ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ট্রাম্পের ট্রাম্প

খান মো. শাহনেওয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১০ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ট্রাম্পের ট্রাম্প

খান মো. শাহনেওয়াজ : যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ তো বটেই, সারা পৃথিবীকে অবাক করে দিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন ডোনাল্ড জন ট্রাম্প। প্রাক নির্বাচনী জরিপ, গণমাধ্যমের ধারণা ও সমীক্ষা, বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ কোনটাই সঠিক প্রমাণিত হয়নি। ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল অনুযায়ী হোয়াইট হাউসের চাবিটি তার হাতেই যাচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিচয় তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। তার জীবন বৃত্তান্ত বলে দেয় তিনি একজন চৌকস সওদাগর, তৃণমূল থেকে উঠে আসা কোন রাজনীতিক নন। রাজনীতির প্রতি নজর তার ছিলো, নির্বাচন করার বাসনাও তার ছিলো, রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষপদে আসীন হওয়ার আকাঙ্খাও নিশ্চয়ই তার ছিলো কিন্তু সত্যি সত্যিই তিনি তা পেয়ে যাবেন- এটা কি তিনি ভেবেছিলেন ? যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক চেহারা আর ভোটের যে ফলাফল তা প্রমাণ করে দেয় ডোনাল্ড ট্রাম্প সেটা ভেবেছিলেন।

 

কিন্তু তার হাতে তো আলাদিনের চেরাগ নেই, যা থাকতে পারে বা আছে তা হলো মনোবল, দৃঢ়তা, পরিস্থিতির গাণিতিক বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। এগুলোকেই তিনি পুঁজি করেছেন। বলা যায়,এগুলোই ট্রাম্পের জন্য ট্রাম্প কার্ডের মত কাজ করেছে।
 
এই নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি, প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাত রাজনীতিক হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন। ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিতে তার পদচারণা দীর্ঘদিনের। রাজনৈতিক পথযাত্রায় তরুণ বয়স থেকেই সহযাত্রী হিসেবে পেয়েছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির আরেক দিকপাল বিল ক্লিনটনকে, যিনি তার ঘরের মানুষ এমনকি বিছানার মানুষ। একারণে যেমন মাঠে তেমনি শোবার ঘরেও তিনি রাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করার অনেক সুযোগ পেয়েছেন। বিল ক্লিনটন ছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির টিকিটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং দুই মেয়াদে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এই দুটি মেয়াদকালে হিলারি ক্লিনটন হোয়াইট হাউসে থেকেছেন, প্রশাসনকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। বিল ক্লিনটনের প্রেসিডেন্সির মেয়াদ শেষে হিলারি হোয়াইট হাউস ছেড়ে আবার আমজনতার কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন, সিনেটর নির্বাচিত হয়েছেন।
 
পরবর্তী সময়ে হিলারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং প্রার্থীতার জন্য দলীয় মনোনয়নের ভোটে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছে হেরেও গেছেন। সেবার  বারাক ওবামা ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন পান এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেন এবং তিনিই বর্তমান প্রেসিডেন্ট। বারাক ওবামার প্রথম মেয়াদের সরকারে হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ কারণে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণাও তার আছে। হিলারি একজন খ্যাতিমান আইনজ্ঞ এবং দেশের ব্যক্তিসম্পন্ন নারীদের অন্যতম। সর্বোপরি তিনি দেশে ও দেশের বাইরে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এতগুলো ইতিবাচক বিষয় যার ঝুলিতে রয়েছে তার সাথে টেক্কা দিয়ে ট্রাম্প করা সহজ কোন কথা নয়। কিন্তু সেই টেক্কাই মেরেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ট্রাম্পও করেছেন।
 
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, বিজয় ভাষণ দিয়েছেন। পরাজয় মেনে নিয়ে হিলারি তাকে অভিনন্দও জানিয়েছেন। বিশ্ব নেতাদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা বার্তায় সিক্তও হচ্ছেন ট্রাম্প। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে এর উল্টোচিত্র। কী করে নির্বাচনের ফলাফল তার অনুকূল হলো- এই নিয়ে চলছে আলোচনা সমালোচনা। নির্বাচনে ভোটের আগেই বিশ্লেষকদের মতামত, নির্বাচনী জরিপ ও গণমাধ্যমের আচরণ নিয়ে ইতিমধ্যেই ব্যাপকভাবে প্রশ্ন উঠেছে। ভোটারদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে।
 
নির্বাচনকে ঘিরে আলোচনা সমালোচনা যাই হোক, বিক্ষোভ সমাবেশ যাই হোক, ডোনাল্ড জন ট্রাম্প পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট- এটাই সত্য। কিন্তু তার জয়ের পেছনে কারণ কি? যে ট্রাম্প কার্ড ফেলে তিনি দান মারলেন, সেই ইস্কাপনের টেক্কা কোনটি ? একটু চোখে খুলে তাকালেই দেখা যায়, তা হলো তার দৃঢ় মনোবল আর কৌশল। তিনি রাজনৈতিক পাটিগণিতে সরল অঙ্ক কষেছেন ব্যবসায়ীক অভিজ্ঞতা দিয়ে। তার অঙ্ক সঠিক হয়েছে এবং তিনি পাশ করেছেন।  
 
ডোনাল্ড ট্রাম্প সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছেন মাত্র ১৭ মাস আগে এবং রিপাবলিকান পার্টিতে শরিক হয়েছেন। দলে তার তেমন কোন জনপ্রিয়তাও নেই। নির্বাচনে গণমাধ্যমও তার অনুকূলে ছিলো না। নির্বাচনী বিতর্কে তিনবারই তিনি হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে কম পয়েন্ট পেয়েছেন। জরিপের ফলাফলও তার প্রতিকূলেই গেছে। তারপরও তিনি মনোবল হারাননি। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোনে মানুষের সাধারণ আবেগ (কমন ইমোশন) ও হুজুগের প্রবনতা পড়তে বা দেখতে (রিড করতে) সক্ষম হয়েছেন। আর এটাকেই তিনি ইস্কাপনের টেক্কা হিসেবে ভোটের টেবিলে ফেলেছেন।    
 
প্রথমত : তিনি অভিবাসীদের বিষয়ে কথা বলে দেশের অল্পশিক্ষিত, দরিদ্র ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন এবং সমর্থণ আদায়ে সক্ষম হয়েছেন।

 

দ্বিতীয়ত : তিনি দেখেছেন জঙ্গিবাদ সারা বিশ্বেই একটা সমস্যা আর এর সঙ্গে যুক্ত আছে মুসলিম শব্দটি। জঙ্গিবাদ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত সতর্ক। তিনি মুসলিম বিদ্বেষী কথা বলে সাধারন মার্কিনিদের আবেগ স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছেন।

 

তৃতীয়ত: তিনি জাতিবিদ্বেষী ও লিঙ্গবিদ্বেষী কথা বলে আরো এক শ্রেণির মানুষের মন জয় করেছেন।     
 
তিনি নির্বাচনী সমাবেশে বক্তৃতায় জনতার উদ্দেশে বলেছেন, জরিপের ফলাফলে কি যায় আসে ? সচেতন মানুষ হিসেবে কেন আপনারা জরিপের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেবেন? নির্বাচনী বিতর্কে হেরে যাওয়া মানেই দায়িত্ব পালনের যুদ্ধে হেরে যাওয়া নয়। গণমাধ্যম যাই বলুক তাতে কি? আপনি মনস্থির করবেন মনের সাথে বোঝাপড়া করে।
 
এদিকে নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রতিবাদের মুখে পড়েছেন ট্রাম্প। ক্যলিফোর্নিয়া, টেক্সাস, অরেগন, সান ফ্রান্সিসকো, পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যে বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেছে। শিকাগো,নিউইয়র্ক, লস এঞ্জেলেস, ওয়াশিংটনসহ বড় বড় কয়েকটি নগরীতে ট্রাম্প বিরোধী বিক্ষোভ জোড়ালো হয়ে উঠছে। এসব জায়গায় বিক্ষোভ সমাবেশে ক্রমশ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সিয়াটল, বার্কলি, পিটার্সবার্গ, ওকল্যান্ডসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ চলছে। নিউইয়র্ক সিটিতে বিক্ষোভকারীরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবাসন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নির্মিত ‘ট্রাম্প টাওয়ার’ গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। নির্বাচন পরবর্তী এই পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেয় সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।
 
লেখক : সাংবাদিক।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ নভেম্বর ২০১৬/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়