ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

গ্যাসের গরম, বিদ্যুতের শক ও পেঁয়াজের ঝাঁজ

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৬, ৩০ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গ্যাসের গরম, বিদ্যুতের শক ও পেঁয়াজের ঝাঁজ

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

তাপস রায়

ভাদ্রের গরমটা হয় চরম! একেবারে ‘তালপাকা’ যাকে বলে। যদিও এবার তেমনটা এখনো বোধ হচ্ছে না বৃষ্টির কারণে। তার পরও ভাদ্রের গরমের আঁচ দেশবাসী পাচ্ছেন। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো তালপাকা গরম তালপাখার বাতাসে দূর হচ্ছে না। গৃহকর্তার একেবারে ত্রাহি অবস্থা! বেচারা কেঁদে বাঁচবেন সে উপায় নেই। অমনি হয়তো গিন্নি সরব হয়ে বলবেন :

 

 


‘এ কেমন পুরুষ তুমি
এ কেমন মর্দ
কান্নাকাটি জুড়ে দাও
দেখে বাজারের ফর্দ!’

পাঠক, এতক্ষণে হয়তো বুঝে গেছেন গরমের কারণটা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুতের বাড়তি দাম। এ নিয়ে সরকারের শরিক দলগুলোও সমালোচনায় মুখর। নিজের ছায়ার মধ্যে ভূত দেখে যারা চমকে ওঠেন, তারা ইতিমধ্যে বলতে শুরু করেছেন- সূক্ষ্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কি না খতিয়ে দেখা উচিত। বাম ঘারানার দলগুলো এর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। সম্প্রতি তাদের এক বিক্ষোভ সমাবেশে কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘অযৌক্তিকভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার ১৬ কোটি মানুষকে ইলেকট্রিক শক দিয়েছে।’

সৈয়দ আবুল মকসুদ যখন এই বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন আগামী ডিসেম্বরে আরো এক দফা গ্যাসের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। এ খবর শুনে হাসব, না কাঁদব- বুঝতে পারিনি। অধিক শোকে মানুষ পাথর হয়ে যায় শুনেছি, অধিক শকে কী হয় জানতে ইচ্ছে করছে। যদিও প্রতিমন্ত্রী আশার বাণী শুনিয়ে বলেছেন, এই মূল্যবৃদ্ধিতে নাকি জনগণের  জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

প্রতিমন্ত্রীর আশ্বাস শুনে আমার সেই গল্পটির কথা মনে পড়ছে। শিকারি তার সন্তানকে বলছে, শোন, বনে হঠাৎ বাঘের মুখোমুখি পড়ে গেলে ভয়ে দৌড় দিবি না। বাঘের চোখ বরাবর আগুন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকবি। দেখবি, ভয় পেয়ে বাঘ পালিয়ে যাচ্ছে। এটাই হচ্ছে বাঁচার কৌশল।
বাবার কথা শুনে ছেলে বলল, কৌশলটা আমরা জানি, কিন্তু বাঘ জানে তো?

কথাটা এজন্য বলা যে, ডিসেম্বর এলেই এ দেশের অধিকাংশ বাড়িওয়ালা গোঁফে তা দেন। তারা গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে ভাড়া বাড়ানোর এই সুযোগ হেলায় হারাতে চাইবেন বলে মনে হয় না। এ দেশের রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে অনেক বাড়িওয়ালার কিঞ্চিৎ মিল আছে। অতিবৃষ্টি, মাঝারি বৃষ্টি, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, খাঁ-খাঁ রোদ, কাকডাকা ভোর, নিশিরাত, হালকা জ্যাম, ঘনজ্যাম ইত্যাদি অজুহাত তাদের রয়েছে, বাড়িওয়ালাদেরও অনেকটা তা-ই। তারা উপলক্ষ খোঁজে! সুতরাং প্রতিমন্ত্রী যতই কৌশলী হয়ে আশ্বাস দেন, বাড়িওয়ালারা সেটা বুঝবে তো?

ইতিবাচক কোনো কিছুই এখন আর দেখা যাচ্ছে না। যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই বাড়ানো হলো গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম। বিশ্ববাজারে সোনার দাম কমলেও আমাদের বাজারে তা কমেনি। পেঁয়াজের  ঝাঁজে গ্রাহকের করুণ দশা। অন্যান্য সবজিও যে গ্রাহক স্বস্তি নিয়ে কিনছেন, এমন নয়। পটোল কিনতে গেলে পটোলচেরা চোখ কপালে ওঠে। বেগুনের গুণ যত কমই থাকুক, টাকা দিয়েই তা কিনতে হয়। বরবটি, ঢ্যাঁড়স, মরিচ পেঁয়াজের পথেই এগোচ্ছে। চাল, ডাল, লবণ, তেল- সবকিছুই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এখানে সবচেয়ে বড় রসিকতা এই যে, বেশি দামে গ্রাহক যে ভালো জিনিস পাচ্ছেন সে গ্যারান্টিও নেই! তাহলে আমরা যাব কোথায়?

বলা হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় টানা বর্ষার ফলে সবজির ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দাম বেড়েছে। কিন্তু পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি পুরোপুরি প্রাকৃতিক নয়। ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজের ওপর আমাদের বাজারের পেঁয়াজের দাম কিছুটা নির্ভরশীল। পেঁয়াজের ঝাঁজ এখন ভারতের ক্রেতারাও টের পাচ্ছেন। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এ কারণেই বুঝি এখানেও পেঁয়াজের দাম বাড়তি। আমার কিন্তু তা মনে হয় না। এজন্য মজুতদাররাও দায়ী। সব দেশেই সব কালে সুযোগসন্ধানীরা বসে থাকেন না। ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশি পেঁয়াজের মজুতদাররা সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ এটা দণ্ডনীয় অপরাধ। এমন দণ্ডনীয় কাজ করে কেউ যেন অতিরিক্ত মুনাফা করতে না পারে, সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

পাঠক, চলুন সব শেষে একটি কল্পগল্প শুনি। এক লোক কাঁচা বাজারে গেছেন। পেঁয়াজ কেনার আগে দোকানির কাছে তিনি জানতে চাইলেন-
: ইন্ডিয়া না বাংলাদেশ?
: ইন্ডিয়া।
: দেশি নাই?
: আছে, এক দাম আশি।
: আচ্ছা, আসি।
: ভাই নিবেন না? দেশি জিনিসের বেশি ঝাঁঝ। দাম তো একটু বেশি অইবোই।
: তাই বলে আশি টাকা কেজি! এই দেশে একসময় এক টাকায় এক মণ চাল পাওয়া যেত!
: এখন এক ট্যাকায় আপনে একটা পেঁয়াজও পাইবেন না।
: পেঁয়াজ না খেলে কী হয়? আমাদের প্রতিবেশী নারায়ণ চক্রবর্তীর চৌদ্দগুষ্টি কখনো পেঁয়াজ খায়নি। তারা দিব্যি আছে। শুনেছি তার ছেলেমেয়ে দুটো নাকি শুধু সবজি খায়।
: ভালো তো, চশমা লাগবে না।
: কেন?
: গরু-ছাগলরে কোনোদিন চশমা পরতে দ্যাকছেন? ওরাও সবজিখোড়।
: তাহলে এখন থেকে ওই সবজিই খাব।
: ভাই রে, সেইখানেও ঝামেলা, সবজি তো রান্না কইরা খাইবেন। কিন্তু গ্যাসের দাম যে বাড়ছে সে খেয়াল আছে!

লোকটির আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করে না। সে বাজার থেকে সোজা বাড়ির পথ ধরে। আর তখনই তার বাড়িওয়ালার কথা মনে পড়ে। মাসের শেষ, ভাড়াটা দিতে হবে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ আগস্ট ২০১৫/তাপস রায়/কমল কর্মকার

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়