ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

গভীর রাতে হাত বাড়িয়ে ডাকে

রাসেল পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১৩, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গভীর রাতে হাত বাড়িয়ে ডাকে

রাসেল পারভেজ : গভীর রাতে আলোভরা হাত বাড়িয়ে ডাকছে যেন। আয়, আয় রে সবাই, আলোর ঠিকানায়। এখানে আছে স্বাধীনতার গল্প, শক্তি ও সাহসের গল্প, বন্ধুত্ব ও ঐক্যের গল্প। মমতা আর বিশালতার গল্প।

 

তবে কে পারে এই ডাকে সাড়া না দিয়ে। অন্তত যারা যুক্তরাষ্ট্রে আছেন, গেছেন বা যাবেন, তাদের আলো হাতে অভ্যর্থনা জানাতে দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যাচু অব লিবার্টি (স্বাধীনতা ভাস্কর্য)।

 

বিশ্বের যত নন্দিত, জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী ভাস্কর্য আছে, তার মধ্যে প্রথম কাতারে পড়ে স্ট্যাচু অব লির্বাটি। এর নির্মাণ, মূল ভাব এবং অবস্থান সব মিলিয়ে অসাধারণ আকর্ষণ ও আবেদন তৈরি করে এই ভাস্কর্য।

 

এটি যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতার প্রতীক, সংগ্রাম, সাহস ও এগিয়ে যাওয়ার নিশান। এটি বিশ্বজুড়ে এতটাই আবেদন তৈরি করেছে যে, তা অনেক দেশের পাঠ্যপুস্তকে ঠাঁই করে নিয়েছে।  

 

যেভাবে হলো স্ট্যাচু অব লিবার্টি
১৮৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে এ ভাস্কর্য উপহার দেয় ফ্রান্স। বলে রাখা ভালো, ভাস্কর্যটি যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় ১৮৮৬ সালে। এত মূল্যবান ভাস্কর্য উপহার দেওয়ার পেছনে ফ্রান্সের কিছুটা স্বার্থ কাজ করেছে।

 

যুক্তরাষ্ট্র ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসন থেকে মুক্ত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এগিয়ে যাওয়া বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে। এই সুযোগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে পাশ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির উদ্যোগ আসে ফরাসিদের কাছ থেকে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ প্রথম আসে এডওয়ার্ড রিনি লাবুলার কাছ থেকে। লাবুলা সে সময়ে ফ্রান্সের অন্যতম প্রভাবশালী চিন্তাবিদ ছিলেন। লাবুলা তার ভাবনা সম্পর্কে জানান সেই সময়ের জগদ্বিখ্যাত স্থপতি ও ভাস্কর ফ্রেডারিক অগাস্তে বারথোলডিকে। শেষ পর্যন্ত লাবুলার উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখা শুরু করে।

 

 

লাবুলা ফরাসি সরকারের নির্দেশনা মতো যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আলোচনা করেন। ১৮৭১ সালের দিকে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে চুক্তি হয়, মূল ভাস্কর্যের ব্যয় বহন করবে ফ্রান্স। আর বেদী ও স্থাপনের খরচ দেবে যুক্তরাষ্ট্র।

 

ডিজাইন ও নির্মাণ
স্ট্যাচু অব লিবার্টির ডিজাইন করেন অগাস্তে বারথোলডি। এটি নির্মাণে নেতৃত্ব দেন আলেকজান্ডার গুস্তাভ আইফেল। এই সেই আইফেল যিনি ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের স্থপতি। ১৮৭৫ সালে ফ্রেন্স-আমেরিকান ইউনিয়ন গঠন করা হয়, যাদের হাতে স্ট্যাচু অব লিবার্টি নির্মাণের বিষয়গুলো ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর করা হয় নকশা।

 

আইফেলের নেতৃত্বে দুবছর ধরে ফরাসি ও মার্কিন ভাস্কররা স্ট্যাচু অব লিবার্টি তৈরি করেন, যা আড়াই ইঞ্চি পুরো তামার প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। ১৮৮৪ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হলে বেশ কিছু দিন ফ্রান্সের একটি জাদুঘরে এটি সংরক্ষণ করে রাখা হয়। ১৮৮৫ সালে মূর্তিটি ৩০০ খণ্ডে  খুলে ফেলা হয় এবং ২১৪টি বাক্সে ভরে জাহাজে করে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়।

 

উদ্বোধন
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভিল্যান্ড ১৮৮৬ সালের ২৮ অক্টোবর স্ট্যাচু অব লিবার্টি উদ্বোধন করেন। ২২ তলা ভবনের সমান উঁচু মূর্তিটি উপকূলের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দেখা যায়, বিশেষ করে রাতে।

 

অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের কোলে নিউ ইয়র্ক পোতশ্রয়ের মুখে বেডলো দ্বীপে স্থাপন করা হয় স্ট্যাচু অব লিবার্টি। মূর্তির নামানুসারে বেডলো দ্বীপের নাম হয় লিবার্টি দ্বীপ। এখানে শত শত জাহাজ নোঙ্গর করে। ব্যস্ততম এই দ্বীপে স্বাধীনতা, সাম্য ও মুক্তির প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যাচু অব লিবার্টি।

 

মূর্তির বিভিন্ন অংশ যেসব অর্থ বহন করছে
স্ট্যাচু অব লিবার্টি একটি নারী মূর্তি, যার পরনে ঢিলা পোশাক এবং মাথায় আলোকশিখা বিচ্ছুরিত মুকুট। এর বাঁ হাতে আছে একটি বই, যাতে খোদাই করে লেখা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার তারিখ ‘৪ জুলাই ১৭৭৬’। ডান হাতে আছে উঁচু করে ধরা মশাল, যা মুক্তির প্রতীক। পায়ের সঙ্গে থাকা ছেঁড়া শিকল বলে দিচ্ছে, পরাধীনতার খাঁচ থেকে বেরিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।

 

মূর্তির বিভিন্ন অংশের পরিমাপ
বেদী থেকে মশাল পর্যন্ত স্ট্যাচু অব লিবার্টির উচ্চতা ১৫১ ফুট ১ ইঞ্চি (৪৬ মিটার)। আর ভূমি থেকে মশাল পর্যন্ত উচ্চতা ৩০৫ ফুট ১ ইঞ্চি (৯৩ মিটার)। মূর্তি পায়ের গোড়ালি থেকে মাথা পর্যন্ত ১১১ ফুট উঁচু।

 

 

এবার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পরিমাপ দেখে নেওয়া যাক। নাক ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি, হাতের দৈর্ঘ্য ১৬ ফুট ৫ ইঞ্চি, তর্জনি ৮ ফুট, নখ ১৩ ইঞ্চি,  এক কান থেকে অন্য কান পর্যন্ত দূরত্ব ১০ ফুট, দুই চোখের ব্যবধান ২ ফুট ৬ ইঞ্চি, কোমর ৩৫ ফুট, মুখের প্রস্থ ৩ ফুট।

 

ওজন
মূর্তিটির মোট ওজন ২ লাখ ৫৪ হাজার কিলোগ্রাম।

 

আরো যা আছে
২২ তলা সমান উঁচু মূর্তিটির বেদীর সঙ্গে কয়েকটি বড় কক্ষ আছে। এই বেদীর সঙ্গে আছে জাদুঘর, নতুন অভিবাসীদের ছবি ও তাদের পরিচয়, স্ট্যাচু অব লিবার্টির নির্মাণের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস।

 

বিলুপ্তির আশঙ্কা
ঝড়ঝঞ্ঝা আর বৃষ্টিতে তামার তৈরি স্ট্যাচু অব লিবার্টির উপরিভাগের ব্রোঞ্জের প্রলেপ শতবর্ষেই সবুজাভ হয়ে গেছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে তামায় কার্বন জমা হয়। স্বাভাবিক বৃষ্টির পানিও তামার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে। এভাবে জল এবং ধাতুর রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এই সবুজাভ রঙের সৃষ্টি হয়েছে। আর বাতাস এই ক্ষয়ের গতিকে ত্বরান্বিত করে।

 

১৯৩৭ সালে প্রথমবারের মতো স্ট্যাচু অব লিবার্টির বড় ধরনের সংস্কার কাজ করা হয় আবহাওয়াজনিত ক্ষয় থেকে একে রক্ষা করার জন্য। এর ভেতরে পানি চুঁইয়ে পড়া এবং অন্যান্য ক্ষতি ঠেকানো হয়েছিল তখন। তবে কালের পরিক্রমায় এই ধাতব স্থাপত্যটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

 

যদিও ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল তিন বছর এবং ২০১১ থেকে ২০১২ সাল দুই বছর ধরে স্ট্যাচু অব লিবার্টির সংস্কার করা হয়।


 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/রাসেল পারভেজ/নওশের 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়