ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

চপস্টিক সমাচার

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩১, ১৩ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চপস্টিক সমাচার

চপস্টিক

চকবাজার টু চায়না :: তৃতীয় কিস্তি

শান্তা মারিয়া : চীনে যাওয়ার একদিন পরই যেতে হলো চীন আন্তর্জাতিক বেতারের ক্যান্টিনে। প্রথম দিনই আমি বেতারের বিদেশি কর্মীদের জন্য নির্ধারিত বাসস্থানে উঠেছি। মিডিয়া সেন্টার নামের এই বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট হাউজে রান্নাবান্নার ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু রান্নাবান্নার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী তখনও কিনে উঠতে পারিনি। তাই বেতারের ক্যান্টিনই ভরসা। বেতারের বিশাল ক্যান্টিন। এক তলাতেই একসঙ্গে শতাধিক মানুষের খাওয়ার আয়োজন। আর দোতলা তিনতলা মিলিয়ে তো আরও বিশাল তার ধারণ ক্ষমতা। তিনতলায় মুসলিমদের খাওয়ার জন্য পৃথক মেনু।

যাই হোক, প্রথমদিন একতলাতেই খেতে বসলাম চীনা কর্মীদের সঙ্গে। সেলফ সার্ভিস ব্যবস্থা। কাউন্টার থেকে ট্রেতে করে খাবার নিয়ে আসতে হয়। বিভিন্ন কাউন্টারে বিভিন্ন রকম খাবার। মাত্র দুই ইউয়ানে মানে ২৬ টাকায় একবেলা পেট ভরে খাওয়া যায়। বাটিতে করে ভাত দেওয়া হচ্ছে। তার সঙ্গে বিভিন্ন কাউন্টারে বিভিন্ন তরকারি দেওয়া হচ্ছে। সবজি সেদ্ধ রয়েছে। মাংসও রয়েছে। তবে মাংস না নেওয়াই নিরাপদ বোধ করলাম। কারণ আগেই শুনেছিলাম চীনে শূকরের মাংস খুব জনপ্রিয়। পাছে ভুল করে শূকরের মাংস খেয়ে ফেলি এই ভয়ে আমি এক বাটি ভাত আর কিছু সবজি সেদ্ধ নিয়ে ট্রে হাতে করে এক টেবিলে বসলাম।

খাবার তো নিলাম কিন্তু সমস্যা হলো খাবার জন্য কাঁটা চামচ, ছুরি ইত্যাদির কোনো চিহ্ন নেই। রয়েছে চপস্টিক আর সুপ খাওয়ার জন্য সুপের চামচ যা দিয়ে নুডুলস বা ভাত জাতীয় কিছু খাওয়া প্রায় অসম্ভব।  কি মুশকিল! চপস্টিক দিয়ে চীনাদের খেতে দেখেছি হংকংয়ের কুংফু মুভিতে। আমার বারাবার মনে হতো দুই কাঠি দিয়ে মানুষ খায় কীভাবে? এখন আমাকে কি না পড়তে হলো এই কাঠির পাল্লায়?

দুই কাঠি দুই হাতে নয়। একহাতের চার আঙুল ব্যবহার করে খেতে হবে এই কাঠি দিয়ে। চীনা সহকর্মী মুন ফেং শিং কিছুক্ষণ চপস্টিকের তালিম দিলেন। আমিও আল্লাহ ভরসা বলে শুরু করলাম। খেতে তো হবে। যতটা কঠিন বলে মনে হয়েছিল শুরুতে, কার্যত দেখলাম ততটা কঠিন নয়। চার-পাঁচদিনের মধ্যে মোটামুটি রপ্ত হয়ে গেল। পরে দেখলাম নুডুলস এবং অন্যান্য চীনা খাদ্য চপস্টিকে খাওয়াই সুবিধাজনক। আসলে যে দেশের খাদ্য, তা খাওয়ার পদ্ধতিও সে দেশেরটা অনুসরণ করাই ভালো। বিফস্টেক খেতে যেমন ছুরি কাঁটা চামচ, মাছের কাঁটা বাছতে যেমন আমাদের হাত তেমনি চীনাদের খাদ্য খেতে চীনা চপস্টিকই সুবিধাজনক।

চপস্টিককে চীনা ভাষায় বলে ‘খোওয়াইজা’। তার মানে দ্রুত খাওয়ার যন্ত্র। হরেক রকম চপস্টিক রয়েছে। চীনের সম্রাটরা নাকি খেতেন সোনার তৈরি চপস্টিকে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম কথাটা আমাদের দেশের মতো ওদেরও রয়েছে। তা সম্রাটরা সোনার চপস্টিকে খেতেই পারেন। তারা জেড পাথরের চপস্টিকও ব্যবহার করতেন। অভিজাতরা ব্যবহার করতেন রূপা ও হাতির দাঁতের তৈরি চপস্টিক। দামী কাঠের তৈরি চপস্টিকের ব্যবহারও ছিল। এখনও ধনী চীনারা এসব চপস্টিক ব্যবহার করেন। অনেক পরিবারে শোকেসে দামী চপস্টিক এবং বংশ পরম্পরায় ব্যবহৃত চপস্টিক সাজিয়ে রাখা হয়। চপস্টিক ব্যবহারের আবার হরেক রকম আদব কায়দা রয়েছে।


এসব আদব কায়দার কথা একদিন বেতারের অনুষ্ঠানে শোনালেন ইয়াও ওয়েমিং যিনি স্বর্ণা নামে বাঙালিদের কাছে পরিচিত। এই স্বর্ণা এক অসাধারণ নারী। চীনাদের মধ্যে তার সঙ্গেই আমার সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব হয়েছিল। তার কথা আরেক দিন শোনাব। তার কাছে শুনলাম চপস্টিক ব্যবহারের নিয়ম কানুন। যেমন পেয়ালা বা প্লেটে চপস্টিক দিয়ে শব্দ করা উচিত না। এ রকম নাকি ভিক্ষুকরা করে, দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। এ কথা শোনার পর একটু চমকে উঠলাম। মনে করতে চেষ্টা করলাম ক্যান্টিনে খেতে বসে আমি কখনও এ রকম করেছি কি না।

এখানে ভাত খাওয়া হয় পেয়ালায় করে। কিছুটা আঠালো ভাত। তো সেই ভাতের পেয়ালায় চপস্টিক গেঁথে রাখাও চলবে না। এটা মনে করিয়ে দেয় কবরে বা মৃতের স্মরণে ধূপকাঠি পুতে রাখার কথা বা কবর খোঁড়ার কথা। আবার চপস্টিক দিয়ে খাবার খোঁজাখুজিও খারাপ। এটাও কবর খোঁড়ার ইঙ্গিত দেয়।

চপস্টিক দিয়ে ভাত খাওয়ার নিয়ম হলো পেয়ালাটা মুখের কাছে নিয়ে চপস্টিক দিয়ে বেলচার মতো ভাত মুখের ভিতর ঢুকানো। খাবার টেবিলে কারো দিকে চপস্টিক তাক করে রাখাও খারাপ বা কথা বলতে বলতে হাতের চপস্টিক কারো দিকে উচিয়ে ধরা খারাপ। পেয়ালা, ডিশ বা প্লেটের ওপর চপস্টিক রেখে দেওয়া মানে আমার খাওয়া শেষ। এমন করে রাখলে হোটেলে ওয়েটাররা খাবার সরিয়ে নিয়ে যাবে। খাবার মাঝখানে বিরতি নিলে চপস্টিক রাখতে হবে পাশে। তাতে বোঝা যাবে আমি আরও খাব। সাধারণত বড় চপস্টিক রাখা হয় ডিশের সঙ্গে। এটা সারভিং চপস্টিক। আর যার যার প্লেটের পাশে যেটা রাখা হয় সেটা খাওয়ার জন্য।

চীনা হোটেলে খাবারের পদ্ধতি হলো ডিশে একের পর এক খাবার আসতে থাকে। টেবিলের মাঝের অংশটা ঘুরন্ত। সেখানে খাবারের ডিশগুলো রাখা হয়। চপস্টিক দিয়ে নিজের প্লেটে পছন্দসই খাবার তুলে নিতে হয়। নিজের কাছে বেশিক্ষণ ডিশ আটকে রাখা অভদ্রতা। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য এবং শিশুদের প্লেটে খাবার তুলে দেওয়া শ্রদ্ধা ও স্নেহের প্রকাশ। কিন্তু বাইরের লোকের প্লেটে খাবার না তুলে দেওয়াই ভালো।

রান্নার জন্য অনেক রকম চপস্টিক ব্যবহার করা হয়। চীনারা নাকি প্রাচীন কালে চপস্টিক রান্নার জন্যই ব্যবহার করতো বা আগুনে কাঠ উস্কে দেওয়ার কাজে এর ব্যবহার ছিল। শাং রাজবংশের সময়কার (১৭৬৬-১১২২ খ্রীস্টপূর্ব) ব্রোঞ্জের তৈরি অনেক চপস্টিক পাওয়া গেছে। পরবর্তীতে চপস্টিক দিয়ে খাওয়া শুরু হয়। চীনের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে সম্রাটদের ব্যবহৃত নকশাকাটা বিভিন্ন রকম চপস্টিক দেখে তার শিল্পনৈপুণ্যে অবাক হতে হয়।

চীনের সাধারণ রাস্তার ধারের রেস্টুরেন্টগুলোতে বাঁশের তৈরি চপস্টিক দেওয়া হয়। এগুলো ডিসপোজেবল; একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়ার জন্য। আর দামী হোটেলে দেওয়া হয় কাঠের তৈরি চপস্টিক। চীন বেতারের ক্যান্টিনে প্লাস্টিকের চপস্টিক ব্যবহার করা হতো। আমার বাড়িতে ছিল স্টেইনলেস স্টিল আর কাঠের চপস্টিক।

বেইজিংয়ের টুরিস্ট এলাকা ওয়াংফুচিংয়ে দেখেছি চপস্টিকের বিশাল দোকান। সিল্ক স্ট্রিট আর ইয়াশু মার্কেটের মতো বিশেষভাবে টুরিস্টদের গলা কাটার জন্য বিখ্যাত মার্কেটে রয়েছে নানা রকম চপস্টিকের সেট। এগুলো সুভ্যেনির হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর বাঁশের তৈরি চপস্টিক পাওয়া যায় সাধারণ সব দোকানে এমনকি পথের পাশে। বড় হোটেল রেস্টুরেন্টে খাওয়ার জন্য কাঁটা চামচ ছুরি পেলেও সাধারণ রেস্টুরেন্টে কাঁটা চামচ না চাইলে পাওয়া যাবে না। চাইলেও সেটা বোঝাতে চীনা ভাষায় কসরত করতে হবে অনেকক্ষণ ধরে।

চপস্টিক দিয়ে চীনের বিখ্যাত সব খাবার যেমন রোস্টডাক বা বেইজিং ডাক, হটপট ইত্যাদি খাওয়া যায় সহজে। এসবও খেয়েছি বৈকি। মজাদার সব চীনা খাবারের গল্প আরেকদিনের জন্য তোলা রইল।



 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ অক্টোবর ২০১৫/তাপস রায়/আমিনুল ই শান্ত


রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়