ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চট্টগ্রামে একটি ইয়াবা সাম্রাজ্যের পতন

রেজাউল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪১, ১৭ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চট্টগ্রামে একটি ইয়াবা সাম্রাজ্যের পতন

২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আলোর বাড়িতে র‌্যাবের অভিযানের দৃশ্য (ছবি : রেজাউল)

রেজাউল করিম, চট্টগ্রাম : বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ইয়াবা সাম্রাজ্যে একক অধিপতি ছিলেন চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার ইয়াবাসম্রাট খ্যাত দুর্ধর্ষ মাদক ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম প্রকাশ আলো (৩৬)।
অভিনব কায়দায় গাড়ির টায়ার, টিউব, মোটর পার্টস আর গাড়ির ইঞ্জিনের ভেতরে করে ইয়াবা পাচার ও দেশব্যাপী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পাইকারি ব্যবসার বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন এই আলো।

 

২০১৪ সালের ২৪ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই দিন হালিশহরের আনন্দিপুর এলাকায় আলোর বাসা ঘিরে রেখে অভিযান পরিচালনা করে র‌্যাব। এই অভিযানে ২ লাখ ২১ হাজার ৫৩১টি ইয়াবা উদ্ধার করা হয় আলোর বাড়ি থেকে। এ ছাড়া উদ্ধার করা হয় ইয়াবা বিক্রির ১৮ লাখ ৯৯ হাজার ৫৫ টাকা, একটি বিদেশি পিস্তল, তিনটি ম্যাগজিন, বেশ কিছু পিস্তলের গুলি, একটি মোটরসাইকেল, একটি টয়োটা প্রিমিও গাড়ি, ইয়াবা পাচারে ব্যবহার করার জন্য মোটরগাড়ির ৩৭টি ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ, তিনটি মোবাইল ফোন, আটটি ল্যাপটপ, ব্যাংকের তিনটি চেকবই এবং ক্রেডিট কার্ড।

 

এই চাঞ্চল্যকর অভিযানে আলোসহ তার আরো পাঁচ সহযোগী গ্রেফতার হলেও বছর না ঘুরতেই হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে জেল থেকে বের হয়ে আসেন আলো। সর্বশেষ গতকাল রোববার গভীর রাত সাড়ে ৩টার দিকে ওই হালিশহর এলাকাতেই র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন কুখ্যাত এই ইয়াবাসম্রাট।

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৪ সালের র‌্যাবের অভিযানের পূর্বে জাহিদুল ইসলাম আলো সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্যই ছিল না চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। ঢাকায় একটি বাড়ি থেকে ইয়াবা উদ্ধারের সূত্র ধরে ঢাকা র‌্যাবের একটি দল প্রথমে হালিশহরে ইয়াবা ব্যবসায়ী আলোকে শনাক্ত করে। এরপর যা ঘটে তা রীতিমতো বিস্ময়কর।

 

এই অভিযানের পর র‌্যাব জানতে পারে সারা দেশে ইয়াবা ব্যবসার সবচেয়ে বড় সিন্ডিকেটটি পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম থেকেই। মিয়ানমার ছাড়াও চীন থেকে গাড়ির ইঞ্জিন, টায়ার টিউব ও বিভিন্ন মোটরপার্টসের ভেতরে করে চোরাচালান করে আনা হয় লাখ লাখ পিস ইয়াবা। এরপর কোটি কোটি টাকা লেনদেনে এসব ইয়াবা চালান হয় সারা দেশে। ওই অভিযানে র‌্যাবের হাতে পাঁচ সহযোগীসহ গ্রেফতারের পর র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে ইয়াবা ব্যবসা করেই তিনি হালিশহরে গড়ে তুলেছে সুবিশাল দালান বাড়ি। বিভিন্ন ব্যাংকে তার জমা টাকার পরিমাণ ২ কোটি ৫৮ লাখ। গ্রেফতারের সময় তার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় ১৯ লাখ টাকা।

 

 

কে এই ইয়াবাসম্রাট আলো : চট্টগ্রাম র‌্যাব-৭ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) সোহেল মাহমুদ রাইজিংবিডিকে জানান, জাহিদুল ইসলাম প্রকাশ আলো দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

 

আলো তার বোন জামাই মো. সগিরের (৩৬) মাধ্যমে প্রথম ইয়াবা ব্যবসায় সম্পৃক্ত হন। ২০১২ সালে সগির ইয়াবা ব্যবসা বাবদ আলোর কাছ থেকে প্রায় ৩ লাখ টাকা ধার নেন। ধারের টাকা দিয়ে সগির ইয়াবা ব্যবসা করে প্রচুর লাভবান হন।

 

আলো বিষয়টি জেনে অল্প সময়ে বিত্তবান হওয়ার উদ্দেশ্যে সগিরের সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ২০১২ সালের আগস্ট মাসে সগির ইয়াবা এবং অস্ত্রসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। তার দেওয়া তথ্যমতে ২০১২ সালে প্রথম দফায় জাহিদুল ইসলাম আলো বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ গ্রেফতার হন র‌্যাবের হাতে।

 

জেলহাজতে থাকাকালীন আলো এবং সগির জেলে থাকা অন্য ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে যোগসাজশে একটি ইয়াবা সিন্ডিকেটের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। আলো ও ছগির প্রায় চার মাস চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকার পর জামিনে বের হয়ে আসেন। তারপর তারা আবার নবোদ্যমে শুরু করেন ইয়াবার বাণিজ্য।

 

মিয়ানমার ও চীন থেকে ট্রলারযোগে অভিনব পন্থায় মোটর পার্টসের বিভিন্ন কম্পার্টমেন্টের মধ্যে ঢুকিয়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, ফিরিঙ্গী বাজারসহ কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকা দিয়ে চট্টগ্রামে তার নিজস্ব ও ভাড়াকৃত বাসায় নিয়ে আসেন। এরপর সেখান থেকে সুবিধামতো সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করত আলোর সিন্ডিকেট।

 

আলোর আস্তানা : চট্টগ্রামের হালিশহর থানাধীন আনন্দিপুর নামক এলাকার তাসফিয়া কমিউনিটি সেন্টারসংলগ্ন এলাকায় একটি সুবিশাল বাড়ি তৈরি করেন ইয়াবা ব্যবসায়ী আলো। আর এই বাড়িটিই ছিল তার প্রধান আস্তানা। ২০১৪ সালে কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের পর এই বাড়ি থেকেই আলোকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

 

র‌্যাবের দেওয়া তথ্যমতে, আলো সপরিবারে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হালিশহরের আনন্দিপুরে আলো একজন মোবাইল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একসময় তিনি মোবাইল চোর সিন্ডিকেটের নেতা হিসেবে পরিচিত হন। পরবর্তী সময়ে নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজারে দুটি দোকান ও পজেশনে কেনেন। ২০০৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে চোরাই মোবাইল ক্রয়-বিক্রয়ের অপরাধে এমনকি মোবাইল চোর সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে পুলিশের হাতে একাধিকবার গ্রেফতারও হন আলো।

 

সর্বশেষ রোববার রাত সাড়ে ৩টার দিকে ওই হালিশহর এলাকাতেই র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় কুখ্যাত এই ইয়াবাসম্রাট। এর মাধ্যমে পতন ঘটেছে চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ একটি ইয়াবা সাম্রাজ্যের।

 

 

 

রাইজিংবিডি/চট্টগ্রাম/১৭ আগস্ট ২০১৫/রেজাউল/সনি/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়