ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

গল্পে গল্পে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান || রণজিৎ সরকার

রণজিৎ সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩০, ২০ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গল্পে গল্পে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান || রণজিৎ সরকার

রাবা এখন বিমানে। বাবা-মার সঙ্গে। তারা যাচ্ছে আমেরিকায়। রাবার বাবা-মা চুপচাপ বসে আছেন। রাবা দুষ্টুমি করছে। সে বলল, ‘বাবা আমি বড় হয়ে বিমান চালাব।’
বাবা বললেন, ‘অবশ্যই। সেজন্য তোমাকে ভালো করে পড়ালেখা করতে হবে।’

 

রাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মা, তুমি বলো। আমি পড়ালেখায় ফাঁকি দিই। কক্ষনো দিই না। তুমি তো একদিন বলেছিলে, পড়ালেখায় ফাঁকি দিয়ে কেউ কোনো দিন বড় কিছু হওয়ার আশাও করতে পারে না। হতেও পারে না। তোমার এই কথাগুলো প্রতিদিন মনে পড়ে আমার। ভালো করে পড়ালেখা করি। তাই আমি আশা করি, বড় হয়ে একদিন বিমান চালাবই।’

 

মা বললেন, ‘অবশ্যই চালাবে। কিন্তু তোমার পড়ালেখায় আরো ভালো করতে হবে। আর পড়ালেখা ভালো না করলে এই প্রতিযোগিতার যুগে টিকতে পারবে না কিন্তু। সেজন্য তোমার প্রধান কাজ হচ্ছে পড়ালেখা, পড়ালেখা আর পড়ালেখা। ভালো রেজাল্ট করা।’

 

‘অবশ্যই মা। আমি ভালো করে পড়ালেখা করব। ভালো রেজাল্ট করব। তোমাদের মুখ উজ্জ্বল করব। আমার ইচ্ছা পূরণ করব।’
‘কথাগুলো যেন মনে থাকে।’
‘অবশ্যই থাববে, মা। কারণ আমি বড় হয়ে বিমান চালাবই।’

 

‘আচ্ছা, আমিও আজ থেকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। আমার ছেলে একদিন পাইলট হবে। আমি হব পাইলটের মা।’
রাবা খুশি হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। মা আদর করে রাবার কপালে চুমো খেলেন।
রাবার বাবা বললেন, ‘রাবা, তুমি কি জানো?’
বাবার দিকে তাকিয়ে রাবা বলল, ‘কী বাবা?’
‘আমাদের কোন বীরশ্রেষ্ঠ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মারা গিয়েছেন?’
রাবা বলল, ‘না বাবা, কোথায় যেন পড়েছিলাম। কিন্তু মনে করতে পারছি না এই মুহূর্তে। কী যেন নাম তার? নামটা বলো না বাবা!’
বাবা বললেন, ‘তার নাম মতিউর রহমান। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান।’
বাঁ হাতটা নিজের মাথায় রেখে চুলের ভেতর আঙুল চালাতে চালাতে রাবা বলল, ‘ও, মনে পড়েছে! আচ্ছা বাবা, তিনি কীভাবে যেন মারা গিয়েছিলেন?’
‘দেশের জন্য তিনি মারা গিয়েছেন।’
‘দেশের জন্য! দেশের জন্য কেন তিনি মারা গেলেন? আমাকে একটু খুলে বলবে, বাবা?’
বাবা রাবার মাথায় বা হাত রাখলেন। চুলগুলো নাড়তে নাড়তে বললেন, তা হলে শোনো। মনোযোগ দিয়ে শোনো। ১৯৭১ সাল। দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানি একটি বিমান মতিউর রহমান ছিনতাই করতে চেয়েছিলেন দেশের জন্য।’

 

‘বাবা, মোবাইল ছিনতাই হয়। টাকা ছিনতাই হয়। ছোটখাটো আরো কত কিছুই তো ছিনতাই হয়। কিন্তু বিমান ছিনতাই করা যায়, তা তো জানতাম না। আজ যদি আমাদের এই বিমান ছিনতাই হয়। তাহলে কী হবে আমাদের?’
রাবার মা বললেন, ‘এমন কথা বলে না, বাবা।’
‘বাবা, তাহলে বলো তো মতিউর রহমান কীভাবে বিমান ছিনতাই করেছিলেন?’
বাবা বললেন, ‘বলছি, শোনো।’
রাবা বলল, ‘আচ্ছা, বলো বাবা।’
‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে মতিউর রহমান ছুটিতে ছিলেন। ছুটি নিয়ে তিনি তার গ্রামের বাড়িতে ছিলেন।’
‘বাবা, গ্রামের বাড়ি কোথায় ছিল মতিউর রহমানের?’
‘নরসিংদী জেলার রামনগর গ্রামে।’

 

একটু থেমে বাবা বললেন, ‘তার গ্রামের বাড়িতে বসেই তিনি রেডিওতে শুনলেন স্বাধীনতার ঘোষণা। বড় ভাই ও এক ছেলেকে নিয়ে মতিউর টিনের খালি জার বাজিয়ে পরদিন মিটিং ডাকলেন। সেই রাতেই অসংখ্য মানুষ তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। মতিউর এক মাস গ্রামে থেকে দেখতে পেলেন বাঙালির ওপর নির্মম গণহত্যা, অসহায় মা-বোন-মেয়ের সম্ভ্রমহানির ভয়াবহতা আর অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট। গ্রামের লোকজনকে নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়াও শুরু করলেন তিনি। কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝিতে নরসিংদী, রায়পুর, তৈর, আশুগঞ্জ সম্পূর্ণ এলাকায় বিমানবাহিনীর বোমাবর্ষণ তাকে ভীষণ বিচলিত করে তোলে। কারণ সেসব পাইলটকে তিনিই প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। প্রথমে চিন্তা করলেন ভারতে চলে যাবেন। কিন্তু পারলেন না। মুক্তিযোদ্ধে যোগ দেওয়া হলো না তার। স্ত্রী-মেয়ে নিয়ে ৬ মে করাচিতে চাকরিস্থলে যোগ দিলেন। পরিকল্পনা করলেন, যেভাবেই হোক যুদ্ধে তাকে যোগ দিতেই হবে। কীভাবে দেশকে স্বাধীন করা যায়। কীভাবে রক্ষা করা যায় দেশের মানুষকে।’
বিমানবালা এলেন। এসে বললেন, ‘স্যার, আপনাদের কিছু লাগবে?’

 

রাবা বলল, ‘না না এখন কিছু লাগবে না। আপনি একটু পরে আসেন। এখন বাবার কাছে থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনছি। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানে গল্প শুনছি।’

 

বিমানবালা রাবার মাথায় দিয়ে আদর করে বলল, ‘ঠিক আছে বাবু। আমি পরে আবার আসব। তোমার কী লাগবে আমাকে বলবে, কেমন।’
বিমানবালা চলে গেলেন।
রাবা বলল, ‘বাবা গল্প শুরু করো।’

 

বাবা আবার গল্প বলা শুরু করলেন। বললেন, ‘কিছুদিন আগে বেসরকারি বিমান ছিনতাইচেষ্টার ঘটনা ফাঁস হয়েছে। তাই পাকিস্তানে চাকরিরত সব বাঙালি পাইলটদের গ্রাউন্ডেড করা হয়। অর্থাৎÑ বিমান নিয়ে আকাশে ওড়া নিষিদ্ধ করা হয়। মতিউর রহমান নিজে নিজে পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনা অনুসারে সামরিক বিমান ছিনতাইয়ের চিন্তায় থাকেন। তারপর সুযোগ আসে ২০ আগস্ট ১৯৭১ সালে। দিনটি ছিল শুক্রবার।’

 

রাবা উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘বাবা, সেদিন কী হয়েছিল?’
মা বললেন, ‘তোমার বাবার কথা শেষ করতে দাও আগে।’
বাবা বললেন, ‘সেদিন বেলা ১১টা। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সমরুম ঘাঁটি। মতিউরের ছাত্র পাইলট রশিদ মিনহাজের টি-৩৩ বিমান নিয়ে উড্ডয়নের শিডিউল ছিল সেদিন। বেইস ফ্লাইট সেফটি অফিসার মতিউর রহমান তা জানতেন। রশিদ মিনহাজ উড্ডয়নের জন্য কন্ট্রোল- টাওয়ারের অনুমতি চাইলে, কন্ট্রোল-টাওয়ারে তখন কর্তব্যরত অফিসার ছিলেন বাঙালি পাইলট অফিসার ফরিদ ও পাকিস্তানি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আসিম। এ ধরনের মহড়ায় যাওয়ার জন্য বিমানগুলোকে সাংকেতিক নাম ব্যবহার করতে হতো। এবং যোগাযোগ রক্ষা করতে হতো ওই সাংকেতিক নামে।’
‘বাবা, সাংকেতিক নামটা কী ছিল?’

 

‘বলছি তো, তুমি ধৈর্য ধরে শোনো। সে সাংকেতিক নাম ছিল টি-৩৩। বিমানের সাংকেতিক নাম ছিল-ব্লু-বার্ড-১৬৬। কিছুক্ষণের মধ্যেই উড়বে এই বিমানটি। পাইলট মিনহাজ বিমানটিকে চালিয়ে নিয়ে এল ২৭ রানওয়েতে। সংকেত পেলেই ডানা মেলে দেবে আকাশে।’
‘বাবা, তারপর কী হলো? বিমানটি কি আর আকাশে ওড়েনি?’
রাবার মা বললেন, ‘তোমার বাবাকে বলতে দাও।’
‘আচ্ছা, বাবা তুমি বলো।’

 

বাবা বললেন, ‘উড়বে, সেই মুহূর্তেই বিমানটির পাশে এসে একটি গাড়ি থামল। দ্রুত নেমে এল মতিউর রহমান। মিনহাজকে বিমানটি না ওড়ার সংকেত দিলেন। বেইস ফ্লাইট সেফটি অফিসারের নির্দেশ মানতে বাধ্য। রশিদ মিনহাজ বিমান থামিয়ে ক্যানোপি খোলার সঙ্গে সঙ্গে মতিউর রহমান দ্রুততার সঙ্গে ককপিটে উঠে বসেন। দ্রুতই তিনি মিনহাজের স্পিকার ও হেডফোন থেকে সংযোগ তারটি বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। সেখানেই শুরু হলো দুজনের ধস্তাধস্তি। মিনহাজকে কাবু করে মতিউর বিসানটিকে ওড়ালেন। মতিউর রহমান ছিলেন একজন দক্ষ পাইলট। সিন্ধুর বেদিনের রাডার স্টেশনের শক্তিশালী রাডার পর্দায় যাতে বিমানের অবস্থান ধরা না পড়ে এজন্য খুব নিচু দিয়ে ভারতের দিকে উড়ে যাচ্ছিল ব্লু-বার্ড-১৬৬।’
‘বাবা তারপর কী হলো?’

 

‘খবর ছড়িয়ে পড়ল, ব্লু-বার্ড-১৬৬ ছিনতাই হয়ে গেছে। বিমানবন্দরে দেওয়া হলো রেড অ্যালার্ট। সঙ্গে সঙ্গে দুটি পাকিস্তানি এফ-৮৬ জঙ্গি বিমান উড়ে গেল আকাশে। তাড়া করতে গেল মতিউরের বিমানটাকে। বিমানটি ওড়ার সময়ই ডানে-বাঁয়ে, ওপরে-নিচে দুলছিল। দুজনের ধস্তাধস্তির কারণেই বিমানটি বিপজ্জনকভাবে উড়ে গেল। কন্ট্রোল টাওয়ারে ডিউটিরত পাইলট অফিসার ফরিদউজ্জামান জানতে চাইলেন, ‘‘ছিনতাই নিশ্চিত করে জানাও।’’ কোনো উত্তর এল না। বেদিনের রাডার স্টেশন জানায়, তারা রাডারের পর্দায় ব্লু-বার্ড-১৬৬-এর গতিবিধি বুঝতে পারছে না। 

 

বিকেলে খবর পাওয়া যায়। মরু অঞ্চলে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। সেখান থেকে প্রায় আধা মাইল দূরে পাওয়া গেল মতিউর রহমানের লাশ। পাকিস্তানি পাইলট রশিদ মিনহাজের ছিন্নভিন্ন দেহ পাওয়া গেল।’

 

বাবা, ‘মতিউর রহমানের লাশটা কী করেছিল?’
বাবা বললেন, ‘মতিউর রহমানকে তার প্রিয় সোনার বাংলা থেকে ১১০০ মাইল দূরে, করাচির মাশরুস বিমান ঘাঁটিতে অতি অবহেলায় একটি সাধারণ কবর দেওয়া হয়। যা ছিল চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত স্থান।’
‘কী বলো, বাবা! এত অবহেলা। তার প্রতি।’
রাবার মা বলেন, ‘তুমি কি জানো, এখন মতিউরের লাশ কোথায় আছে?’
মায়ের দিকে তাকিয়ে রাবা বলল, ‘না তো মা। তুমি জানো, মা?’
‘হ্যাঁ, আমি জানি।’
‘তাহলে বলো?’

 

‘বলছি, শোনো। সে কবর থেকে ২০০৬ সালের ২৪ জুন সকাল ১০টা ২৮ মিনিটে ফিরিয়ে আনা হয় স্বদেশে মতিউরের দেহাবশেষ। বর্তমানের তাঁর দেহাবশেষ রাখা আছে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে।’
রাবা বলল, ‘তাই মা। এরপর যখন বাংলাদেশে ফিওে যাব তখন তার কবর দেখতে যাব সবাই মিলে।’
‘আচ্ছা, তোমাকে নিয়ে যাব।’
‘বাবা, মতিউর রহমান জন্মগ্রহণ করেছিলেন কোথায়?’

 

বাবা বললেন, ‘১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মোবারক লজ, ১০৯ আগা সাদেক রোড, ঢাকা।’
‘তার বাবার নাম কী ছিল, বাবা?’
‘তার বাবার নাম ছিল আবদুস সামাদ।’
‘পেশা কী ছিল?’
‘অফিস সুপারিনটেনডেন্ট। ঢাকা কালেক্টরেট।’
‘মা, তুমি বলো তার মায়ের নাম কী ছিল?’
‘তার মায়ের নাম ছিল সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন।’
‘মা, তার স্ত্রীর নাম কী ছিল?’
‘মিলি রহমান।’

 

‘আচ্ছা, মতিউর রহমানের সন্তানের নাম যেন কী বললে একটু আগে?’
‘তার দুটি মেয়ে ছিল। একজনের নাম মাহিন মতিউর, অন্যজনের নাম মুহিন মতিউর হায়দার।’
‘আচ্ছা, বাবা, মতিউর রহামান পড়ালেখা করেছিলেন কোন শ্রেণি পর্যন্ত?’

 

‘মতিউর রহমান ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। তারপর বাবার একান্ত ইচ্ছায় পড়তে চলে যান তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সারগোদার পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পাবলিক স্কুলে। সেখানেই তিনি দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। তারপর পাকিস্তানি বিমানবাহিনী একাডেমিতে যোগদান করেন। ১৯৬৩ সালের জুন মাসে দুই বছর পর তিনি বৈমানিক হিসেবে কমিশন পান।’
‘আচ্ছা, মতিউররা ভাইবোন কতজন ছিলেন?’
‘মতিউরেরা ছিলেন নয় ভাই, দুই বোন। তিনি ছিলেন অষ্টম।’
‘ওহ্। মতিউর রহমান সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম তো। এখন কিছু খাব মা।’
‘ঠিক আছে। বিমানবালাকে ডাকছি।’
‘ঠিক আছে মা।’

 

এই বলে মায়ের কোলে রাবা মাথা রাখল। একটু পর বিমানবালা এলেন। রাবা তার পছন্দের খাবার নিয়ে খেতে লাগল।’
বিমান তখন উড়ছে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ আগস্ট ২০১৫/কমল কর্মকার

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়