ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

খোয়াই নদী পেরিয়ে কালেঙ্গার পথে

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৯, ২৫ জুলাই ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
খোয়াই নদী পেরিয়ে কালেঙ্গার পথে

ফেরদৌস জামান : গত কয়েক মাস আগে গিয়েছিলাম দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমতল অভয়ারণ্য রেমা-কালেঙ্গা। এর আগে একবার গিয়েছিলাম ২০১২ সালে। তখনকার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ছিল বেশ হতাশাব্যঞ্জক, যার পেছনে নানাবিধ যৌক্তিক কারণও ছিল। পাঠক নিশ্চই প্রত্যাশা করছেন এবার আর হতাশ হতে হয়নি। হ্যাঁ, তা ঠিক, তবে পুরো মাত্রায় নয়। আগেরবার দেখেছিলাম একাধিক প্রজাতীর কাঠবিড়ালি এবং পাখি। রেসাস বানর চোখে পড়েছিল মাত্র একটি পয়েন্টে। অবশ্য অনেক বেশি সময় নিয়ে যে ঘুরতে পেরেছিলাম তা নয়। আরও বেশি গভীরে প্রবেশ করতে পারলে হয়তো আরও অনেক কিছু দেখা যেত। নিধনের সাক্ষী হিসেবে দেখেছিলাম কাটা গাছের অজশ্র গুড়ি। কথা হয়েছিল বনের ভেতর বসবাসকারী ও বাইরের দু’চার জনের সাথে। সব শেষে তৎকালীন রেঞ্জ কর্মকর্তার সাথে আন্তরিক কথাবার্তায় বেরিয়ে এসেছিল আরও কিছু তথ্য। সব মিলিয়ে বনটা উজাড় হয়ে যাবে কি না! এমন চিন্তা মাথায় নিয়ে ফিরেছিলাম। কারণ এই প্রকৃতি না বাঁচাতে পারলে আমরা বাঁচব না। তবে এবার গিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করার পর বেশ আশাবাদী হয়েছি। কিন্তু শঙ্কার বিষয় হল এই আশাবাদ কত দিন স্থায়ী হবে কে জানে!

 

বেশ কয়েক মাস আগে রেমা-কালেঙ্গা ঘুরে এলো ভ্রমণপিপাসু ও পরিবেশ সচেতন বন্ধু মির্জা রাসেল। তার সাথে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে গিয়ে জানতে পারলাম অনেক আশাবাদী তথ্য। তার দেয়া তথ্য আর নিজের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা সাথে নিয়ে ২৮ মার্চ ভোরের বাসে রওনা দেই। বেলা এগারোটার পরপরই পৌঁছে যাই হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ। ভ্রমণ সঙ্গী হিসেবে ছিল আমার বেশ কিছু অভিযানের সহযাত্রী রোকনুজ্জামান সোহাগ। পেশায় চিকিৎসক হলেও পশুপাখি ও প্রকৃতির ওপর রয়েছে তার বিস্তর পড়াশোনা। শায়েস্তাগঞ্জ থেকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে উপস্থিত হই চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদে। সরকারের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে রোকন খুব সহজেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে বন বিভাগের রেমা-কালেঙ্গা রেস্টহাউজ বুকিং দিতে সক্ষম হলো। থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে পুনরায় অটোরিকশা নিয়ে এক ঘণ্টায় গিয়ে নেমে পরলাম প্রত্যন্ত এক স্ট্যান্ডে। জনমানবের চিহ্ন নেই, কেবল মাত্র দুইটি দোকান। সেখান থেকে রিকশাভ্যানে করে যেতে হলো খোয়াই নদীর ঘাটে।

 

 

উজানের পাহাড়ি ঢলে নদীর পেট একেবারে টইটুম্বুর। আর ওপর থেকে চৈত্রের সূর্য মামা দাঁত কিটমিটিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। ঘাটে একটি মাত্র নৌকা বাঁধা কিন্তু মাঝি নেই। মাঝির অপেক্ষায় স্কুল ফেরৎ কয়েকটি শিশু-কিশোর গালে হাত দিয়ে বসে রয়েছে। হঠাৎ দু’জন অচেনা মানুষ দেখে খানিকটা নড়েচড়ে উঠল আর মুখে ফুটে উঠল অনিশ্চয়তা ঘুঁচে যাওয়ার হাসি। মাঝির হয়ে প্রক্সি দিতে এগিয়ে এলেন স্থানীয় এক কৃষক। ঢলের পানির খরস্রোত কেটে কেটে ঘাট থেকে বেশ খানিকটা ভাটিতে গিয়ে হলেও শেষ পর্যন্ত আমাদের পার করে দিতে সক্ষম হলেন তিনি। ওপারে ঘাট থেকেই পথ এগিয়েছে রেমা টি-এস্টেটের মাঝ দিয়ে। চা-বাগানের কয়েকটি টিলা পেরিয়ে পথ যেন ডালপালা ছড়ানো শুরু করল। কোন পথ ধরে এগুতে হবে, এমন দ্বিধাযুক্ত পরিস্থিতিতে চোখে পড়ে পাশের টিলার কোল ঘেঁষে এক চা শ্রমিক পল্লী। একপা দু’পা করে আমাদের এগিয়ে যাওয়া দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন চা শ্রমিক বিপন বড়াক। কিছু বলার আগেই তার সব বুঝে নেয়া সারা। আগ বাড়িয়ে বললেন, চলেন পথ দেখিয়ে দেই। প্রায় দেড় কি.মি. পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। পাশের পথটি চলে গেছে শকুন প্রজনন ও অভয়াশ্রম এলাকার দিকে। উল্লেখ্য, দেশে শকুন প্রজনন কেন্দ্র ও অভয়াশ্রম রয়েছে মাত্র দুইটি। একটি রেমা-কালেঙ্গা এবং দ্বিতীয়টি সুন্দরবনে।

 

 

পথ এখনও অরণ্যে প্রবেশ করেনি। অন্যের ফেলে যাওয়া ক্যান্ডি, স্যালাইন ও বিস্কুট-চানাচুরের প্যাকেট কুড়াতে কুড়াতে রোকনের নির্দিষ্ট থলেটি এরই মধ্যে ভরে গেল। মনে হচ্ছে পথে আরও পাওয়া যাবে কারণ কালেঙ্গা পর্যন্ত পৌঁছতে হাঁটতে হবে গুনে গুনে বারো কি.মি.। বনের গভীরে প্রবেশের আগে সর্বশেষ বসতির ছোট্ট দোকান পেয়ে চুলায় পুড়িয়ে ওগুলোর একটা গতি করা গেল। ছোলা সেদ্ধ এবং মুড়ি খেয়ে ছোট ছোট জংলী পানের একটি করে খিলি মুখে পুরে পথ চলা শুরু করলাম। শাল গাছের ছায়ায় ঢাকা সরু পথ। বনের মাঝে কোথাও কোথাও বৃষ্টি হয়ে গেছে। এঁটেল মাটির পিচ্ছিল পথে বুটের ওজন দুইগুণ বেড়ে গেল। যে করেই হোক দিনের আলো থাকতে থাকতে কালেঙ্গায় পৌঁছতে হবে। এক পর্যায়ে পথ এগিয়েছে ডেউয়া ফল গাছে ঢাকা এলাকাটার মাঝ দিয়ে। অজস্র কচি ডেউয়া ফল পড়ে পথ সেজে রয়েছে এক গোলাপী রঙের কার্পেটে। বন দস্যুরা হাতে গোনা দু’চারটি বৃক্ষ কেটে নিয়ে গেছে। পরিমাণের দিক থেকে আগেরবার যা দেখেছিলাম তার তুলনায় নগন্য বলা যায়। তবুও মনের মধ্যে আনচান করতে থাকল। গজারি বৃক্ষের দীর্ঘ এলাকার মাঝ দিয়ে ক্রমেই প্রবেশ করি অন্ধকার প্রায় ঘন অরণ্যে। সমস্ত পথে মানুষ মাত্র আমরা দুজন কিন্তু ভয় বা আতঙ্ক কোনো কিছুই অনুভূত হল না। আশপাশ দিয়ে অজস্র কাঠবিড়ালির ছোটাছুটি। অতি কষ্টে একটাকে ক্যামেরা বন্দী করা সম্ভাব হল।

 

 

ছবি তোলায় অধিক মনোযোগী হলে বিপদে পড়তে হবে, যেহেতু সন্ধ্যা নমার আগে পৌঁছা চাই। সুতরাং, বানর আর কাঠবিড়ালি অনেক হলেও রয়ে-সয়ে ছবি তোলার শখ-এ লাগাম টেনে ধরতে হল বারবার। এত বানর অথচ একটাকেও ফ্রেমে আটকাতে পারলাম না। এরই মধ্যে শুরু হল বৃষ্টি। বৃক্ষের পাতায় বর্ষণের শব্দ বহুদূর থেকে ধেয়ে এলো। এই পরিস্থিতিতে পথ রোধ করে দাঁড়ায় এক সবুজ, খয়েরী আর বাদামী রঙের মিশ্রণে অপরিচিত একটি সাপ। শান্ত সরীসৃপটিকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চললাম। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় গিয়ে উপস্থিত হলাম কালেঙ্গা। রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বীট কর্মকর্তা দুজনেই অপেক্ষায় ছিলেন। দেখা মাত্রই এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, ঢাকা থেকে এসেছি কি না? হ্যাঁ বলতেই অন্যরকম অভ্যর্থনা পেলাম।

 

রাতের খাবার শেষে পরিপাটি বিছানা দেখে শরীর শুধু যাই যাই করতে থাকল। প্রশ্রয় না দিয়ে রাতের বাজারটা দেখতে বের হলাম। মাত্র চার বছরের মধ্যে দুই দোকানের স্থলে প্রায় পনেরোটা দোকান হয়ে গেছে। ঔষধের দোকানও হয়েছে। কটেজের মালিক স্বপন ভাই সাথে করে নিয়ে ঘুরলেন, বসতে বললেন ক্লাব ঘরে। সেখানে টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা চলছে। আমরা চা পান করে রুমে ফিরলাম। ফিরেই সোজা বিছানায়।

 

 

বীট কর্মকর্তার ঠিক করে দেয়া গাইড ভোর সাড়ে পাঁচটায় এসে ডেকে তুললো। বেরিয়ে পরলাম প্রথমে চশমা হনুমান ও মুখপোড়া হনুমানের বিচরণ এলাকায়। এর আগে দেখা হল তীর-ধনুক ও লাঠি, বল্লম হাতে কয়েকজন যুবকের সাথে। সারা রাত বন পাহারা দিয়ে ঘরে ফিরছে। সরু খাল পেরিয়ে বনের গভীরে প্রবেশ করে দুপুর দুইটা পর্যন্ত বনের নানা পয়েন্টে তন্য তন্য করে বেড়ালাম মুখপোড়া অথবা চশমা কোনো হনুমানেরই দেখা মিললো না। বয়স কম হলেও নোমান বেশ অভিজ্ঞ গাইড হয়ে উঠছে। শব্দ শুনেই বলে দিতে পারে কোনটা কোন পাখির ডাক। গাছ চেনার ক্ষেত্রেও রয়েছে তার বেশ মুন্সিয়ানা। বসন্তে ফুল ফুটে রয়েছে গাছে গাছে। একেক ফুলের একেক রকম সুগন্ধ। বনজুড়ে নানা ফুলের মিশ্রণে এক সুমিষ্ট গন্ধ ভুরভুর করছে। হঠাৎ দূর থেকে কানে ভেসে এলো একদল উল্লুকের ডাকাডাকি। ওদের পেছনে ছোটা বিফল। তারপরও অনুসরণ করে এগিয়ে যাই অনেকটা গভীরে। মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে গেল ডাকাডাকি। সামান্য দূরেই ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ সীমান্ত। সুতরাং, আর অগ্রসর না হয়ে ধরলাম ফিরতি ফথ। পানির মজুদ শেষ পর্যায়ে। ছায়ায় বসে খানিক জিরিয়ে নিতেই চোখে পড়ল ফাঁকা মাঠে বড় ঠোঁটওয়ালা ৭-৮টা পাখির ঝাক। চুপি চুপি যতদূর সম্ভব এগিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। হয়তো আরও কিছুটা এগিয়ে যাওয়া যেত কিন্তু ওদের অবাধ বিচরনে বিঘ্ন ঘটিয়ে নিছক শখ পূরণে মন সায় দিল না।

 

এরই মধ্যে ঠকঠক করে গাছ কাটার শব্দ কানে ভেসে এলো। নোমান থমকে দাঁড়িয়ে বলল, দেখা দরকার গাছ কে কাটে? গাছ চোর দেখার অভিজ্ঞতা অর্জনে আমরাও তার সাথে এগিয়ে গেলাম। খোঁজাখুঁজির পর দেখা গেল এক বৃদ্ধ জমির বেড়া দেয়ার জন্য চিকন চিকন ডাল সংগ্রহ করছে। সুতরাং, গাছ চোর দেখার যে উত্তেজনা এতক্ষণ কাজ করছিল তার অবসান হল। পথে চোখে পড়ল মালয়ানসহ বেশ কয়েক প্রজাতীর কাঠবিড়ালি। নাম না জানা সবুজ লাল এবং সবুজ হলুদ মিশ্রণের একাধিক প্রজাতীর পাখি। ঘুঘু তো রেমা-কালেঙ্গার পাখি। গাইড জীবনে নোমান এই প্রথম কাউকে হনুমান দেখাতে ব্যর্থ হল যা তার পক্ষে মেনে নেয়া কষ্টকর। কিন্তু সে হাল ছাড়বার পাত্র নয়। বনের একমাত্র টাওয়ারটার কাছাকাছি এসে বোতলে পানি ভরে নিতে হল।

 

আমরা জানি রেমা-কালেঙ্গা এলাকায় টিউবওয়েল চেপে বা মোটর দিয়ে পানি তুলতে হয় না। বিশেষ ভূমি বৈশিষ্ট্যের কারণে সেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ গভীর পর্যন্ত পাইপ পুঁতলেই অনর্গল পানি উঠে আসে। নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ থেকে শুরু করে জমিতে সেচ দেয়াসহ অন্যান্য কাজ ওতেই সমাধা হয়ে থাকে। শরীর ঠান্ডা হওয়ার পর নোমান নিজ থেকে পুনরায় প্রস্তাব করে, সামনে কিছু দূর গেলে হনুমানের আর একটি পয়েন্ট রয়েছে। ঠিক আছে বলে আমরা রওনা হলাম। কিন্তু বিধিবাম! সেখানেও দেখা পেলাম না হনুমানের। এবার ক্ষান্ত দিয়ে ফিরে এলাম।

 

বিকেল চারটায় নোমান এসে আবারও হাজির। বলল, চলেন বনের অন্য প্রান্ত ঘুরিয়ে আনি। গেলাম ওর সঙ্গে। জঙ্গলের ভেতর চুপ করে বসে একদল রেসাস বানরের মুক্ত বিচরণ অবলোকন করতে করতে অন্ধকার নেমে এল। বন মোরগ ও মুরগিগুলো মানুষের উপস্থিতি টের পাওয়ামাত্রই জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। প্রত্যাশা অনুযায়ী অনেক কিছু দেখার সুযোগ না হলেও দুই দিনের অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক আশাবাদী করে তুলেছে।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জুলাই ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়