ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ক্রিকেটার আফতাব ‘ঘুমকাতুরে’, কোচ আফতাব ‘অধ্যবসায়ী’

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:১৪, ২৩ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ক্রিকেটার আফতাব ‘ঘুমকাতুরে’, কোচ আফতাব ‘অধ্যবসায়ী’

আফতাব আহমেদ

পাদপ্রদীপের আলো জ্বালিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে আফতাব আহমেদের আগমন। দিন দিন সেই আলোর উজ্জ্বলতা বেড়েছে। আর রঙিন হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। কখনো কখনো আফতাব আহমেদ নিজেকে চিনিয়েছেন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে আবার কখনো টপ অর্ডারে।

 

বল হাতেও ২২ গজের ক্রিজে হাত ঘুরিয়েছেন। ফিল্ডিংয়েও ছিলেন দুর্দান্ত। পয়েন্ট কিংবা গালি দৌড়ঝাপ ছিল চট্টগ্রাম এই তারকার নিত্যসঙ্গী। ব্যাটিংয়ে ঝড় তুলতে বেশ পছন্দ করতেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখন যে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলছে, তার গোড়াপত্তন আফতাবের হাত ধরেই। তার সঙ্গী ছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। আফতাবের নান্দনিক ও আক্রমণাত্মক ব্যাটিং বেশ কয়েকবার বাংলাদেশকে লাল-সবুজ পতাকা উড়নোর উপলক্ষ তৈরি করে দিয়েছে।

 

২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার পেসার গিলেস্পিকে উড়িয়ে যে ছয় আফতাব মেরেছিলেন, তাতে বিস্মিত হয়েছিল পুরো বিশ্ববাসী। একই সালে ইংল্যান্ড সফরে চেস্টারলি-স্ট্রিট টেস্টে আফতাবের অপরাজিত ৮২ রানের সেই ইনিংসটি ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখে এখনো ভেসে ওঠে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসরে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৪৯ বলে ৬২ করে দলকে জিতিয়ে তবেই ফিরেছিলেন আফতাব। আর ৯৬-এর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কাকে প্রথমবারের বাংলাদেশ হারিয়েছিল আফতাবের ব্যাট ধরে। তার ২১ বলে ৩২ রানের ইনিংসে বগুড়ায় টাইগার গর্জনে হার মানে সিংহের দল।

 

সেই আফতাব হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলেন ক্রিকেট থেকে। ২০১০ সালে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে সর্বশেষ মাঠে নামেন তিনি। নিজের ক্যারিয়ারের পারফরম্যান্সের ওঠা-নামা, ব্যর্থতার পাশাপাশি তার নামে আইসিএলে যোগ দেওয়ার কলঙ্ক তো ছিল। কলঙ্ক মুছে ফিরে এসেছিলেন । নামের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। তাতেই নিজের অবসর ঘোষণা করেন আফতাব। জাতীয় দল থেকে বাদ পরার পর নির্বাচকরাও আর তাকে পরিচর্যা করেননি! অভিযোগটা আফতাবেরই! যে ক্লাবগুলোর হয়ে বছরের পর বছর প্রিমিয়ার লিগ খেলেছেন তারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। অভিমান করেই অবসর। আর অবসরের পর ক্রিকেটপ্রেমী আফতাব এখন ক্রিকেট গড়ার কারিগর।

 

চট্টগ্রামে নিজ নামে গত ফ্রেব্রুয়ারিতে একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশের হয়ে ৮৫টি ওয়ানডে খেলা আফতাব। পাঁচ মাসে একাডেমিতে ছাত্র পেয়েছেন শ’খানেক। তাদেরকে নিয়েই এখন ব্যস্ততা।

 

চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামে চলছে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট। বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনের খেলার ফাঁকে চা-বিরতির সময় রাইজিংবিডি’র ক্রীড়া প্রতিবেদক ইয়াসিন হাসানের মুখোমুখি হন আফতাব। স্টেডিয়ামের পিছনে মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে শিষ্যদের অনুশীলন করাচ্ছিলেন। দূর থেকে চেনার কোনো উপায় নেই। দাড়ি রেখে পুরোই অন্যরকমের। কিন্তু মুখের অমলিন হাসি আজও পিছু ছাড়েনি আফতাবের। শিষ্যদের তালিম দেওয়ার ফাঁকে ক্রিকেট নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন জাতীয় দলের প্রাক্তন এই ক্রিকেটার।

 

পুরো কথোপকথনটি রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্যে দেওয়া হল:

 

প্রশ্ন: ব্যাট-প্যাড উঠিয়ে রাখার পর আফতাব আহমেদের জীবন এখন কেমন কাটছে?

আফতাব আহমেদ : এখনো আমি ক্রিকেট নিয়ে আছি। আগে ছিলাম ক্রিকেটার। এখন কোচ। ‘আফতাব আহমেদ ক্রিকেট কোচিং’ গত ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠা করি। এখন সেটা নিয়ে কাটছে আমার দিন।

 

প্রশ্ন: এই মুহূর্তে জীবনকে কীভাবে দেখছেন?

আফতাব আহমেদ : আমি আমার জীবনকে তিন ভাগে ভাগ করে ফেলেছি। জাতীয় দলে খেলার আগে আমি একভাবে আমার জীবন পার করেছি। তখন মুদ্রার এপিঠ ছিলাম। যখন ক্রিকেট খেলেছি, তখন আয়-উপার্জন করে গাড়ি-বাড়ি করি। এখন খেলা ছাড়ার পর আমার একটা জীবন। এখন কোচিং, ইসলামিক জীবন-যাপন করছি। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি আমার তিনটা জীবনই ভালোমত উপভোগ করেছি। 

 

প্রশ্ন : কোচিং নিয়ে শুরু করা যাক। হঠাৎ কোচিংয়ে কেন? 

আফতাব আহমেদ :  অনেক আগের থেকেই আমার ইচ্ছে কোচিং প্রতিষ্ঠা করা। অবসরের পর তা বাস্তবায়ন করলাম। এখনো বাস্তবায়ন হয়েছে তা বলব না। নাসিরাবাদে একটা মাঠ তৈরি করছি। সেখানে সিমেন্টের পিচ তৈরি করা শেষ। এখানে অনুশীলন নিয়মিতই হচ্ছে। আমার পরিবার যেমন আমার ক্রিকেট খেলাটাকে গ্রহণ করেছে, ঠিক একইভাবে তারা আমার কোচিং জীবটাকেও গ্রহণ করেছে।

 

প্রশ্ন : অনেক আগের থেকে মানে কী? গত বছর তো প্রিমিয়ার লিগ খেললেন। সেখানে তো প্রথম জানালেন, সেটাই আপনার শেষ ক্রিকেট খেলা। কোচিংয়ের চিন্তা কী তাহলে আগের থেকেই?

আফতাব আহমেদ :  গত বছর দলবদলের সময় প্রথম মিডিয়ায় কোচিংয়ের কথাটা বলি। হ্যাঁ, যখন ক্রিকেট খেলতাম, তখন থেকেই এই পরিকল্পনা। আমার সমসাময়িক ক্রিকেটাররা বিষয়টি জানে।

 

প্রশ্ন : কোচিং নিয়ে আপনার পরিকল্পনা শেয়ার করবেন?

আফতাব আহমেদ :  একাডেমি অনেক বড় করার ইচ্ছে আছে। এখন এখানে কোচিং করাচ্ছি। এখানে চারটি উইকেট আছে। আর একটা সেন্ট্রাল উইকেট আছে। শ’খানেকের মত ছাত্র পেয়েছি। তাদের নিয়ে কাজ করছি। যদি সুযোগ হয় ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ বা বড় কোনো দলকে কোচিং করাতে চাই।

 

প্রশ্ন : বাংলাদেশ জাতীয় দলকে কোচিং করানোর স্বপ্ন দেখেন না?

আফতাব আহমেদ :  ওটা অনেক দূরের বিষয়। মাত্র কয়েক মাস হল নিজেকে কোচ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছি। আপাতত আমার একাডেমি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই।

 

প্রশ্ন : কিছুদিন আগে কি বিসিবিতে একটা ট্রেনিং করেছেন ক্রিকেট কোচিংয়ের ওপরে?

আফতাব আহমেদ :  হ্যাঁ। লেভেল-১ এর ট্রেনিং হয়েছে। ক্রিকেটাররা অনেক কিছু জানে না। কিন্তু ওখানে (ট্রেনিং) গেলে অনেক কিছু জানা যায়। এটা অনেকটা সিক্রেট ব্যাপার। আমি ওখানে গিয়ে অনেক কিছু শিখেতে পেরেছি। এজন্য বেশ ভালো লাগছে। প্রত্যেকটি কোচের এ রকম প্রোগামে যাওয়া ভালো। এক বছর আমার পারফরম্যান্স দেখার পর আমার লেভেল-১ প্রোগ্রাম শেষ হবে। এক বছর পরই লেভেল-২ এর ট্রেনিং হবে।

 

প্রশ্ন : ক্রিকেটার আফতাব আর কোচ হিসেবে আফতাবের পার্থক্য কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

আফতাব আহমেদ :  ক্রিকেটার আফতাব ছিল ঘুমকাতুরে। আর কোচ আফতাব অধ্যবসায়ী, কঠোর পরিশ্রমী। অনেক আলসামি করেছি ক্রিকেট জীবনে। সেটা আমি কোচিং জীবনে করতে দিচ্ছি না। কারণ কোচিং জীবনে যদি এগুলো করে থাকি তাহলে আর আমার পক্ষে ক্রিকেটার বের করা সম্ভব না। এজন্য অধ্যবসায়ী ও শক্ত থাকার চেষ্টা করছি। যেটা ক্রিকেটার তৈরি করতে দরকার, সেটা করার চেষ্টা করছি। ওদের মনবোল, ওদের আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে যা করা প্রয়োজন তাই করছি। এইতো। নিজের মধ্যে এই পার্থক্য পাচ্ছি।

 

প্রশ্ন: খেলোয়াড়ি জীবনে আলসেমি ছিল কেন?

আফতাব আহমেদ:  সত্যি বলতে আজকে থেকে দশ বছর আগে সেভাবে ম্যাচিউর (পরিপক্ক) ছিলাম না। তখন যেটা চলতে ছিল সেটা নিয়েই ছিলাম। ভবিষ্যতের কোনো কিছুই তখন মাথাই রাখিনি। গায়ে না লাগানোর অনেক ব্যাপার ছিল। এখন বয়স হয়েছে। ম্যাচিউর হয়েছি। এখন কোচিং চালাচ্ছি। প্রায় একশ ছেলের দায়িত্ব এখন আমার কাঁধে। ক্রিকেটীয় জীবনে যেটা আমি করেছি সেটা ছিল শুধু আমার দায়িত্ব। আমি যেটা করেছি সেটার দায়-দায়িত্ব আমার ছিল। এখন সে রকম কোনো সুযোগ নেই। আমি এখানে বিন্দুমাত্র গাফিলতি করলে সব গিয়ে পড়বে এই ছেলেদের ওপর। এজন্য কোচিং জীবনে ফাঁকি দেওয়ার কোনো ইচ্ছেই পাচ্ছি না।

 

প্রশ্ন : ক্রিকেট জীবনে যদি এই স্পিরিট থাকত তাহলে জীবন ভিন্ন ধরনের হতো?

আফতাব আহমেদ:  হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। ভিন্ন ধরনের হতো না কেন? আজকে এই মাঠে (ক্রীড়া কমপ্লেক্স) না থেকে ওই (পাশেই জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম) মাঠেও থাকতে পারতাম।

 

প্রশ্ন : চট্টগ্রাম থেকে অনেক বছর ধরে নতুন ক্রিকেটার আসছে না, কেন?

আফতাব আহমেদ :  আমার কোচিংয়ে আসার পিছনে এটাও একটা বড় কারণ। চট্টগ্রামের কোনো ক্রিকেটার এখন পাইপলাইনে নেই। সামনেও আসবে কি না, তা বলা যাচ্ছে না। আগে দুই-তিনজন যেমন পাইপলাইনে ছিল, এখন একটিও নেই। আগে যেটা হয়েছে- আমি না হলে নাফিস, নাফিস না হলে নাজিম। এরপর আসল তামিম। ও এখনো খেলে যাচ্ছে। এরপর তো চট্টগ্রামের কোনো ক্রিকেটার আর জাতীয় দলে নেই। কেন থাকবে না? সেই টার্গেটেই আমি এগুচ্ছি। জাতীয় দল, ‘এ’ দল ও বয়সভিত্তিক দলগুলোতে চট্টগ্রামকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন ক্রিকেটার তৈরি করার প্রথম চ্যালেঞ্জ আমার।

 

প্রশ্ন : ক্রিকেটার না আসার পিছনের গল্পটা একটু বলেন?

আফতাব আহমেদ :  পিছনে গল্প আর কী! একই গল্প। বহুদিন যারা একই গল্প শুনিয়ে আসছে। মূল সমস্যা হচ্ছে মাঠ নেই। আবার মাঠ থাকলে অনুশীলন নেই। অনুশীলন হলে ভালো মানের কোচ নেই। পুরোটাই একটা চক্রে ঘুরছে। পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব আমি বলব। আকরাম ভাই ও নান্নু ভাইরা এখনো ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত আছেন। আমি চাইলে ক্রিকেট ছেড়ে দিতে পারতাম। কিন্তু এখনো সেই ভালোবাসা আছে বলে ছাড়তে পারিনি। এখন এই কোচিংয়ের জন্যে যথেষ্ট পরিশ্রম করছি। কেউ বলতে পারবে না যে এই কোচিংয়ে আমি একদিন আসিনি। কোনো ফাঁকি কিংবা কোনো আলসেমি করেছি না। কারণ আমি থাকলেই ওরা ক্রিকেটের মর্মটা ভালো মতো বুঝতে পারবে। যদি আমিও ফাঁকি দেই, তাহলে ওরাও সেটা করার চেষ্টা করবে।

 

প্রশ্ন : ‘আফতাব আহমেদ ক্রিকেট একাডেমি’ চট্টগ্রামে কেমন সাড়া পেল?

আফতাব আহমেদ :  আলহামদুলিল্লাহ। ব্যাপাক সাড়া পেয়েছি গত পাঁচ মাসেই। একশ’জন এখন অনুশীন করছে। আজকে ঈদের পর প্রথম অনুশীলন বলে অনেকেই উপস্থিত হতে পারেনি। অনেকেই জানছে, অনেকেই নতুন করে ভর্তি হচ্ছে। তবে আমার ইচ্ছে, ভালো মানের দশ জন হলে তাদেরকে নিয়ে কাজ করা। পুরো একাডেমি ছাত্র দিয়ে ভরে ফেললাম, কিন্তু ভালো মানের কেউ আসলে না, তাহলে কোনো লাভই হবে না। দশজন থেকে দুজন যদি পাই, যারা জাতীয় দলে খেলবে তাতেই আমার লাভ। আফতাব আহমেদ ক্রিকেট একাডেমি কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান না। কিছুদিন আগে ২৫-২৬ বছর বয়সি তিনজন আসছিল ভর্তি হতে। তাদেরকে আমি তাদের ভবিষ্যৎ জানিয়ে দিই যে, তাদের পক্ষে এই দেশে আর ক্রিকেটার হওয়া সম্ভব না। যাদের ইচ্ছেশক্তি অনেক বেশি তাদেরকে আমি সময় দিচ্ছি। তাদের পিছনে আমি আমার পরিশ্রম ব্যয় করছি।

 

প্রশ্ন : আপনি তো ফ্রি হিট করতে বেশ পছন্দ করতেন। সামনে কোনো বোলার তা চিন্তা না করেই ব্যাট চালিয়ে দিতেন। একাডেমির শিষ্যদের কী একই ভাবে গড়ে তুলছেন?

আফতাব আহমেদ :  অবশ্যই। আমি আমার একাডেমির ক্রিকেটারদের এভাবেই গড়ে তুলছি। তাদের স্বাচ্ছন্দ্যমত তাদেরকে খেলতে দিচ্ছি। এতেই ওরা ভালো করবে। যার যেটা ন্যাচারাল সেটা খেলার পরামর্শ দিচ্ছি। তবে শট নির্বাচন ঠিক করে দিচ্ছি। কারণ ভালো বলে তো আর শট ওভাবে খেলা সম্ভব না। আমি শুধু শট নির্বাচন শেখাব, তারপর সে পেসারকে মারল না স্পিনারকে তা আমি দেখতেও চাই না।

 

প্রশ্ন : একটা বাড়তি প্রশ্ন। এভাবে আক্রমণাত্মক খেলতেন কেন?

আফতাব আহমেদ : আমি যা চিন্তা করতাম তাই করেছি। কারো কথা শুনিনি, কারো কথা বুঝিনি। যখন শট খেলতে মন চেয়েছে তখন সেটা করেছি। আউট হওয়ার ন্যূনতম কোনো ভয় আমার মধ্যে থাকেনি। সফলতা পেয়েছি। আবার আউট হয়েছি। কিন্তু নিজের খেলা খেলেছি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওই সময়ে ওই ম্যাচে এক রান এক রান করে নিতে গেলে আমরা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওভাবে জয় পেতাম না। একই ম্যাচ খেলেছি বগুড়ায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ওটা আমাদের শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম জয় ছিল। সেদিন ওভাবে খেলার কারণেই আমরা শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে দিই।

 

প্রশ্ন : এবার একটু আপনার ক্রিকেটীয় জীবনে আসি। আগে বললেন অলসতা করেছেন। সেখান থেকেই কি অবসর?

আফতাব আহমেদ :  অলসতা প্রধান বলব। তারপর পারফরম্যান্স। দুটিতো এক সুঁতোয় আটকানো। সবকিছু মিলিয়ে অবসর।

 

প্রশ্ন : ক্রিকেট বোর্ডের কি পরিচর্যার অভাব ছিল?

আফতাব আহমেদ : পাঁচ বছর পর এগুলো নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। আমার গাফিলতি ছিল। বিসিবিরও ছিল! সেগুলো অতীত। এখন নতুন করে তো সব শুরু করেছি। অনেক ক্রিকেটারকে এখন দেখছি ওদেরকে বাদ দেওয়ার পরও ডাকা হয়। ওদেরকে যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই সুযোগ পাচ্ছে আবার। নাসিরের পারফরম্যান্স ভালো ছিল না একটা সময়। কিন্তু একমাত্র সুযোগ দেওয়ার কারণেই ও কিন্তু এখন আমার স্বরূপে। ওই রকম সুযোগ আমরা পাইনি। ওই সময় যদি বিসিবি একটু পরিচর্যা করত, তাহলে হয়ত আজ জাতীয় দলে আবার খেলতেও পারতাম!

 

প্রশ্ন : অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্তটি কি সঠিক ছিল? সময়টিও কি সঠিক ছিল?

আফতাব আহমেদ : দেখুন আগে আমরা যখন প্রিমিয়ার লিগ খেলতাম তখন খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল ক্রিকেটারদের মধ্যে। এখন অনুরোধের ক্রিকেটার বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এভাবে তো আর ক্রিকেট খেলা যায় না। আমি যে পর্যায়ে ক্রিকেট খেলেছি, যাদের বিপক্ষে খেলেছি, তাদের বিপক্ষে এখন অনেকেই খেলতে পারবে না। তাই ভাবলাম মান-সম্মান নিয়ে অবসরে যাওয়াই ভালো। আর সিদ্ধান্তটাও সঠিক সময়ে নেওয়া হয়েছে বলব। কারণ এখন একাডেমি চালাতে যে পরিমাণ পরিশ্রম আর সময় দেওয়া দরকার, তা আমি দিতে পারছি।


প্রশ্ন : মান-সম্মানের বিষয়টি আসছে কি শুধু পারফরম্যান্সের কারণেই?

আফতাব আহমেদ : গত বছর আমি শেষ খেলেছি। এরপর আমার অবসর। গত বছরের একটা ঘটনাই বলি। প্রিমিয়ার লিগের দলবদল হবে। কোনো দলই চট্টগ্রামের ক্রিকেটারদের দলে নিতে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করছিল না। চট্টগ্রাম শুনতেই তারা কেমন যেন করত। এটা আমার জন্যে খুব অপমানজনক ছিল। জাতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার হয়ে খুব খারাপ লেগেছে তখন। গত বছরও আমার লিগ খেলা হত না। দল পরিবর্তনের শেষ দিনেও আমি কোথায় খেলব সেটা ঠিক ছিল না। যদি বলি অনুরোধ করে তাহলেও ভুল হবে না, ব্রাদার্সে আমি শেষ খেলি অনেকটা অনুরোধ করেই! চারটা ম্যাচ খেলেই খেলা শেষ করি আমি।

 

প্রশ্ন : আপনার অতি আক্রমণাত্মক ক্রিকেটই কি আপনার ক্ষতি করেছে?

আফতাব আহমেদ :  না, আমি তা মনে করি না। বরং আমি মনে করি আমাকে যখন ধরে ধরে খেলতে বলত তখনই আমি বেশি ঝামেলায় পড়েছি। কিছুদিন আগেও যখন খেলেছি তখন আমি আমার খেলার ধরন পরিবর্তন করে ঠান্ডা হয়ে যাই। তখন থেকেই আমি নিজেকে খুঁজে পাইনি। আমার খেলা তখন থেকেই নষ্ট হয়ে যায়। আমাকে আমার মতো করে খেলতে দিলেই হয়ত আমি ভালো করতে পারতাম।

 

প্রশ্ন : আপনি যেটা খেলতেন এখন সেটা সৌম্য-সাব্বিররা খেলছে। কেমন লাগছে ওদের খেলা দেখে?

আফতাব আহমেদ : অনেক ভালো। এ রকম পারফরম্যান্স তো কোনো সময় আমরা আগে পাইনি। আমি সেই কথাটাই গত কয়েকদিন ধরে বলছি। আমি আর আশরাফুল এ রকম ক্রিকেটই খেলেছি। মাঠে গেলে সর্বোচ্চ আউটই হব। তার থেকে তো বেশি কিছু না। মাঠে যেতাম, গিয়ে নির্দ্বিধায় শট খেলতাম। বোলারদের ওপর চড়াও হয়ে খেলতাম। এভাবে খেলে ৯০ ভাগ সফল হওয়ার সুযোগ থাকে। অনেক সময় থাকেও না। এখন সৌম্য, সাব্বির ও মুস্তাফিজকে দেখে মনে হয়, ওরা পাঁচ-ছয় বছর ধরে ক্রিকেট খেলছে। কোনো ভয়ডর নেই তাদের মধ্যে। এটাই তো দরকার। এ জন্যই বাংলাদেশ এখন বেশি এগিয়ে যাচ্ছে। এখন শুরুতে চার-পাঁচটা উইকেট পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাটিংয়ে রান করছে। ব্যালেন্স পারফরম্যান্স হচ্ছে বলে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। সত্যি বলতে, বাংলাদেশের হয়ে ক্রিকেট খেলেছি এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

 

প্রশ্ন : সৌম্য, মুস্তাফিজ ও সাব্বিরদের উদ্দেশ্যে কোনো পরামর্শ?

আফতাব আহমেদ :  এখন অভিষেক হয়েছে বলে অনেক ভালো খেলছে। দুদিন পর ওদের ওপর অনেক দায়িত্ব থাকবে। সে সময়ে তারা যেন ঘাবড়ে না যায় সেদিকে খেয়াল করতে হবে। এটা ওদের কাছে অনুরোধ। পরামর্শ এটাই। যতই দলের চাপ আসুক, এ রকম ক্রিকেট খেলতে হবে। এভাবেই খেললে অনেক দূর যাবে ওরা।

 

প্রশ্ন : আপনি নামলে মাঠে একটা চিৎকার হতো। এখন যেটা সাকিব-সৌম্য ও অন্যদের সঙ্গে হয়? মিস করেন এই জিনিসটা?

আফতাব আহমেদ : সত্যি বলতে এই একটা জিনিসের কারণেই মাঠে যাই না। খুব খারাপ লাগে এটা। আমার আক্রমণাত্মক খেলার অনেক কারণও দর্শক। আমি মাঠে নামলেই কানে দর্শকদের কথা শুনতে পারতাম। তারা যেন আমার কাছ থেকে শুধু চার-ছক্কাই চাইত। ড্রেসিং রুম থেকে যখন মাঠে নামতাম, তখন দর্শকদের চিৎকারে আমার ভয় দূর হয়ে যেত।

 

 

রাইজিংবিডি/চট্টগ্রাম/২৪ জুলাই ২০১৫/ইয়াসিন/সাইফুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়