ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র সাহিত্যের নিভৃতজন

অলাত এহসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৬ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র সাহিত্যের নিভৃতজন

বাবলু ভট্টাচার্য এবং তার লেখা বইসমূহ

অলাত এহ্সান

সম্প্রতি জার্মানির শহরের নাগরিক জীবন অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছিল। এর বিরুদ্ধে রীতিমত একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলন দৃশ্যত রাজপথের কিছু ছিল না। স্লোগান মুখোর সমাবেশও ঘটেনি কোথাও। যে যার জায়গা থেকেই প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেছে। আর সেই প্রতিবাদের ভাষা ও মাধ্যম হচ্ছে—হাসি। হাসি-হাসি মুখে সেলফি তোলো, আর ফেসবুকে আপলোড ও # (হ্যাস)ট্যাগ করে দেয়া। ব্যাস, এতেই যথেষ্ট। অনেকটা গীঁ দ্য মোঁপাসার গল্পের মতো—আপাত সাধারণ একটা ঘটনার, অথচ এর ভেতরে লুকিয়ে আছে অমিতবোধ। আমাদের দেশে যেখানে রাজপথে আন্দোলনে করে, প্রশাসনকে চাপ দিয়েও টলানো যায় না, সেখানে ব্যাপারটা অনেকটা বেঢপ লাগে। অথচ এটা ছিল জার্মানির খুবই শক্তিশালী ও সফল একটি আন্দোলন।

আমাদের খণ্ডিত নিবাস সংস্কৃতিতে, সকাল-সকাল কিংবা দিনে অন্তত একবার যারা ফেসবুক বন্ধুপাড়ায় ঢুঁ মারতে অভ্যস্ত, তাদের কেউ হয়তো একটি দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত। বাবলু ভট্টাচার্যের ফেসবুক বন্ধুদের এটি প্রত্যাহিক ঘটনা। একটি চমৎকার নৈসর্গিক ছবি ও তার উপর লেখা Good Morning. প্রথম প্রথম হয়তো কিছুই মনে হবে না এটা। কিন্তু প্রতিদিনই যখন দেখবেন, তখন বিষয়টা নানানভাবে মনে রেখাপাত করবে। হয়তো পুনঃপুনিক এই দৃশ্য দেখতে দেখতে তিনি ক্লান্ত হয়ে যাবেন। এক সময় হয়তো সামান্য, খেলো ধন্যবাদ কিংবা নেহায়েত লাইক দেওয়ার সৌজন্যতাটুকুও হারিয়ে ফেলবেন। কিন্তু লোকটার ‘শুভ সকাল’ জানানোয় কোনো ক্লান্তি নেই। তিনি Good Morning জানিয়েই যাচ্ছেন। সৃষ্টিমগ্ন মানুষের মতো।

আরো একটি জিনিস পাওয়া যাবে তার ফেসবুকে। কারো-না-কারো জন্মদিনের শুভেচ্ছা, কিংবা শ্রদ্ধাঞ্জলি। দৈনিক পত্রিকা কিংবা হালে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর মতো দায়সারা গোছের স্মরণ নয় সেটা। তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ একটা লেখাও থাকে। অনেকটা এনসাইক্লোপিডিয়ার মতো। এই স্মরণীয় মানুষগুলো জগৎ বিখ্যাত তো বটেই, বিচিত্রও। বিশেষত চলচ্চিত্র ও শিল্পমাধ্যমের লোকেরা এতে অগ্রগণ্য। লেখার ভেতর চোখ ডুবালে দেখা যাবে, লেখাগুলোর বিশেষত্ব আছে। বলার ভঙ্গিও আলাদা। আন্তরিক ও বিন্যাস্ত। Good Morning-এর মতো বা একইভাবে, নূন্যতম মন্তব্য করে হয়তো তার বন্ধুত্বের মূল্য দেন। শেষ পর্যন্ত তা লাইক থেকে পিছলেও পরেন কেউ কেউ। কোনো প্রকার খ্যাতির আশা না করে এভাবে সৃষ্টিমগ্ন আমাদের সময়ে কয়জনই বা আছে? প্রতিবছর এই স্ট্যাটাস নিয়ে একটি সমৃদ্ধ সংকলন হতে পারে।

বাবলু ভট্টাচার্য জ্ঞানের একটা দায় বহন করেন—নিজে যা জানো অন্যকে তা জানাও। সাহিত্যিক-সংগঠক রণেশ দাশগুপ্ত’র একটা কথা আছে—বিপ্লব হবে কি হবে না কিংবা কবে হবে, তা সময়ই বলে দিবে; কিন্তু এই ভেবে আমি আমার ব্রত ভাঙবো কেন? বাবলু ভট্টাচার্য সেই ব্রতচারী মানুষ। যথেষ্ট নিভৃতচারীও বটে। সেই নিভৃতে উছলে পড়া সৃষ্টির সংখ্যা কম নয়। তিনি চলচ্চিত্র, চিত্রকলা, নাটক ও ইতিহাস সংশ্লিষ্ট বিষয়ে লিখেন। বইয়ের সংখ্যা ১৮।বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গণে চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র সাহিত্য দুই-ই সমান দক্ষতায় গ্রহণ করেন যারা বাবলু ভট্টাচার্য তাদের একজন। তিনি একজন ফিল্মমেকার ও লেখক। তার প্রতিটি লেখায় গভীর অনুসন্ধিৎসা নিহিত। তার দেখার দৃষ্টি উন্নত ও সমৃদ্ধ।

চলচ্চিত্র নিয়ে এদেশে লেখকের অভাব হবে না। হালকা চালের সেগুলো অনাবশ্যক ফ্যান্টাসি ও বহুল্য দোষে দু্ষ্ট। বাবলু ভাট্টাচার্যের ক্ষেত্রে তা নয়। কী প্রসাদগুণ, কী মননশীলতা—তার লেখাগুলো সত্যি বিশিষ্ট্য। তিনি চলচ্চিত্র জগতের ফ্যান্টাসি ভেঙে, রাজনীতি-ইতিহাস ও মননের আলোকে উপর-নীচ করে দেখেন। দেখান। চলচ্চিত্রের বিষয়ে তার ‘হলিউডের রাজনীতি ও চার্লি চ্যাপলিন’, ‘উৎপল দত্ত : রাজনীতি ও থিয়েটার’, ‘প্রসঙ্গ : সিনেমা’, বাংলা চলচ্চিত্র সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে তার দীর্ঘ কাজ ‘সত্যজিৎ রায়’ অত্যন্ত উঁচুমানের একটি গবেষণা। এদেশের চলচ্চিত্রের চর্চায় তার ‘চলচ্চিত্রের ইতিহাস ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ বইটি অগ্রগণ্য। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ও বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে আগ্রহ সব সময় গভীর।

তার সব লেখায়ই রাজনীতি ও ইতিহাসের ঘনিষ্ট সন্নিবেশ দেখা যায়। ‘ভিয়েতনাম বিপ্লব’, ‘আঙ্কেল হো’, ‘সব গল্পের নায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন’, ‘লালমিয়া’, ‘আমেরিকান সাম্রাজ্যের গোপন কাহিনী’, ‘রাজকুমারী ডায়না’, ‘ডেবিড ওয়ার্ক গ্রিফিথ’, ‘পাবলো পিকাসো’, ‘গৌতম বুদ্ধ’ তারই পরিচয় বহন করে। নিপাট সাহিত্য বলতে যা বোঝা সেখানেও তার বিচরণ। কখনো কখনো গল্পও লিখেছেন তিনি। তার সম্পাদিত ‘আফ্রিকার কবিতা’, ‘লাতিন আমেরিকার কবিতা’, ‘স্পেনের কবিতা’ গ্রন্থের অনুবাদের দক্ষতাও প্রকাশ পেয়েছে। তার সব বইয়ের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যত্ন ও নিষ্ঠার গভীরতা বোঝা যায়।

চলচ্চিত্র বিষয়ে অত্যন্ত নিম্নমানের, অনেকটা ঝুলে পড়া রিপোর্টিং গোছের বই নিয়ে যখন মাতামাতি দেখি তখন লজ্জা হয়—এই পোড়ার দেশ বলেই বাবলু ভট্টাচার্যের বইগুলো আমাদের সামনে আসে না। কিংবা ‘নেহায়েত বই বিক্রেতা’ কিসিমের প্রকাশকগুলো তার বইয়ের যথাযথ উপস্থাপন করেন না। বাবলু ভট্টাচার্য আপাদ মস্তক চলচ্চিত্রের লোক। চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন কলকাতা থেকে। পরবর্তীতে এ বিষয়ে ইউরোপেও পড়ালেখা করেন। প্রয়াত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের সহকারী হিসেবে তার চলচ্চিত্রে আগমন। তার চলচ্চিত্র কর্মের মধ্যে আছে, যমুনার বালিরচরের মানুষদের জীবন নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘চরাচর’, চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান ও সংগীতশিল্পী কলিম শরাফী’র জীবনচিত্র। টেলিভিশনের জন্যে নাটক রচনা এবং পরিচালনা করেছেন অনেক। এখন তিনি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরিতে ব্যস্ত।

ব্যস্ততম দিনেরও সিংহভাগ তার পঠন-পাঠনের মধ্যেই কাটে। আজকের দিনে যশোর জেলার মুনরামপুরের পাড়ালা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক ঐশ্বর্য ও লেখালেখির মতো ব্যক্তিগতভাবেও তিনি আন্তরিক এবং নিত্যপ্রবণ মানুষ। ছেলেবেলার গভীর অন্বেষা থেকে তিনি পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরে বেরিয়েছে। তত্ত্ব জ্ঞান, বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গি আর চলচ্চিত্রনিষ্ট এই মানুষের কাছে সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র সাহিত্যের জন্য অপেক্ষা করা যায়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ এপ্রিল ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়