ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘দিলীপ আমার স্মৃতি, আমাদের চলচ্চিত্রের স্মৃতি’

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘দিলীপ আমার স্মৃতি, আমাদের চলচ্চিত্রের স্মৃতি’

রাহাত সাইফুল : ষাটের  দশকে  বাংলা চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে দিলীপ বিশ্বাসের।  তিনি একাধারে পরিচালক, প্রযোজক, কাহিনিকার, অভিনেতা ও গায়ক। ষাটের দশকে গায়ক হিসেবে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।  তবে কমেডিয়ান হিসেবে বেশ খ্যাতি ও জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিলেন।  বহু গুণে গুণান্বিত এ মানুষটি ১৯৪৫ সালে পিরোজপুরের চাঁদকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

 

২০০৬ সালের ১২ জুলাই না ফেরার দেশে চলে যান দিলীপ বিশ্বাস।  তার মৃত্যুর অনেকটা দিন কেটে গেলেও তার সহকর্মীদের কাছে এখনো তিনি অমলিন। এখনো তারা তাকে স্মরণ করেন।  ৪ ডিসেম্বর প্রয়াত এ নির্মাতার জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে গতকাল দীপ জ্বেলে ও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তার সহকর্মীরা।  এ সময় উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা আমজাদ হোসেন, সাঈদুল ইসলাম সাঈদ, শিল্পী চক্রবত্রী, কাজী কামাল, শাহীন সুমন, আনোয়ার সিরাজী, মোস্তাফিজুর রহমান মানিক, রকিবুল ইসলাম রকিবসহ অনেকে।

 

এ সময় ম্মৃতিচারণ করে আমজাদ হোসেন বলেন, ‘দিলীপ আজ তোমার ছেলেকে দেখলাম, তোমার নাতনিকে দেখলাম। তোমার তিন পুরুষকে আমি দেখলাম। দিলীপ সর্ম্পকে অনেক স্মৃতি রয়েছে।  দিলীপ জহির রায়হানের সেটে সব সময় যেত।  সুমিতা দেবী দিদি দিলীপকে ভীষণ আদর করত, যা চিন্তাও করা যায় না। দিলীপ খুব দুষ্ট ছিল।  তার সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল- সিরিয়াস কথা খুব কম বলত।  ও যে দিন রাত চলচ্চিত্রের কথা ভাবছে, এটা হয়তো কেউ বাহির থেকে বুঝত না।’

 

তিনি আরো বলেন, ‘‘বেহুলা’ সিনেমায় দিলীপকে দিয়ে গান করিয়েছি। এতে ‘দ্বার খোলো দ্বার খোলো হৈ হৈ…’ হৈ হৈ কথাটা দিলীপের আবিষ্কার। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আমাকে ওস্তাদ বলে ডেকেছে। মৃত্যুর আগের একটি বছর দিলীপ খুব ক্লান্ত ছিল এবং কথা খুব কম বলত।  সব শুটিংয়ে দিলীপ যেত। দিলীপ সবার কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটত।  আমি একদিন ওর কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, ‘দিলীপ তুমি ভালো আছো তো?’  দিলীপ হেসে বলল,  ‘ওস্তাদ আমি ভালো আছি।’ আসলে দিলীপের হাসি ভালো ছিল না।  দিলীপ আমার স্মৃতি, আমাদের চলচ্চিত্রের স্মৃতি।’’

 

আমরা যেটাকে পরিচালক সমিতি বলি সেখানে কি পরিচালকদের জন্মদিন মৃত্যূদিন পালন করা হয়েছে?  ৪৫০ জনের জন্মদিন পালন করতে পারব না কিন্তু যারা চলচ্চিত্রে অবদান রেখেছেন তাদের জন্মদিন ও মৃত্যুদিন পালন করা যায়।  আজ থেকে আমরা দিলীপের মতো মানুষদের জন্ম-মৃত্যুদিন বট গাছের নিচে বসে হলেও পালন করব।  আমরা যতদিন বেঁচে থাকব এই নামটি ভুলে যেতে পারব না। চলচ্চিত্রের সবার হৃদয়ে ছবি হয়ে আছে দিলীপ বিশ্বাস। জহির রায়হান যেমন ছবি হয়ে আছেন, দিলীপ বিশ্বাসও ছবি হয়ে আছে। জহির রায়হান এক দিকে আর দিলীপ বিশ্বাস অন্য দিকে।  দিলীপ বিশ্বাস আমাদের চলচ্চিকারদের মধ্যে বিশেষ নাম।’ বলেন আমজাদ হোসেন।

 

পরিচালক জাকির হোসেন রাজু বলেন, ‘‘সহকারী পরিচালক হিসেবে অনেকদিন কাজ করেছি। তখন দাদাকে দেখলে সালাম দিতাম। পরিচিত হওয়ার মতো সাহস পাইনি। আমার প্রথম সিনেমা ‘জীবন সংসার’। সিনেমাটি মুক্তির পর কালু ভাই আমাকে বলল দাদা তোকে খুঁজছে। আমি গিয়ে তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। এরপর আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল, ‘আমি তোর সিনেমাটা দেখেছি। দেখে আমার অনেক ভালো লেগেছে। এজন্যই তোকে ডেকেছি।’ সেদিন আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। দিলীপ বিশ্বাস মানেই- সোশ্যাল সিনেমার মাস্টার মেকার। সে আমার প্রথম সিনেমা দেখে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমাকে দোয়া করেছিলেন, সে অনুভূতি ব্যক্ত করার মতো ভাষা আমার নেই।’’

 

এ অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেন প্রয়াত দিলীপ বিশ্বাসের স্ত্রী গায়ত্রী বিশ্বাস ও সাবির্ক তত্বাবধানে ছিলেন দেবাশীষ বিশ্বাস।

 

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রে তিনি গায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এ ছাড়াও আনোয়ারা, মোমের আলো, দুই ভাই, আলোমতি, সন্তান ও চেনা অচেনা সিনেমার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন্ তিনি। এরপর হাবুর বিয়ে নামে একটি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন। পরে মনোনিবেশ করেন চলচ্চিত্র পরিচালনায়। সহকারী পরিচালক হিসেবে আগুন নিয়ে খেলা সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন। পূর্ণ-পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন সত্তরের দশকে সমাধি সিনেমা নির্মাণের মাধ্যমে। মুক্তির পর সিনেমাটি ব্যবসায়ীকভাবে সফল হয়।

 

১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের তিন কিংবদন্তি অভিনেতা রাজ্জাক, আলমগীর ও সোহেল রানা`কে একসঙ্গে নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন জিঞ্জির চলচ্চিত্রটি। এ সিনেমাটি তখন অনেক দর্শক প্রিয়তা লাভ করে। এরপর দাবী, বন্ধু, আসামী, অনুরোধ, জিঞ্জির, আনারকলি, অংশীদার, অপমান, অস্বীকার, অপেক্ষা, অকৃতজ্ঞ, অজান্তের মতো জনপ্রিয় সিনেমা নির্মাণ করেন তিনি। দর্শক নন্দিত এ নির্মাতা সর্বশেষ ২০০৫ সালে নির্মাণ করেন মায়ের মর্যাদা। সিনেমাটি ২০০৬ সালে মুক্তি পায়।

 

প্রযোজক হিসেবেও প্রতিটি সিনেমায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছেন তিনি। নিজের পরিচালিত সিনেমাগুলোর অধিকাংশের নামের আদ্যাক্ষর ‘অ’ হওয়ায় ঢাকার চলচ্চিত্রাঙ্গনে তাকে নিয়ে আলোচনা, কৌতূহল ছিল। ‘অ’ কে অনেকে অশুভ, অসফল ইত্যাদি মনে করলেও দিলীপ বিশ্বাস ‘অ’ কে শুভ এবং সাফল্যের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আপন দক্ষতা এবং যোগ্যতায়।

 

চিত্রনির্মাতা হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। বড় বাজেটে নামিদামি জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে জমজমাট নাটকীয় কাহিনির বাণিজ্যিক ঘরানার সিনেমা নির্মাণে নিজস্ব একটি ধারার সৃষ্টি করেছিলেন দিলীপ বিশ্বাস। প্রখ্যাত এ নির্মাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ ডিসেম্বর ২০১৬/রাহাত/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়