ে গেছে।


এই সেই অন্ধ ভদ্রলোক যিনি আসছেন রাত কাটাতে।

‘বোলিং-এ নিয়ে যেতে পারি আমি ওনাকে,’ স্ত্রীকে একবার বললাম।

আলুর খোসা ছাড়াচ্ছিল ড্রেইনিং বোর্ডের ওপর। হাতের ছুরিটা নামিয়ে রেখে ঘুরে দাঁড়াল।

‘দ্যাখো, যদি আমাকে ভালোবাসো,’ ও বলে, ‘আমাকে ভালোবাসলে এটুকু তুমি নিতেই পারবে, আর যদি ভালো না বাসো, তাহলো আর কী করা। তবে, যদি তোমার কোনো বন্ধু থাকতো, যেকোনো বন্ধু, আর সে আসতো দেখা করতে, আমি কিন্তু তার যত্নআত্তি করতাম।’

বলে ডিশটাওয়েল দিয়ে হাতটা মুছে নেয়।

‘আমার কোনো অন্ধ বন্ধু নেই,’ আমি বলি।

‘তোমার কোনো বন্ধুই নেই,’ ওর জবাব। ‘আবার কী, তাছাড়া,’ বলতে থাকে, ‘এমনই কপাল, লোকটার স্ত্রী মারা গেছেন। তোমাকে বোঝাতে পারছি? এই লোকটির স্ত্রী আর নেই।’ আমি কোনো জবাব দিইনি। অন্ধের স্ত্রী সম্বন্ধে ও খানিকটা বললো। নাম ছিল বেউলা। বেউলা ! এরকম তো কালারড মহিলাদের নাম হয়।

‘স্ত্রী কি নিগ্রো ছিলো?’ আমি জিজ্ঞেস  করি।

‘মাথাটা কি একেবারে গেছে?’ আমার স্ত্রী বলে ওঠে।

‘চ্যাংড়ামো করবার চেষ্টা করলে, না কি অন্য কিছু?’ বলে একটা আলু হাত দিয়ে তুলে নেয়। দেখতে পেলাম ওটা হাত থেকে পড়ে গেল, তারপর গড়িয়ে চলে গেল ষ্টোভের নিচে। ‘কী হয়েছেটা কী তোমার?’ আবারও বলে। ‘ড্রিংক করেছো?’

‘এমনি জিজ্ঞেস করলাম,’ আমি বলি। ব্যস, তক্ষুণি স্ত্রী এত কথা জানালো আমাকে যা আমি মোটেও জানতে চাইনি। একটা ড্রিংক তৈরি করে এনে শোনার জন্য বসলাম রান্না ঘরের টেবিলে। টুকরো টুকরো টুকরো গল্প জুড়ে জুড়ে গিয়ে আস্তে আস্তে কিছুটা বোধগম্য হচ্ছিল।


যে গ্রীষ্মে আমার স্ত্রী কাজ করে এসেছিল, তার পরের গ্রীষ্মে সেই অন্ধ ভদ্রলোকের কাজ করতে গিয়েছিল বেউলা। তার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বেউলা আর অন্ধ চার্চে গিয়ে বিয়ে করে। খুবই সীমিত আয়োজনে সাদামাটা বিয়ে- প্রথমত, কে আর যেচে যাচ্ছে এরকম একটা বিয়েতে? - ওরা দুজন, চার্চে বিয়ের মিনিস্টার আর মিনিস্টারের স্ত্রী। তাহলেও চার্চে গিয়ে বিয়ে পুরোদস্তুর। ভদ্রলোকের থেকে জানা গেছে যে, এটায় বেউলার খুব সাধ ছিল। কিন্তু মনে হয় বেউলা গ্ল্যান্ডে ক্যান্সার নিয়েই গিয়েছিল বিয়েটা করতে। তারপর আটটি বছর একেবারে অবিচ্ছেদ্য ভাবে থাকার পর- আমার স্ত্রীর ভাষায়, অবিচ্ছেদ্য বেউলার স্বাস্থ্যের খুব দ্রুত অবনতি হতে থাকে। মারা যায় সিয়্যাটলের এক হাসপাতালে, অন্ধ তার পাশে বসা তখন, ওর হাত ধরে। ওদের বিয়ে হলো, একসঙ্গে থাকলো, কাজ করলো, শুলো একসঙ্গে, ...নিশ্চয়ই যৌন সংসর্গও হয়েছিল... আর সবকিছুর পরে অন্ধকে গিয়ে কবরে দিয়ে আসতে হলো তার স্ত্রীকে। এত কিছু করলোও, সেই হতভাগিনী যে দেখতে কেমন ছিল সেটা আর ওর কখনোই জানা হয়ে উঠল না। আমি এটা ভেবে একটু হতবুদ্ধিই হয়ে গেলাম। শুনে অন্ধের জন্য মনটা একটু খারাপই হয়ে রইল। তারপর একসময় আমি ভাবতে শুরু করলাম কী করুণ জীবনই না এই মহিলা কাটিয়ে গেলেন। ভালোবাসার জনটির চোখে যে তিনি কেমন সেটা পর্যন্ত মহিলার জানার উপায় ছিল না। দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছিল অথচ ভালোবাসার মানুষটার থেকে সামান্য তারিফটুকুও একবার জুটলো না। এমন এক মহিলা যার স্বামী তার কোনো অভিব্যক্তিই কোনোদিন টের পেল না, কষ্টই হোক, বা আরেকটু ভালো কিছু। মেক-আপ করলেন কি করলেন না... স্বামীর তাতে কী আসে যায়? চাইলে এমনকি এক চোখে সবুজ আই-শ্যাডো, নাক বিঁধিয়ে একটা সোজা পিন, হলুদ স্ল্যাক্স আর বেগুনি জুতোও পরতে পারতেন, কিছুই হতো না। তারপর এসে গেল মৃত্যু, ওর হাতের ওপরে অন্ধের হাত, অন্ধের চোখ থেকে অশ্রুর ধারা... আমি তখন মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি, শেষ মুহূর্তে হয়তো মহিলা ভাবছিলেন: লোকটি কোনোদিন জানতেই পেল না উনি দেখতে কেমন, আর উনি ধেয়ে চলেছেন মৃত্যুর দিকে। রবার্টের জন্য পড়ে রইল তখন একটা ছোটখাটো বীমার পলিসি আর কুড়ি পেসোর মেক্সিকান পয়সার এক অর্ধেক। অন্য অর্ধেক মহিলার সঙ্গে চলে গেল কাঠের বাক্সের ভেতর। কী নিদারুণ! সঠিক সময়টি গড়িয়ে চলে আসতেই আমার স্ত্রী স্টেশনের দিকে রওনা দিলো ওকে আনতে। কিছুই তখন আর করার নেই, বসে অপেক্ষা করা ছাড়া... হ্যাঁ, লোকটাকে তার জন্য দায়ী করলাম বই কি। খানিকটা পানীয় নিয়ে বসে টিভি দেখছিলাম, এমন সময় গাড়ি এসে দাঁড়ানোর আওয়াজ পেলাম। গ্লাস হাতে সোফা থেকে উঠে জানালার কাছে গেলাম দেখতে।


দেখলাম গাড়ি পার্ক করতে করতে আমার স্ত্রী হাসছে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করলো, দেখতে পেলাম। তখনও মুখে হাসিটি লেগে। আশ্চর্য ব্যাপার। ঘুরে গাড়িটার অন্য পাশে চলে গেল, সেখানে ততক্ষণে অন্ধ ভদ্রলোক নামার উদ্যোগ করছেন। অন্ধের, চোখে পড়ার মতো লম্বা দাড়ি! অন্ধের আবার দাড়ি! ভাবুন একবার। পেছনের সিট থেকে ভদ্রলোক একটা স্যুটকেস টেনে নামালেন। আমার স্ত্রী গিয়ে ওর হাত ধরলো, গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে কথা বলতে বলতে গ্যারাজ থেকে ওকে নিয়ে নেমে এসে কয়েকটা সিঁড়ি উঠে এল, একেবারে সামনের পর্চে। টিভিটা বন্ধ করলাম, পানীয়টুকু শেষ করে গ্লাস ধুয়ে হাত শুকিয়ে নিলাম। তারপর এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে।

আমার স্ত্রী বলল, ‘এই যে দ্যাখো, রবার্ট। রবার্ট, আমার স্বামী। আমি ওর সম্বন্ধে সবই আপনাকে বলেছি।’ উৎসাহে উজ্জ্বল তখন ওর মুখ। অন্ধের কোটের হাতা তখনও হাতে ধরা।

স্যুটকেসটা ছেড়ে দিয়ে অন্ধ ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি ধরলাম সেই হাত। জোরে চাপ দিয়ে হাতটা ধরে রইলেন খানিক, তারপর ছেড়ে দিলেন।

ঘোষণা করলেন, ‘মনে হচ্ছে  কোথাও আগেই পরিচয় হয়েছিল।’

‘আমারও মনে হচ্ছে,’ ‘আমি বলালাম। এছাড়া আর কী বলব বুঝতে পারলাম না। তারপর বললাম, ‘খুব ভালো লাগছে, আপনার কথা অনেক শুনেছি।’ সবাই এবার চলতে শুরু করলাম, ছোটখাটো দল একটা, পর্চ থেকে বসার ঘরের দিকে, আমার স্ত্রী ওর হাতটা ধরে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। অন্ধের অন্য হাতে তার স্যুটকেস। আমার স্ত্রী তখন, ‘রবার্ট, একটু বাঁ দিকে। হ্যাঁ, হ্যাঁ। এবার একটু দেখে, চেয়ার আছে একটা। এই তো, হ্যাঁ, এখানেই বসুন। এটা একটা সোফা। দুসপ্তাহ আগে কিনেছি সোফাটা,’ এরকম সব বলে যাচ্ছে।


পুরনো সোফাটা নিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। আমার বহুদিনের পছন্দের জিনিস ওটা। কিন্তু কিছু বললাম না। তারপর ভাবলাম অন্য কিছু নিয়ে বলি, সাধারণ কথাবর্তা, হাডসন নদীর গা বরাবর আসার পথে দুধারের দৃশ্য ইত্যাদি। কেন নিউ ইয়র্কে যাওয়ার পথে ট্রেনের ডান দিকে বসা উচিত আর আসার সময় বাঁ দিকে।

‘ট্রেনে কেমন এলেন?’ আমি শুধোই। ‘কোন দিকটায় বসলেন ট্রেনে?’

‘কী একখানা প্রশ্ন, কোন দিকটায়! স্ত্রী বলে ওঠে। ‘কী আসে যায় তাতে?’

‘এমনিই জিজ্ঞেস করলাম,’ আমি বলি।

‘ডানদিকে,’ অন্ধ বলে ওঠেন। ‘চল্লিশ বছর প্রায় হতে চলল, কখনও ট্রেনে উঠিনি এর মধ্যে। সেই কবে বাচ্চা বয়সে, বাড়ির অন্যদের সঙ্গে। কতদিন হয়ে গেল তারপর। কেমন লাগে সেটাই ভুলতে বসেছিলাম। এখন তো দাড়িতে শীত এসে পড়েছে,’ বলতে থাকেন।

‘সেইরকমই তো শুনি। আচ্ছা, আমাকে কি খেয়াল করার মতো দেখতে, মাই ডিয়ার?’ আমার স্ত্রীকে ভদ্রলোকে বলেন এবার।

‘খুবই খেয়াল করার মতো দেখতে,’ স্ত্রী উত্তর দেয়। তারপর বলে, ‘রবার্ট, আপনাকে দেখেলেই ভালো লাগে।’

অন্ধের দিক থেকে চোখ সরিয়ে এবার আমার দিকে তাকায়। তাকিয়ে যা চোখে পড়ে, মনে হয় সেটাতে খুব খুশি হতে পারেনি। আমি ঘাড় ঝাঁকাই।

সত্যি বলতে কি, আমি আগে কখনও অন্ধ ভদ্রলোককে চিনতামও না, কখনও আলাপও হয় নি। চল্লিশের শেষের দিকে ওর বয়স, একটু ভারী চেহারা, টাক আছে, কাঁধটা একটু ঝোঁকানো, যেন কাঁধে কোনো ওজন বহন করছেন। পরনে বাদামি রঙের স্ল্যাক্স, বাদামি জুতো, হালকা বাদামি শার্ট, টাই আর স্পোর্টস কোট। রীতিমতো প্যাশনেবল। লম্বা দাড়ি তো আছেই। কিন্তু লাঠি বা কালো চশমা, এসব কিছুই নেই। আমার চিরকাল ধারণা ছিল অন্ধদের কালো চশমা পরতেই হয়। আসলে, আমার নিজের খুব শখ ছিল ওরকম একটা কালো চশমার। প্রথম দর্শনে অন্য যে কারো চোখের মতোই ওর চোখ। কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে, একটু ফারাক আছে। একে তো অক্ষিগোলটা অত্যধিক সাদা, তার ওপর মণি দুটো চোখের কোটরে এমনভাবে নিজে থেকেই ঘুরতে থাকে যা উনি জানেনও না, থামাতেও পারবেন না। গা শিরশির করে ওঠে। মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দেখতে পেলাম, বাঁ দিকের মণিটা ঘুরে নাকের দিকে যেন চেয়ে আছে আর অন্যটা একই জায়গায় স্থির থাকার চেষ্টা করছে। ওই চেষ্টা পর্যন্তই, ওর অজ্ঞাতসারে, নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে মণি দুটোই ঘুরেই চলেছে।

বলালাম, ‘একটা ড্রিংক তৈরি করে আনি। আপনার কী পছন্দ? আমাদের প্রায় সবরকমই খানিকটা করে মজুদ আছে। আমাদের নানা শখের মধ্যে এটাও একটা।’

‘মশাই, আমি নিজে একজন স্কচ-ম্যান,’ জোরালো গলায় বেশ দ্রুত বললেন।

‘বেশ তো,’ আমি বলি। কিন্তু ‘মশাই’! আমারও সেরকমই মনে হয়েছিল।’

আঙুল দিয়ে স্যুটকেসটা ছুঁলেন, সোফার পাশেই ওটা রাখা ছিলো। একটু যুৎ মতো, স্বচ্ছন্দ হয়ে নিতে চাইছেন। দোষ দেওয়া যায় না।

‘ওটা আমি আপনার ঘরে তুলে দেব,’ আমার স্ত্রী বলে।

‘লাগবে না,’ বেশ বাজখাই গলায় অন্ধ জানায়। ‘আমি যখন যাবো এটাও তখন গেলেই হবে।’

‘স্কচের সঙ্গে একটু জল?’ জিজ্ঞেস করি।

‘খুবই অল্প,’ উনি উত্তর দেন।

‘এটাও আমি জানতাম,’ আমি বলি।

এবার অন্ধ বলেন, ‘এক ফোঁটা। সেই যে আইরিশ অভিনেতা ব্যারি ফিটজেরাল্ড? আমিও তারই মতো। যখন জল খাই, ফিটজেরাল্ড বলতো, জলই খাই। যখন হুইস্কি খাই, তখন শুধু হুইস্কি।’ আমার স্ত্রী হেসে ওঠে। অন্ধ হাতটা তুলে দাড়ি অবধি নিয়ে আসে না। দাড়িটা একটু তুলে আবার ছেড়ে দেন। আমিই বানালাম ড্রিংকস, তিনটে বড়ো গ্লাসে স্কচ আর এক ঝাপটা করে জল তাতে। তারপর, আরাম করে বসে রবার্টের আসার প্রসঙ্গে কথাবার্তা শুরু হলো। প্রথমে তো ওয়েস্ট কোস্ট থেকে কানেকটিকাট অবধি দীর্ঘ বিমানযাত্রার কথা, সেটা শেষ হলে কানেকটিকাট থেকে ট্রেনে এখানে আসা। এই শেষ পর্যায়টার জন্য আমরা আরেকবার করে ড্রিংকস নিলাম।


কোথায় যেন পড়েছিলাম বলে মনে পড়ছে যে, অন্ধরা ধূমপান করে না, আন্দাজ করা হয় যে, এর কারণ হলো তারা ধোঁয়া ছেড়ে সেটা দেখতে পায় না। জ্ঞানত এইটুকু আমি অন্ধদের সম্বন্ধে জানতাম এবং নেহাত এটুকুই। কিন্তু এই অন্ধ ভদ্রলোক দিব্যি একেবারে গোড়া অবধি সিগারেট টানলেন এবং তারপর আরেকটা ধরালেন। অ্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়ছিলেন আর ভরে আমার স্ত্রী গিয়ে সেটা খালি করে এল।

ডিনারের টেবিলে বসে আমরা আরেকটা করে ড্রিংকস নিলাম। আমার স্ত্রী রবার্টের প্লেট ভর্তি করে দিল কিউব স্টেক, স্ক্যালোপড পোটেটো (ক্রীমে সেঁকা আলু) আর গ্রীন বীনস দিয়ে। আমি দু স্লাইস পাঁউরুটিতে মাখন লাগিয়ে দিলাম। দিয়ে বললাম, ‘এই আপনার ব্রেড অ্যান্ড বাটার।’ আমার ড্রিংকস খানিকটা গলায় ঢেলে নিয়ে বললাম,‘ আসুন প্রার্থনাটা সেরে নিই,’ ভদ্রলোক অমনি মাথা নোয়ালেন, আমার স্ত্রী তখন হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে। ‘প্রার্থনা যে করছি, ফোনটা বেজে উঠবে না আর খাবারও ঠান্ডা হয়ে যাবে না,’ এবার আমি বলি।

তারপর জাঁকিয়ে বসে শুরু করে দিলাম। টেবিলে খাবার যা যা ছিল সব খাচ্ছিলাম। যেন কাল থেকে আর খেতে পাব না, এভাবে খেলাম। মুখে কোনো কথা নেই। কেবল খেয়ে চলেছি। খাওয়া নিয়ে মশকরা, খুঁটে খাওয়া, কী না করলাম। অসম্ভব গুরুত্ব দিয়ে, রীতিমতো সিরিয়াসলি খেতে থাকলাম। অন্ধ কিন্তু প্রথমেই বুঝে নিল প্লেটে কোথায় কোথায় কী কী আছে। মাংসের ওপর ওর ছুরি-কাঁটাচামচ চালানো সপ্রশংস চোখে দেখলাম। মাংসটাকে দুটুকরো করে কাঁটাচামচ দিয়ে তার থেকে একটা টুকরো মুখে পুরছিলেন, তারপরেই হাত বাড়াচ্ছিলেন স্ক্যালোপড পোটেটোর দিকে, তারপর বীনস এবং শেষে মাখন লাগানো রুটি ছিঁড়ে নিয়ে মুখে দিচ্ছিলেন। প্রত্যেকবার এটা করেই দুধে একটা বড় চুমুক। মাঝে মাঝেই আঙুল কাজে লাগাতেও দ্বিধা করছেন না, খেয়াল করলাম।


সব নিঃশেষে সাবড়ে দিলাম, এমনকি একটা পুরো স্ট্রবেরি পাইয়ের অর্ধেকটা। কিছুক্ষণ যেন ঘোরের মধ্যে বসে ছিলাম। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তারপর একসময় সমস্ত জঞ্জাল ওখানে ফেলে রেখে টেবিল থেকে উঠে পড়লাম। ওদিকে আর তাকাইওনি। কোনোক্রমে বসার ঘরে পৌঁছে আবার যে যার পুরনো জায়গায় গিয়ে শরীর ছেড়ে দিলাম। রবার্ট আর আমার স্ত্রী সোফার ওপরে আর আমি বড় চেয়ারটাতে। গত দশ বছরে উল্লেখযোগ্য কী কী ঘটে গেছে সেই নিয়ে ওরা কথাবার্তা চালাতে আমরা দুই কি তিনবার ড্রিংকস নিলাম। আমি প্রধানত শ্রোতার ভূমিকায়। কখনো সখনো এক আধটা কথা বলছি। আমার লক্ষ্য ছিল ভদ্রলোকের যেন মনে না হয় আমি ঘর ছেড়ে চলে গেছি আর আমার স্ত্রীর যেন মনে না হয় আমি কী করবো বুঝে পাচ্ছি না। ওদের কথার মূল প্রসঙ্গ হলো কী কী ওদের ঘটেছে- ওদের! এই গত দশ বছরে। আমি বৃথাই প্রত্যাশায় রইলাম যে আমার স্ত্রীর ঠোঁটে মিষ্টি করে দু-একবার আমার নামটা শুনতে পাবো। ‘তারপরে তো আমার স্বামী ভাগ্যিস আমার জীবনে এলো’- এরকম কিছু একটা শুনবো ভেবেছিলাম। কিন্তু সেরকম কিছু কানে এলো না। বেশিটাই রবার্ট প্রসঙ্গে। রবার্ট এর মধ্যে কী না করেছেন, সবই একটু আধটু করেছেন বলে মনে হলো। রীতিমতো একজন অন্ধ জ্যাক অব অল ট্রেডস। তবে যেটা সাম্প্রতিকতম ব্যাপার সেটা হলো, রবার্ট আর তার স্ত্রী একটা অ্যামওয়ে ডিসট্রিবিউটরশিপ নিয়েছিলেন, যা বুঝলাম, তার থেকেই ওদের জীবিকা নির্বাহ হতো, যেভাবে হচ্ছিল আর কি। অন্ধ আবার একজন হ্যাম-রেডিও অপারেটরও বটে। জোরালো কণ্ঠস্বরে তিনি বিবরণ দিলেন গুয়াম, ফিলিপিনস, আলাস্কা, এমনকি তাহিতিও অন্যান্য অপারেটরের সঙ্গে তার কী ধরণের কথাবার্তা হয়েছে। ওসব জায়গায় যেতে চাইলে যে অজস্র বন্ধু আছে সর্বত্রই তা-ও বললেন। মাঝে মাঝে দৃষ্টিহীন মুখটা আমার দিকে করে, দাড়ির নিচে হাতটা এনে, আমাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করছিলেন। এখন যেখানে কাজ করি সেখানে কতদিন কাজ করছি? (তিন বছর) কাজটা ভালো লাগে কি না? (না, লাগে না) এটাতেই লেগে থাকবো কি না? (আর উপায় কী?) যখন দেখালাম যে এবার কথা ফুরিয়ে আসছে, আমি উঠে টিভিটা অন করে দিলাম।

 


অলঙ্করণ : অপূর্ব খন্দকার



আমার স্ত্রী খুবই বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালো। আরেকটু হলে ফুঁসে উঠতো। শেষে অন্ধের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রবার্ট, আপনার টিভি আছে?’

অন্ধ বললেন, ‘মাই ডিয়ার, আমার দুটো টিভি আছে। একটা কালার টিভি, আরেকটা সাদা-কালো, ইতিহাসের সামগ্রী। হাসির ব্যাপার, কিন্তু টিভি চালাতে হলে আমি সবসময় কালার টিভিটাই চালাই। হাসি পাচ্ছে না তোমাদের?’

এর উত্তরে কী বলতে হয়? বলার মতো কছুই পাচ্ছিলাম না। অগত্যা খবরের একটা প্রোগ্রাম দেখতে লাগলাম, মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করছিলাম, ভাষক কী বলছে।

‘এটা কালার টিভি,’ অন্ধ বলে ওঠেন। ‘কীভাবে তা জিজ্ঞেস কোরো না, কিন্তু আমি ধরতে পারি।’

‘ক’দিন আগেই আগেরটা দিয়ে এটা নিয়েছি,’ আমি বলি।

ভদ্রলোক আরেকবার পানীয় নিলেন। দাড়িটা একটু তুলে নিয়ে শুঁকলেন, তারপর ছেড়ে দিলেন। সোফায় একটু এগিয়ে বসে অ্যাশট্রেটাকে কফি টেবিলে জায়গা মতো স্থাপন করলেন এবং লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরালেন। এবার হেলান দিয়ে বসলেন সোফায় আর পা দুটো গোড়ালির কাছে পরস্পর আড়াআড়ি করে রাখলেন।

আমার স্ত্রী হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাই তুললো। তারপর একটু আড়মোড়া ভাঙলো। বলল,‘ যাই ওপরে গিয়ে পোশাকটা পালটে নিই। রবার্ট, আপনি কোনো রকম কুণ্ঠা করবেন না। স্বস্তি মতো ...।’

‘আমি দিব্যি আছি,’ অন্ধ বলে দিলেন।

‘আমি চাই আপনি নিজের মর্জি মতো, সুবিধে মতো এ বাড়িতে কাটান,’ স্ত্রী বললো।

‘আমি দিব্যি সুবিধে মাতোই আছি,’ অন্ধ জবাবে বললেন।


স্ত্রী চলে যাওয়ার পর, উনি আর আমি খানিক আবহাওয়ার খবর শুনলাম, তারপর খেলাধুলার খবর। ততক্ষণে এতটাই সময় কেটে গেছে যে ও আবার ফিরে আসবে কিনা অনুমান করতে পারছি না। ভেবেছিলাম, বোধহয় গিয়ে শুয়ে পড়েছে। মনে মনে চাইছিলাম যে, ও নেমে আসুক কারণ এক অন্ধের সঙ্গে একা থাকতে চাইছিলাম না। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ড্রিংকস আর চলবে? বললেন, শিওর। এবার আমি জানতে চাইলাম, আমার সঙ্গে একটু ‘ডোপ’ হয়ে যাবে নাকি! বললাম যে, আমি একটা পাকিয়েছি। আসলে পাকাইনি তখনও, কিন্তু তৈরি হচ্ছিলাম মনে মনে।

‘ট্রাই করি আপনার সঙ্গে একটু,’ উত্তর পেলাম।

‘এই তো,’ আমি বলি, ‘এটাই চাইছিলাম।’

খানিকটা ড্রিংক নিয়ে ওর সঙ্গে সোফায় গিয়ে বসলাম। তারপর বেশ মোটা করে দুটো পাকালাম। একটা ধরিয়ে নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। একেবারে ওর আঙুল অবধি। নিয়ে টান দিলেন।

‘ভেতরে রাখুন যতক্ষণ পারেন,’ বললাম ওকে। বোঝাই যাচ্ছিল একেবারে আনকোরা।

আমার স্ত্রী এমন সময় নেমে এলো। একটা গোলাপি রোব চাপিয়ে আর গোলাপি স্লিপারে পা গলিয়ে।

‘কীসের যেন গন্ধ?’ এসেই জিজ্ঞেস করলো।

‘ভাবলাম একটু ক্যানাবিস হয়ে যাক,’ আমি বলি।

আমার দিকে হিংস্র চাহনি হেনে আমার স্ত্রী অন্ধ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রবার্ট, আপনি যে ডোপ স্মোক করেন আমি জানতাম না তো!’

অন্ধ বলেন, ‘এখন তো করছি। প্রত্যেক জিনিসেরই তো একটা ফার্স্ট-টাইম হয়। কিন্তু এখনও কিছু বুঝতে পারছি না।’

‘এটা খুবই মোলায়েম,’ আমি জানিয়ে দিই। ‘কড়া নয় একদমই, বাড়াবাড়ি কিছু কখনোই হবে না,’ বলি ওদের। ‘ঝামেলায পড়বেন না একদমই।’

‘কিছুই হয়নি ,কিচ্ছুটি না,’ বলে হেসে ওঠেন। আমার স্ত্রী এসে সোফায় আমার আর ভদ্রলোকের মাঝখানে বসে। আমি এবার ওর দিকে এগিয়ে দিই। ও আলতো টান দিয়ে ফিরিয়ে দেয়। ‘কোন দিকে গড়াচ্ছে ব্যাপারটা?’ জিজ্ঞেস করে। তারপর বলে, ‘আমার আর খেয়ে কাজ নেই। এমনিতেই চোখ জড়িয়ে আসছে, খুলে রাখতে পারছি না। ডিনারটা আমায় কাবু করে ফেলেছে। এত খাওয়া উচিত হয়নি আমার।’

‘স্ট্রবেরি পাই, স্ট্রবেরি পাই,’ ভদ্রলোক বলে ওঠেন, ‘ওতেই কাৎ করে দিয়েছে,’ বলে জোরে হেসে ওঠেন। তারপর ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়েন।

‘স্ট্রবেরি পাই কিন্তু আরও আছে,’ আমি বলি।

‘রবার্ট, আরেকটু খাবেন?’ আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করে।

‘একসময় দিও তাহলে,’ উনি উত্তর দেন।


এবার সবাই আবার টিভিতে মনোযোগ দিই। আমার স্ত্রীর আবার হাই ওঠে। বলে, ‘বিছানা কিন্তু করাই আছে রবার্ট, যখন শোবার হবে। সারাদিন যা গেছে, জানি তো। যখন শোবেন বলে ভাববেন, বলবেন।’ ওর হাতটা একটু টেনে ধরে বলে। ‘রবার্ট?’

রবার্টের হুঁশ ফেরে, বলে, ‘আমার তো দারুণ কাটলো। টেপে কি এতটা হয়?’

‘ধন্যবাদ মশাই,’ আমাকে বলেন। ‘তবে, আমর মনে হয় এটার আর দরকার নেই, কিছু একটা যে হচ্ছে এবার টের পেতে শুরু করেছি।’ বলে জ্বলন্ত অবশেষটুকু আমার স্ত্রীর দিকে বাড়িয়ে দেন।

‘আমারও,’ আমার স্ত্রী বলে। ‘একদম একই হচ্ছে,’ বাট-টা নিয়ে আমাকে দিযে দেয়। বলে, ‘আমি এখন খানিকক্ষণ তোমাদের মাঝখানে চোখ বন্ধ করে বসে থাকব, তোমরা কিছু মনে কোরো না যেন। দুজনের কেউই না। ভালো না লাগলে বলবে। না হলে আমি চোখ বন্ধ করে বসেই থাকবো যতক্ষণ না তোমরা ওপরে যাবে বলে ঠিক কর।’ তারপর বলে, ‘রবার্ট, ঘুমোতে চাইলে কিন্তু আপনার বিছানা করাই আছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই আমাদের ঘর আর তার ঠিক পাশেরটাই আপনার। ওপরে যাওয়ার সময় আমরা দেখিয়ে দেব। আমি একেবারে ঘুমিয়ে পড়লে তোমরা জাগিয়ে দেবে কিন্তু।’ বলে চোখ বন্ধ করলো এবং বোঝই গেল, ঘুমিয়ে পড়লো।


খবর শেষ হলো। আমি উঠে চ্যানেল পালটালাম। এসে সোফায় হেলান দিয়ে বসলাম। আমার স্ত্রী এরকম ‘অফ’ না হয়ে গেলেই ভালো হতো। মাথা পেছনে হেলিয়ে রয়েছে, মুখ হাঁ করা। একটু ঘুরে আছে তাই রোবটা পিছলে খানিক সরে গেছে পা থেকে, রসালো উরু দেখা যাচ্ছে। কাপড়টা একটু টেনে ঢেকে দেব বলে এগিয়েই চোখ পড়লো অন্ধের ওপর। ধুত্তোরি! আমি আবার কাপড় যেমন ছিল তেমনই করে দিলাম।

‘স্ট্রবেরি পাইটা যখন খাবেন, বলবেন,’ আমি বলে রাখি।

‘হ্যাঁ, বলবো,’ উনি বলেন।

আমি বললাম, ‘ক্লান্ত লাগছে কি? আমি কি আপনাকে বিছানা অবধি পৌঁছে দেব? শোবেন?’

‘এখনই না,’ উনি জানান। ‘আপনার অসুবিধা না হলে মশাই, আপনার সঙ্গে থাকতে চাইছি। আপনি শুতে না গেলে আমিও জেগে থাকি। আমাদের মধ্যে তেমন একটা কথাই হয়নি। বুঝলেন তো, কী বলছি? সন্ধ্যেটা তো দেখছি আপনার স্ত্রী আর আমিই দখল করে নিলাম।’

দাড়িটা একটু তুলে আবার ছেড়ে দিলেন। সিগারেট আর লাইটারটা তুলে নিলেন তারপর।

‘তা তো হতেই পারে,’ আমি বলি। তারপর বলি, ‘আমার তো বেশ ভালোই লাগছে আপনি থাকাতে।’

মনে হয়, মিথ্যে কিছু বলিনি। প্রত্যেক রাতেই ক্যানাবিস টেনে তারপর যতক্ষণ না ঘুমিয়ে পরি, একাই জেগে থাকতাম রাত অবধি। আমার স্ত্রী আর আমি একসঙ্গে শুতে প্রায় কখনোই যাইনি। ঘুমোতে গেলেই এমন সব স্বপ্ন দেখতাম। কখনো কখনো জেগে উঠতাম ঘুম ভেঙে গিয়ে, বুক ধড়াস ধড়াস করতো।

টিভিতে তখন চার্চ আর মধ্যযুগ নিয়ে কী যেন দেখাচ্ছে। গতানুগতিক যা সব হয় তার চেয়ে একটু আলাদা কিছু। আমি অবশ্য একটু অন্য কিছু দেখতে চাইছিলাম। অন্য চ্যানেলগুলোতে গিয়ে গিয়ে দেখলাম। সেগুলোতেও কিছু নেই। অগত্যা আবার গোড়ার চ্যানেলটাতেই ফিরে এসে ভদ্রলোকের থেকে মাফ চেয়ে নিলাম।

‘আরে না না মশাই,’ অন্ধ ভদ্রলোক বললেন। ‘আমার কোনো অসুবিধা নেই। যা দেখবেন তাতেই হবে। কিছু না কিছু আমি জানতেই পাই। জানার শেষ নেই। আজ রাতেও কিছু জানতে আপত্তি নেই, কান খোলাই রেখেছি,’ উনি বললেন।

কিছুক্ষণ আমরা কোনো কথাই বলিনি। উনি সামনে ঝুঁকে আমার দিকে মুখ করে বসে ছিলেন, ডানদিকের কানটা টিভি সেটের দিকে ফেরানো। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। হঠাৎ হঠাৎ করে চোখের পাতা পড়ে যাচ্ছে, আবার খুলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই দাড়ির ভেতর আঙুল চালিয়ে টান দিচ্ছিলেন, যেন টিভিতে যা শুনছেন তাই নিয়ে কিছু একটা ভাবছেন।

টিভির পর্দায় তখন কাপড়ে মাথা ও কাঁধ ঢাকা একদল লোকের ওপরে হামলা করে অত্যাচার চালাচ্ছে কঙ্কালের পোশাক পরা একদল লোক আর শয়তান সাজা আরেকদল লোক। যারা শয়তান সেজেছে তারা শয়তানের মুখোশ পরেছে, শিং লাগিয়েছে আর সঙ্গে লম্বা ল্যাজ। পুরো দৃশ্যটাই একটা শোভাযাত্রার অংশ বিশেষ। একজন ইংরেজ, যে এটার বর্ণনা দিচ্ছিল, বলল যে বছরে একবার করে স্পেনে এটা হয়। কী হচ্ছে সেটা আমি অন্ধকে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্ট করলাম।

‘কঙ্কাল,’ উনি বললেন। ‘কঙ্কালের ব্যাপারটা জানি,’ বলে মাথাটা সামনে ঝোকালেন।


টিভিতে একটা ক্যাথিড্রাল দেখাল । তারপর, অনেকটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে আরেকটা। তারপরে অবশ্য চলে গেল প্যারিসের সেই বিখ্যাত ক্যাথিড্রালের ছবিতে, তার পাখা মেলে দেওয়া বাট্রেস আর মেঘ ছুঁতে চাওয়া পায়ার্স সব। ক্যামেরা চলে গেল আকাশের কাছে, সেখান থেকে ক্যাথিড্রালের সবটা দেখাবার জন্য।

যে ইংরেজের গ্রন্থনায় পুরো জিনিসটা হচ্ছিল, থেকে থেকে সে চুপ করে যাচ্ছিল, কেবল ক্যামেরা ক্যাথিড্রালের এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তখন। তা না হলে ক্যামেরা চলে যাচ্ছিল গ্রামে ক্ষেতখামারের দিকে, ক্ষেতের ভেতর বলদের পেছন পেছন লোক হাঁটছে, আমি যতক্ষণ পারা যায় অপেক্ষা করলাম। তারপর মনে হলো, এবার কিছু একটা বলি। বললাম, ‘এখন ক্যাথিড্রালের বাইরেটা দেখাচ্ছে। গারগয়েলস। খোদাই করা ছোট ছোট মূর্তি, রাক্ষসের মতো দেখতে। এবার মনে হচ্ছে যেন ইটালিতে কোথাও। হ্যাঁ, ইটালিতেই্ এই একটা চার্চের দেয়ালে ছবি আঁকা।’

‘ফ্রেস্কো পেইন্টিং নাকি মশাই?’ প্রশ্ন করে গ্লাসে চুমুক দেন।

আমি নিজের গ্লাসের দিকে হাত বাড়ালাম। কিন্তু দেখি খালি। বরং যে প্রসঙ্গে ছিলাম সেখানেই ফিরে এলাম, ‘কী বললেন, ফ্রেস্কো কি না?’ আমি বলি। ‘ভালো প্রশ্ন করেছেন, কিন্তু আমি ঠিক বলতে পারব না।’

ক্যামেরা এবার গেল আরেকটা ক্যাথিড্রালে, লিসবন শহরের ঠিক বাইরে। ফ্রেঞ্চ বা ইটালিয় ক্যাথিড্রালের সঙ্গে পর্তুগীজ ক্যাথিড্রালের ফারাক তেমন তো কিছু নয়। কিন্তু কিছু ফারাক আছে। ভেতরের কিছু জিনিসে। এবার একটা কথা আমার মাথায় এলো, আমি প্রশ্ন করলাম, ‘একটা কথা মনে এলো, কথাটা হলো, আপনার কি ক্যাথিড্রাল সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে? অর্থাৎ, দেখতে কেমন হয়, এইসব? বোঝাতে পারলাম তো কী বলতে চাইছি? কেউ যদি আপনাকে বলে ক্যাথিড্রালের কথা, আপনার কি কোনো ধারণা আছে কী নিয়ে কথাটা হচ্ছে? এর সঙ্গে, ধরা যাক, ব্যাপ্টিস্ট চার্চের কী ফারাক তা আপনার জানা আছে?’

ধোঁয়াটা মুখ থেকে ফুক ফুক করে ছেড়ে দিলেন। ‘এটুকু জানি যে শয়ে শয়ে মজুরকে খাটতে হয়েছে পঞ্চাশ কি একশ বছর ধরে এগুলো বানাতে,’ বললেন। ‘এটুকু তো বলতে শুনলামই। এটাও শুনেছি যে, একই পরিবারের বহু পুরুষ বংশানুক্রমে একটাই ক্যাথিড্রাল বানাতে কাজ করে গেছে। এই কাজে যারা জীবন শুরু করেছিল তারা শেষ হওয়া অবধি দেখে যেতে পারে নি। অবশ্য সেদিক থেকে দেখলে তো মশাই, আমাদেরই বা খুব একটা অন্যরকম কি, বলুন?’ বলে হাসলেন। আবার চোখের পাতা ঢুলে এলো। মাথা সামনে ঝুঁকে পড়ল। মনে হলো ঝিমুচ্ছেন। হয়তো কল্পনা করছিলেন যে পর্তুগালে গিয়ে পৌঁছেছেন। টিভিতে ততক্ষণে অন্য একটা ক্যাথিড্রাল দেখাতে শুরু করেছে। এটা জার্মানিতে, ইংরেজের কণ্ঠ তখনও বকবক করেই যাচ্ছে। ‘ক্যাথিড্রাল,’ অন্ধ বলে উঠলেন। সোজা হয়ে বসে মাথাটা সামনে পিছনে দোলাতে লাগলেন। ‘সত্যি বলতে কি মশাই, জানা বলতে মোটামুটি এটুকুই। এই যা এক্ষুণি বললাম। লোকটাকে যা বলতে শুনলাম আর কি। আপনিও তো খানিকটা বিস্তারিত বলতে পারেন আমাকে? যদি বলতেন, ভালো লাগতো। সত্যিটা যদি জানতে চান, বলবো, প্রকৃতপক্ষে তেমন ভালো ধারণা নেই।’


টিভির পর্দার ক্যাথিড্রালটার দিকে প্রাণপণে চেয়ে রইলাম। কিছু বলবো যে, শুরুটাই বা করবো কী করে? কিন্তু যদি এমন হয় যে, আমার জীবিত থাকা নির্ভর করছে এটার ওপর? ধরা যাক, এক উন্মাদ আমাকে হুমকি দিচ্ছে যে, যদি না পারি, তাহলে সে আমার প্রাণনাশ করবে।

আরো কিছুক্ষণ ক্যাথিড্রালটার দিকে চেয়ে রইলাম যতক্ষণ না ছবি আবার ছিটকে গ্রামের দিকে চলে যায়। আর তাকিয়ে লাভ নেই। অন্ধের দিকে ফিরে বললাম, ‘প্রথমেই বলতে হয়, ওগুলো হয় বেশ উঁচু। ঘরের চারপাশে ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখি, যদি কোনো সূত্র পাওয়া যায়। বহু উঁচু অবধি। অনেক উঁচু, অনেক। আকাশছোঁয়া প্রায়। আর এত বড়, বেশ অনেকগুলোই, যে ঠেকনা দেওয়া দরকার হয়ে পড়ে। মানে আর কি, ধরে রাখার জন্য। এই ঠেকনাগুলোকে বাট্রেস বলে। কেন যেন ওগুলো দেখলেই আমার ভায়াডাক্টের কথা মনে হয়। কিন্তু আপনি বোধহয় ভায়াডাক্টও জানেন না, তাই না? কোনো কোনো ক্যাথিড্রালের সামনেটায শয়তান ইত্যাদির মূর্তি খোদাই করা থাকে। কোথাও লর্ডদের, লেডিদের। জিজ্ঞেস করবেন না যেন, কেন,’ আমি বলি।

উনি মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দিচ্ছিলেন। শরীরের উর্দ্ধাংশ পুরোটা সামনে আর পেছনে আসছিল যাচ্ছিল।

‘ঠিক ভালোমতো বলতে পারছি না, না?’ আমি বললাম।

সামনে পেছনে দোলা বন্ধ করে উনি সোফার একেবারে ধার অবধি এগিযে এসে ঝুঁকে বসলেন। আমার কথা শুনতে শুনতে দাড়িতে আঙুল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বুঝতেই পারা যাচ্ছিল যে, কথাগুলো পৌঁছাচ্ছে না। তবুও অপেক্ষা করছিলেন, যাতে আমি কথাটা চালিয়ে যাই। আবার মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দিয়ে জানালেন, যেন আমাকে একটু উৎসাহ বা প্রশ্রয় দিতে চাইছেন। ভাবার চেষ্ট করছিলাম আর কী বলতে পারি। ‘সত্যিই খুব বড়,’ বললাম। ‘বিশাল একেকটা। পাথরে তৈরি। অনেক সময় শ্বেতপাথরেরও হয়। আগেকার সেইসব দিনে, যখন ক্যাথিড্রাল বানানো হতো, মানুষ ঈশ্বরের খুব কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করতো। সেকালে, সকলের জীবনেই ঈশ্বর ছিলেন একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ক্যাথিড্রাল বানানো দেখলেই বোঝা যায়। মাফ করবেন,’ আমি বলে উঠি, ‘মনে হয় এর থেকে বেশি আর পেরে উঠব না। আমাকে দিয়ে এটা হচ্ছে না।’

‘না, না, ঠিকই আছে মশাই,’ অন্ধ ভদ্রলোক বলেন। ‘আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করলে কিছু মনে করবেন? জিজ্ঞেস করবো? খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন, ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’- তে উত্তর। নেহায়েতই কৌতূহল হলো তাই, অন্য কিছু নেই এর মধ্যে। আমি আপনার বাড়িতে এসে উঠেছি, আপনি গৃহস্বামী, জানতে চাইছি, আপনি কি ধর্মে নিষ্ঠাবান, বিশ্বাসী? কিছু মনে করলেন না তো?’

আমি মাথা নাড়ি। যদিও ভদ্রলোকের সেটা নজরে পড়ল না। অন্ধের সামনে মাথা নাড়াও যা, চোখ টিপে দেওয়াও তা-ই।

‘আমি খুব একটা ধর্মবিশ্বাসী নই, কোনো কিছুতেই বিশ্বাসী নই। বিশ্বাস রাখা তো কঠিন, বোঝেনই তো।’

‘হ্যাঁ, তা তো ঠিকই,’ উনি বলেন।

‘সেইটাই,’ আমি যোগ করি।


ইংলিশম্যান তখনও সামনে ঝুঁকে বসে। আমার স্ত্রী ঘুমের মধ্যে একবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর বড় করে নিঃশ্বাস টেনে আবার ঘুমোতে থাকল।

‘আমাকে মাফ করতে হবে,’ বলতে থাকে আমি, ‘ক্যাথিড্রাল কী রকম দেখতে সেটা আমি ঠিক আপনাকে বুঝিয়ে উঠতে পারব না। আমার যোগ্যতায় ওটা হয়ে উঠবে না। যেটুটু বললাম তার বেশি আর কিছু...।

আমার কথা শুনতে শুনতে অন্ধ স্থির হয়ে বসে থাকেন, মাথাটা সামনে ঝোঁকানো।

আমি বলতে থাকি, ‘সত্যি কথা বলতে কি, ক্যাথিড্রাল ব্যাপারটা আমার কাছে খুব স্পেশাল কিছু নয়। কিছুই নয়। নেহায়েতই ক্যাথিড্রাল। অনেক রাতের টিভি প্রোগ্রামে ওগুলো দেখা যেতে পারে। এর বেশি কিছু নয়।’

এবার ভদ্রলোক গলা খাকারি দিয়ে গলাটা একটু পরিষ্কার করে নেন। কিছু একটা উঠে এসেছিল গলা দিয়ে, পেছনের পকেট থেকে রুমাল বের করলেন তার জন্য। তারপর বললেন, ‘আপনার কথা বুঝতে পারছি মশাই। ওতে কিছু হয় নি। এরকম তো হয়ই। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না।’ তারপর, ‘হ্যাঁ, শুনছেন, একটা কাজ করবেন আমার জন্য? একটা আইডিয়া এসেছে। একটু মোটা কাগজ ক’খানা যোগাড় করুন না। আর একটা পেন। একটা জিনিস করবো আমরা। দুজনে মিলে এঁকে ফেলবো একটা। মোটা কাগজ কয়েকটা আর একটা পেন। আনুন তো। আনুন দেখি মশাই।’


অগত্যা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে গেলাম। পায়ে আর কোনো জোর অবশিষ্ট নেই মনে হচ্ছিল। খানিক দৌড়ানোর পর পায়ে যে অনুভূতিটা হয় সেরকম খানিকটা। স্ত্রীর ঘরে গিয়ে চারপাশে চোখ বোলালাম। টেবিলের ওপরে একটা বাস্কেটে ক’টা বলপয়েন্ট পেন পেলাম। তারপর ভাবার চেষ্টা করলাম যে ধরণের কাগজের কথা উনি বলেছেন সেটা কোথায় থাকতে পারে।

নিচে নেমে রান্না ঘরে একটা শপিং ব্যাগ পাওয়া গেল যার একদম তলায় কিছু পেঁয়াজের খোসা রয়ে গেছে। সেগুলো ফেলে দিয়ে ব্যাগটা ঝাড়লাম। ওটা নিয়ে এবার বসার ঘরে ওর পায়ের কাছটায় বসলাম। এটা ওটা সরিয়ে, ব্যাগের কোঁচকানো জায়গাগুলো মসৃণ করে নিয়ে কফি টেবলে ওটা মেলে বসলাম।

সোফা থেকে নেমে অন্ধ কার্পেটের ওপর আমার পাশে বসলেন।

কাগজটার ওপরে আঙুল বুলিয়ে দেখলেন। এমনকি ধারগুলোও। কোণাগুলো পর্যন্ত বাদ গেল না।

‘ঠিক আছে,’ বললেন ‘সব ঠিক আছে, এবার শুরু করা যাক।’

আমার কোন হাতে পেন ধরা সেটা বুঝে নিয়ে নিজের হাত দিয়ে আমার সেই হাতটা ধরলেন। ‘শুরু করুন মশাই,আঁকুন,’ বললেন সেই সঙ্গে। ‘আঁকুন, দেখুন তারপর, আমিও আপনার সঙ্গেই রয়েছি। সব ঠিকঠাক হবে। শুরুটা করে দিন। দেখুনই না। আঁকুন,’ অন্ধ বলেন আমাকে।


সুতরাং শুরু করলাম। প্রথমে একটা বাক্স মতো আঁকলাম, যেন ওটা একটা বাড়ি। যে বাড়িতে থাকি সেই বাড়িটাও হতে পারে এটা। তারপর দিলাম একটা ছাদ। তার দুই প্রান্তে একটা করে চার্চের পায়ার। একেবারেই অর্থহীন।

বললেন, ‘দারুণ! দারুণ হচ্ছে, চমৎকার আঁকছেন। কখনো ভেবেছিলেন মশাই যে জীবনে এরকম একটা জিনিস ঘটবে? জীবন ব্যাপারটা বিচিত্র, আমাদের জানাই আছে। চালিয়ে যান, থামবেন না।’

আমি আর্চ দেওয়া জানালা দিতে থাকি। প্রায় উড়ন্ত বাট্রেস। বড় বড় দরজা লাগাই। থামতে পারছি না। টিভিতে আর কোনো সম্প্রচার হচ্ছে না তখন। পেনটা একটু রেখে, হাতের আঙুল একবার মুঠো করে, আবার খুলে, মুঠো করতে থাকি। কাগজের ওপরে হাত দিয়ে দিয়ে অন্ধ কী যেন ঠাহর করার চেষ্টা করছে। আঙুলের ডগাগুলো কাগজের সবটুকুর ওপরে দিয়ে, আমি যা যা এঁকেছি তার ওপরেও বুলিয়ে নিলেন। তারপর সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে অনুমোদন করলেন।

‘দারুণ হচ্ছে,’ বললেন অন্ধ।

আমি আবার পেনটা তুলে নিই, উনিও আমার হাতটা খুঁজে নেন। আমি চালিয়ে যাই। মোটেই আঁকিয়ে নই, কিন্তু তবু আঁকতে থাকি।

আমার স্ত্রী চোখ খুলে আমাদের দিকে তাকায়। সোফায় সোজা হয়ে উঠে বসে, রোবটা ফাঁক হয়েই আছে, বলে ‘কী করছো তোমরা? আমাকে বলো না, জানতে চাইছি আমি।’

আমি ওর কোনো কথার উত্তর দিই না।

অন্ধ বলেন, ‘আমরা একটা ক্যাথিড্রাল আঁকছি। আমি আর উনি মিলে। আরেকটু চাপ দিয়ে, গাঢ় করে,’ আমাকে বলেন শেষটুকু। ‘হ্যাঁ, এবার ঠিক আছে, ভালো হচ্ছে,’ বলতে থাকেন। ‘এই তো, একদম এরকম মশাই, আমি বলছি। ভাবেননি তো যে পারবেন। কিন্তু পারছেন, কি পারছেন না? একেবারে জোর কদমে, যেন গ্যাসে রান্না হচ্ছে। শুনুন তবে যা বলছি, এক মিনিটের মধ্যে একটা কিছু তৈরি হতে চলেছে। একে বলে হাতযশ।’ তারপর, ‘এবার কয়েকটা মানুষজন দিয়ে দিন। লোক ছাড়া আর ক্যাথিড্রাল কী?’

আমার স্ত্রী বলে, ‘ব্যাপারটা হচ্ছে কী? রবার্ট, আপনারা কী করছেন? কী হচ্ছে এখানে?’

‘হতে দাও না,’ উনি আমার স্ত্রীকে বলেন। আমাকে বলেন, ‘এবার চোখ বন্ধ করে ফেলুন।’

আমিও তা-ই করলাম। ওর কথা মতো চোখ বন্ধ করলাম।

‘বন্ধ তো?’ বললেন, ‘দেখবেন না।’

‘বন্ধই আছে,’ আমি জানাই।

‘ওরকমই থাকুক,’ বলতে  থাকেন, ‘থামবেন না, এঁকে যান।’


এভাবেই চলতে থাকে। কাগজের ওপর আমার হাতের আঙুলগুলোকে ও ছুঁয়ে আছে। এরকম কিছু এর আগে আমার জীবনে সত্যিই কখনও ঘটেনি।

এবার উনি বললেন, ‘হ্যাঁ হয়েছে, যা বুঝছি, আপনি করে ফেলেছেন।’ তারপর বললেন, ‘এবার তাকিয়ে দেখুন। কী মনে হচ্ছে?’

কিন্তু আমার চোখ তখনও বন্ধ। আরও কিছুক্ষণ ওরকমই রাখবো বলে ভাবছি। ওরকমই রাখা দরকার বলেই আমার মনে হচ্ছিল।

‘কী হলো,’ জিজ্ঞেস করেন। ‘দেখলেন?’

তখনও কিন্তু আমার চোখ বন্ধই। আমি আমার নিজেরই বাড়িতে। খেয়াল আছে সেটা। কিন্তু একটুও মনে হচ্ছে না আমি কোথাও কিছুর ভেতরে আছি।

‘হলো বটে কিছু একটা,’ আমি বলে উঠি।

 

পরিচিতি : রেমন্ড কার্ভার (১৯৩৮ – ১৯৮৮) ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ছোট গল্পকার ও কবি। গত শতকে ৮০’র দশকে সে দেশে ছোটগল্পের পুনরুজ্জীবনে তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি অসচ্ছল পরিবারে জন্মেছিলেন। কার্ভার নিজে অল্প বয়েসে বিয়ে করে কুড়ি বছর বয়সের মধ্যে দুই সন্তানের জনক হন। তিনি কাজ করতেন কখনো করাত-কলের শ্রমিক হিসেবে, কখনো ঝাড়ুদারের, আবার কখনো বা ডেলিভারিম্যানের। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়িয়ে এমনকি একসময় বার্কলেতে অধ্যাপনাও করেছেন। লেখক হিসেবে তার ওপর প্রভাব পড়েছে ফকনার, জন গার্ডনার এবং লরেন্স ডারেলের। বহু পাঠকের অনুমান সত্ত্বেও হেমিংওয়ের প্রভাব তিনি অস্বীকার করেছেন । ‘ক্যাথিড্রাল’ নামে এই লেখকের একটি ছোটগল্প সংকলন আছে। প্রকাশিত গল্পটি সেখান থেকে নেওয়া।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ জানুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়