ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চলেই গেল একটি বছর

টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ৩০ নভেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চলেই গেল একটি বছর

শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী

শাহ মতিন টিপু : দেখতে দেখতে একটি বছর পার হয়ে গেল। চলেই গেল একটি বছর। এই চলে যাওয়া বছরটি শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে হারানোর। তার জীবন্ত অঙ্কনরেখা গত এক বছর আমরা মিস করেছি। যত দিন যাবে তাকে মিস করেই যেতে হবে শুধু। আর তার বাসী হয়ে যাওয়া অঙ্কনচিত্রে আমরা খুঁজে বেড়াব তাকে।

 

শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী চলে গেলেন এইতো সেদিন। মনে হয় গেছেন, মনে হয় যাননি। এখনও আমাদের মাঝে হাঁটছেন ঘুরছেন চলছেন ফিরছেন। অথচ গত বছরের এই দিনে (৩০ নভেম্বর) যখন তিনি চলে গেলেন, মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন তিনি। সেদিন ছিল রোববার। রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে উচ্চাঙ্গসংগীতের আসরে বক্তব্য দেওয়ার সময় কাইয়ুম চৌধুরী অসুস্থ হয়ে  পড়েন। সেখান থেকে বরেণ্য এই শিল্পীকে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যাওয়া হয়। আর নতুন কোনো তুলির টান পড়বে না তার হাতে, এটাই নিশ্চিত হয়ে যায় সেদিন। রাত নয়টার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

 

সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিরউদ্দিন জানালেন, ‘সিএমএইচে আনার পর তাঁকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হয়েছে।’ রাত পৌনে ১০ টার দিকে স্বজনেরা কাইয়ুম চৌধুরীর মরদেহ স্কয়ার হাসপাতালের হিমাগারে রাখার জন্য নিয়ে যান। তার মরদেহ স্কয়ার হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হবে। সোমবার শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর মরদেহ তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় অনুষদে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তার মরদেহ নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। শেষবারের মতো শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর মরদেহে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের ঢল নামে। সেদিনই আজিমপুরে দাফন হয় এই গুণী শিল্পীর।

 

গুণী এই শিল্পীর জন্ম ১৯৩২ সালের ৯ মার্চ ফেনীতে। ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে কাইয়ুম চৌধুরী জন্ম। যেখানে অর্থের জৌলুস ছিল না। ছিল শিক্ষা ও উদার মানসের জোরদার অবস্থান। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে কাইয়ুম চৌধুরী বাংলার অনেক এলাকায় ঘুরেছেন।

 

মক্তবে শিক্ষার হাতেখড়ি, তারপর চট্টগ্রামের নর্মাল স্কুলে। এরপর কিছুকাল কুমিল্লায় কাটিয়ে নড়াইলে। চিত্রাপাড়ের এই শহরে কাটে তার তিনতিনটি বছর। সেখান থেকে সন্দ্বীপে। এরপর নোয়াখালী। সেখান থেকে ফেনী, তারপর ফরিদপুর। ফরিদপুর থেকে ময়মনসিংহ এসে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক। স্কুলজীবন থেকে আঁকাআঁকির প্রতি ঝোঁক ছিল তার। ১৯৪৯ সালে আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা সমাপন করেন ১৯৫৪ সালে। তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনকে। সদ্য প্রতিষ্ঠিত আর্টস ইনস্টিটিউটের নবীন শিক্ষার্থীরা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ইমদাদ হোসেন, মুর্তজা বশীর, আমিনুল ইসলাম, দেবদাস চক্রবর্তী প্রমুখ ছিলেন প্রতিবাদী আয়োজনের নিরলস কর্মী এবং সব মিছিলের পুরোভাগে। অন্তর্মুখী স্বভাবের কাইয়ুম চৌধুরীরও সম্পৃক্তি ছিল সেখানে। এভাবেই বেড়ে উঠেছিলেন তিনি, হয়ে উঠেছিলেন অন্য এক কাইযুম চৌধুরী। যাকে এই দেশবাসীকে মনে রাখতে হবে অনেক অনেক দিন।

 

কাইয়ুম চৌধুরীর কর্মজীবনের শুরুটাই ছিল বাস্তবতার সঙ্গে সুনিবিড়। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত কাইয়ুম চৌধুরী নানা ধরনের ব্যবহারিক কাজ করেছেন, বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, আর বইয়ের প্রচ্ছদ ও সচিত্রকরণের কাজ করেছেন। সিগনেটের বই কাইয়ুম চৌধুরীর জন্য ছিল এক অনুপম নিদর্শন। সাময়িক পত্রিকা বিষয়ে আগ্রহী কাইয়ুম চৌধুরী, ছায়াছবি নামে একটি চলচ্চিত্র সাময়িকী যুগ্ম ভাবে সম্পাদনা করেছিলেন কিছুকাল। সুযোগমতো টুকটাক প্রচ্ছদ আঁকছিলেন এবং এই কাজের সূত্রেই পরিচয় সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে। ১৯৫৫ সালে তাঁর দুই বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন, কিন্তু প্রকাশক অপারগ হওয়ায় সে বই আর আলোর মুখ দেখেনি। প্রচ্ছদে একটি পালাবদল তিনি ঘটালেন ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত জহুরুল হকের সাত-সাঁতার গ্রন্থে। গ্রন্থের বক্তব্যের বা সারসত্যের প্রতিফলন ঘটালেন প্রচ্ছদে, একই সঙ্গে গ্রাফিক ডিজাইনে কুশলতা ও নতুন ভাবনার ছাপ মেলে ধরলেন। গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের সচিত্র সন্ধানী পত্রিকার আত্মপ্রকাশ তার অঙ্কন, টাইপোগ্রাফিবোধ ও রসসিঞ্চিত তির্যক রচনা প্রকাশের মাধ্যমে হয়ে উঠেছিল অনবদ্য। ১৯৫৭ সালে কাইয়ুম চৌধুরী আর্ট কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন।

 

১৯৫৭ সালে সতীর্থ আমিনুল ইসলাম ও সৈয়দ জাহাঙ্গীরকে নিয়ে কাইয়ুম চৌধুরী গিয়েছিলেন কলকাতায়। ব্রিটিশ কাউন্সিলের তরুণ কর্মকর্তা জিওফ্রে হেডলির আহ্বানে এই সফর। কলকাতায় দেখা করেছিলেন সত্যজিত রায় ও খালেদ চৌধুরীর সঙ্গে। ১৯৫৯ সালে বন্ধুবর গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের সন্ধানী প্রকাশনী যাত্রা শুরু করে জহির রায়হানের ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে মাওলা ব্রাদার্স সৃজনশীল প্রকাশনার অধ্যায় উন্মোচন শুরু করে আবদুশ শাকুরের ‘ক্ষীয়মাণ’ এবং সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’ প্রকাশ দ্বারা। এই দুই প্রকাশনা সংস্থার কাজের পেছনে বরাবরই কাইয়ুম চৌধুরী সক্রিয় থেকেছেন।

 

তিনি আরও প্রচ্ছদ আঁকেন ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। ১৯৫৯ এবং ১৯৬১ সালে রেলওয়ের টাইমটেবিলের প্রচ্ছদ এঁকে সেরা পুরস্কারটি লাভ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। তিনি ১৯৬০ সালে তাহেরা খানমের সঙ্গে পরিণয়-বন্ধনে আবদ্ধ হন, যিনি ছিলেন আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়া প্রথম চারজন ছাত্রীর একজন। মনের সাযুজ্য তার শৈল্পিক প্রয়াসের জন্য অনুকূল ছিল এবং স্ত্রীর ভূমিকা প্রেরণাদায়ক ছিল। ১৯৬১ সালে ডিজাইন সেন্টার ছেড়ে অবজারভার হাউসে চিফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগদান করেন। অবজারভার পত্রিকার রোববারের সাময়িকীতে ডিজাইন নিয়ে যেসব নিরীক্ষা করতেন তার শিক্ষক জয়নুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এভাবে তার কর্মই তাকে নিয়ে আসে সম্মুখসারিতে।

 

তিনি কেমন শিল্পী ছিলেন বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এর এই কটি লাইনই তাকে বোঝার জন্য যথার্থ। তিনি লেখেন-

 

‘কাইয়ুম চৌধুরী প্রথম থেকেই লোকজ ঐতিহ্যের মধ্যে কাজ করেছেন, লোকজ ঐতিহ্যের বিভিন্ন দিক ব্যবহার করে লোকজ রীতি শক্তিশালী করেছেন, তিনি ভেবেছেন হয়তো এভাবে শিল্পকে সর্বজনীন করা যায়। তিনি চোখে তুলে এনেছেন প্রকৃতি এবং নিসর্গ, তিনি গুনগুন করে বলেছেন : গোলাপ তো গোলাপ তো গোলাপই; নদী তো নদী তো নদীই। তিনি কল্পনা করেছেন প্রকৃতি এবং নিসর্গের রূপান্তর, কিন্তু লোকজ রীতি তাঁকে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শোনায়নি। তিনি ধার করেছেন লোকজ ঐতিহ্য থেকে লোকজ বিষয়, এবং লোকজ বিষয়কে তিনি শতবার শতভঙ্গিতে এঁকেছেন। এই আঁকাকে তিনি পেইন্টেড ইমেজ এবং রিয়ালিটির সম্পর্ক ভেবে লোকজ বিষয় ভেঙেছেন, লোকজ বিষয় তাঁর কাছে মনে হয়েছে অফুরন্ত। অফুরন্ত বিষয় পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে তাঁর চোখ, তাঁর কবজির জোর, আবেগের ঐকান্তিকতা।’

 

আসলে তেলরং, জলরং, কালি-কলম, মোমরং, রেশম ছাপ ইত্যাদি নানা মাধ্যমে কাইয়ুম চৌধুরী কাজ করেছেন। তার একটি প্রবণতা জ্যামিতিক আকৃতির অনুষঙ্গ। বস্তুত তার ছবি নকশাপ্রধান। বর্ণিল পটভূমিতে মোটাদাগের নকশা তার প্রধানতম অঙ্কনশৈলী। অন্যদিকে কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রাবলি বর্ণোজ্জ্বল। লাল, নীল, সবুজ এই তিনটি রং তিনি প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করতেন। এই বর্ণভঙ্গী তাঁর চিত্ররীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর ক্যানভাসের আয়তন প্রায়শ বর্গাকার। এ ছাড়া তার চিত্রাবলিতে এ দেশের লোকশিল্পসুলভ পুতুল, পাখা, হাঁড়ি, শীতলপাটি, কাঁথা ইত্যাদির পৌনঃপুনিক ব্যবহার লক্ষ করা যায়।

 

যে কোনো মহান শিল্পীর মতো তার চিত্রগুলো আলাদা করে চেনা যায়। বিশেষ ধরনের উড়ন্ত পাখি, ঘুড়ি হাতে বালক, জ্বলজ্বলে সূর্য, দিগন্ত থেকে বহমান নিঃস্তরঙ্গ নদী, গলুইয়ে বাঁধা নৌকা, জংলাফুল, ফসলের মাঠ, বিশেষ ভঙ্গিমায় নারী, মাছ ধরার দৃশ্য, হাতে এসে বসা এই পাখির সঙ্গে শিল্পীর কথোপকথন শৈল্পিক ব্যঞ্জনা দেখে সহজেই কাইয়ুম চৌধুরীকে চেনা যায়। নাগরিক কেউ এর মধ্যে গ্রাম্যতা খোঁজার প্রয়াস করতে পারেন।

 

কিন্তু তার ছবি দেখলে বোঝা যায়, শুধু ঐতিহ্য থেকে আনা উপাদান নয়, এগুলো নন্দনেও মার্গীয় ধাঁচ বহন কনে। নকশীকাঁথা, সরা, পট, পাখা, নৌকার গায়ে নকশা, পুতুল, শীতল পাটি, হাঁড়ি, বাঁশ ও বেতের কাজ ও নকশায় সেই শিল্পরূপ। সবকিছুই তিনি লোকশিল্পের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে খুঁজতে থাকেন। মাটি দিয়ে তৈরি পুতুলের গায়ে আঁকা রেখা, কাঁথায় ফুল, লতা-পাতা ও পশুপাখির আকারকে নকশার ভিতর আপ্লুত করে তার নির্যাস নিয়ে চিত্রকলায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেন তিনি।

 

ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি শিল্পচর্চায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন (১৯৬১-৬২)। এই বছর লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিল্পকলা প্রদর্শনীতে ‘বটম’ শীর্ষক ছবির জন্য প্রথম পুরস্কার পান। স্বীকৃতি অর্জনের এই ধারায় তিনি লাভ করেন শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৭), একুশে পদক (১৯৮৬)। ২০১০ সালে সুফিয়া কামাল পদকসহ বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হন। ২০১৪ সালে, মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদকে ভূষিত হয়েছেন।

 

কাইয়ুম চৌধুরীর ৭৮তম জন্মবার্ষিকীতে সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, ‘সত্যিকার অর্থে বিশ্বমানের শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী।’ মুস্তাফা মনোয়ার বলেন, ‘সত্যজিত রায়ের পর গ্রাফিক্স কিংবা প্রচ্ছদ শিল্পকে তিনি অন্যরকম অবস্থানে নিয়ে গেছেন।’

 

কাইয়ুম চৌধুরীর বীরের মতো পরিণত বয়সে চিরবিদায় নেওয়ার একটি বছর গত হয়ে গেল। আর্মি স্টেডিয়ামে ধ্রুপদী সঙ্গীতের বিশাল আয়োজনে বক্তৃতা শেষে তিনি আবার উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন; ‘আমার আরও একটা কথা বলার ছিল’। সেই কথাটি আর বলা হলোনা এবং আমাদের শোনাও হলোনা।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ নভেম্বর ২০১৫/ টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়