ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণ ও কিছু প্রশ্ন

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৩০ মে ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণ ও কিছু প্রশ্ন

শাহ মতিন টিপু : রাজধানীতে মাইক্রোবাসে গারো তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় আশরাফ ওরফে তুষার ও জাহিদুল ইসলাম লাভলু নামের দুই যুবক গ্রেফতার হয়েছে। আবার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে বাসে পোশাক কারখানার শ্রমিক গণধর্ষণের ঘটনায় পলাতক বাসচালক চান্দু মিয়াকে সাভার থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

 

গত ১১ মে রাতে রূপগঞ্জে অবস্থিত রপ্তানিমুখী ‘ফকির ফ্যাশন’ পোশাক কারখানায় কাজ শেষে কারখানার ভাড়া করা যাত্রীবাহী বাসে বাড়ি ফেরার পথে বাসের চালকসহ চারজন এক নারী শ্রমিককে ধর্ষণ করে। এসব গ্রেফতারকে আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে আগ্রহী।

 

গারো তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় ভাটারা থানায় করা মামলার এজাহারে বলা হয়, চলন্ত মাইক্রোবাসে পাঁচজন মিলে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে তাকে ধর্ষণের পর রাস্তায় নামিয়ে দেয়। কিন্তু গ্রেফতারকৃত দুজন মাইক্রোবাসে আর কারো থাকার কথা স্বীকার করেননি বলে জানিয়েছে র‌্যাব। ধর্ষণকারী আসলে কয়জন ছিল, তা নিশ্চিত হওয়া গেছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব জানিয়েছে, ‘এটা এখনই বলা সম্ভব নয়। পরীক্ষা করে দেখতে হবে।’ আমরা মনে করি বিষয়টি খোলাসা হওয়া দরকার।

 

অন্যদিকে গারো তরুণীকে ধর্ষণের ওই ঘটনায় রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা নিতে অবহেলার অভিযোগ। এ নিয়ে পাঁচ মানবাধিকার সংগঠনের রিট আবেদনে হাইকোর্ট তিনটি রুল জারি করেন। মামলা নিতে বিলম্ব কেন ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করা হবে না, অবহেলার জন্য দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এবং ধর্ষিতাকে কেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।

 

গারো তরুণীর পরিবারের ভাষ্য, রাতে ধর্ষণের ঘটনার পর মামলা করার জন্য তাদের তিন থানায় ঘুরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়ে। তুরাগ থানা কাছে হয় বলে মামলা করার জন্য রাত ৪টার দিকে মেয়েটিকে নিয়ে তারা সেখানে যান। কিন্তু অন্য এলাকার ঘটনা বলে পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দেয়। এরপর ভোর ৫টার দিকে তারা যান গুলশান থানায়। সেখানেও একই উত্তর মেলে। শেষে সাড়ে ৬টার দিকে ভাটারা থানায় গেলে বলা হয়, ওসি নেই, অপেক্ষা করতে হবে।

 

এরপর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওসি আসেন এবং তাদের কথা শুনে সাড়ে ১২টার দিকে মামলা নথিভুক্ত করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর মামলা গ্রহণে এমন নিস্পৃহতা কেন? এমন জটিলতার শিকার হয় বলে অনেক ঘটনা মামলার বাইরে থেকে যায়। এতে অপরাধীরাই প্রশ্রয় পায়। পুলিশকে নির্যাতিতদের বন্ধু ভাবতে বলা হলেও এ ক্ষেত্রে পুলিশ অপরাধীদের বন্ধুতে পরিণত হয়, যা মোটেই কাম্য নয়।

 

গাড়িতে তুলে নিয়ে গণধর্ষণের মতো অপরাধটি ইদানীং রাজধানী ও তার আশপাশে যে হারে ঘটে চলেছে, তা খুবই উদ্বেগের। দিল্লিতে বাসে একটি গণধর্ষণের ঘটনায় সারা ভারতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। অবশেষে ধর্ষকদের শাস্তি হয়েছে। বাংলাদেশেও সে হাওয়া লেগেছে, দ্রুত এই নষ্ট হাওয়ার প্রতিরোধ গড়তে হবে।

 

২০১৩ সালের ২৫ জানুয়ারি মানিকগঞ্জে চলন্ত বাসে দিনদুপুরে পোশাকশ্রমিক এক তরুণী ধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষক ছিল ওই বাসেরই চালক দীপু মিয়া ও হেলপার কাসেম মিয়া। দুজনকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়।

 

২০১৪ সালে ১ জুলাই রাতে এক নারী পোশাকশ্রমিককে তুলে নিয়ে মিরপুরে একটি মাইক্রোবাসে আটক রেখে ধর্ষণ করা হয়। পরদিন ওই নারীকে রাস্তায় ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। ২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সাভারের বলিয়ারপুর এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলন্ত বাসে দুই তরুণীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয় বাসের চালক ও হেলপার। ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে শুভযাত্রা পরিবহনে চলন্তবাসে এক গার্মেন্টস কর্মী ধর্ষিত হয়। এই মামলায় বাসটির বাসচালক দিপু মিয়া ও হেলপার আবুল কাসেমের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হয়।

 

আবার ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর সাভারে চলন্ত বাসে এক গার্মেন্টস কর্মীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হয়। এ সময় তার আর্তচিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে সে রক্ষা পায়। এ ঘটনায় বাসের চালক ও তার সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ২০১৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি স্বামীকে আটকে শ্লীলতাহানির চেষ্টাকালে চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে প্রাণ দিয়েছেন গৃহবধূ চাঁদনী খাতুন (১৯)। 

 

এতে এটাই স্পষ্ট যে, চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণের ঘটনার বিস্তারটা একটু ভয়াবহ রকমেরই হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে যৌন অপরাধীদের জন্য এটা একটা ট্র্যাডিশনে পরিণত হয়েছে। মানিকগঞ্জে চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণের ঘটনায় একজনের শাস্তি হয়েছে। কিন্তু থেমে নেই ধর্ষণের ঘটনা, ঘটেই চলেছে। এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি বিশেষ জরুরি।

 

ধর্ষকদের শাস্তি যাতে দ্রুত হয় সে ব্যাপারে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণত দরিদ্র ও সামাজিক অবস্থান থেকে দুর্বল ঘরের মেয়েরাই ধর্ষণের শিকার হয় বেশি। বেঁচে থাকাটাই যেখানে বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে দীর্ঘ মেয়াদে মামলা চালানোর মতো অর্থ ও সময় তারা দিতে পারে না। তাদের মামলা চালানোর জন্য এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ মে ২০১৫/শাহ মতিন টিপু/সন্তোষ/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়