ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ছায়া ও ছবি

মিলন আশরাফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৩, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছায়া ও ছবি

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

|| মিলন আশরাফ ||

স্বপ্নে তাকে দেখে কতবার যে ধড়ফড় করে জেগে উঠেছি। সেই ফুলঝুরি বুবু জলজ্যান্ত আমার চোখের সামনে! মাল্টিপ্লান সেন্টারে ঢোকার মুখেই আমাকে থামিয়ে সে বলল, ‘দেখি আপনার ব্যাগ চেক করবো।’
শুনেই ইলেক্ট্রিক শকড লাগার মতো লাফিয়ে উঠলাম। তোতলাতে তোতলাতে বললাম, ‘আআ...আপনি মানে বুবু তুমি!’
‘অবাক হয়েছিস তাই না? ঠিক আছে ওপর থেকে ঘুরে আয়। তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে।’
দক্ষ হাতে কথার ফাঁকে ফাঁকে ব্যাগ চেক করল ফুলঝুরি বুবু। আমি কাচুমাচু হয়ে ঘাড়টা একটু নিচু করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।  

ফুলঝুরি। যার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় ফারুক ভাইয়ের বরাত দিয়ে। খুব ছোট আমি তখন। নতুন গোঁফ গজিয়েছে। সঙ্গে লজ্জাও। কেউ কিছু বললেই লজ্জায় মাথাটা নিচে নেমে যেতো। সবকিছুতে শিহরণ জাগার বয়স। মনে পড়ে ফারুক ভাইয়ের পাহারাদার সেজে প্রায়ই ফুলঝুরি বুবুদের বাড়ি যেতাম। একবার হলো কী, ফারুক ভাইয়ের একটা চিঠি দিতে গিয়েছিলাম বুবুকে। বুবু আমাকে দেখে খুশিতে নেচে উঠল।  ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল বুকের ভেতর। তারপর ঠিক সেভাবেই বুকের মধ্যে পিষে রেখে বলল,‘খবরদার কাউকে বলবি না।’

কুমড়ো ফুলের মতো লজ্জায় নুইয়ে পড়েছিলাম সেদিন তার আঁচলের নিচে। শরীর কেঁপে উঠেছিল থর থর করে। এক দৌড়ে বাড়িতে এসে বালিশে মুখ গুঁজে শুষে নিয়েছিলাম ফুলঝুরি বুবুর শরীরের সবটুকু গন্ধ। বালিশ ও ফুলঝুরি বুবু দুটোয় একাকার। আলাদা করার প্রয়োজনও মনে করিনি। সুঠাম দেহের ফুলঝুরি বুবুকে আজ  আরো সুগঠিত লাগছে। পোশাকটাও মানিয়েছে বেশ। কেমন দারোগা, দারোগা! মনটা আকুপাকু করছে। এখানে সে কেমন করে, কীভাবে এলো?

ব্যক্তিগত কিছু কাজ সেরে তাড়াতাড়ি লিফট বেয়ে শো করে নিচে নেমে এলাম। এসেই দেখি বুবু নেই। মুহূর্তে বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল। এদিক ওদিক হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলাম। একটার পর একটা অতীত ঘটনার মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলাম আমি। এক চুঁইয়ে পড়া জোছনা রাত্রিতে ফুলঝুরি বুবুকে আমি ডেকে এনেছিলাম সরিষা ক্ষেতে। একপেয়ে একটা তালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল ফারুক ভাই। তারা বিস্কুট ও বাতাসার লোভ দেখিয়ে আমাকে বাড়ি থেকে ডেকে আনা হয়েছিল। তারপর ফুলঝুরি বুবুকে পেয়ে আমার হাতে ওগুলো ধরিয়ে দিয়ে ফারুক ভাই বলেছিল, ‘‘তুই যা, ক্ষেতের ঐ ধারটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক্। কাউকে আসতে দেখলে ‘কু’ বলে ডাক দিবি।’’

আমি বাধ্য ছেলের মতো তাই-ই করতাম। ফজরের আযান পর্যন্ত তারা গল্পে গল্পে সময় পার করতো। ওদিকে আমার কাহিল দশা। ঘুমিয়ে যেতাম আইলের ওপর মাথা রেখে। সরিষা ফুলের গন্ধে স্বপ্নে চলে যেতাম হলুদ পরীর দেশে। ঘুম ভাঙত ফারুক ভাইয়ের ডাকে। টলতে টলতে দুজন বাড়ির দিকে হাঁটতাম। রূপকথা গল্পের রাজপুত্রের মতো দেখাতো ফারুক ভাইকে তখন। ওড়নায় মুখ ঢেকে এক দৌড়ে পালিয়ে যেত ফুলঝুরি বুবু। তাকে তখন হলুদ পরীর মতো লাগতো। যেন ডানা গজিয়েছে সদ্য। সরিষা ফুলের ডানা লাগিয়ে ফুলঝুরি বুবু উড়ে যেত চোখের সামনে দিয়েই। রাজ্যের কাড়িকাড়ি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম তার উড়ে যাবার দৃশ্য চোখে ধারণ করে। হাসিহাসি মুখ নিয়ে ফারুক ভাই বলতো তখন, ‘কাজ শেষ। চল্ এবার।’

পেছন থেকে নিজের নাম শুনতেই ফিরে দেখি ফুলঝুরি বুবু। ইতিমধ্যেই পোশাক বদলে নিয়েছে। হাসতে হাসতে এসে আমার হাত ধরে বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বলল, ‘তুই তো অনেক বড় হয়ে গ্যাছিস রে! কেমন নাদুসনুদুস দেখাচ্ছে তোকে।’  
অবিকল সেই আগের মতো হেসে হেসে বলল বুবু। প্রতিউত্তরে আমিও বললাম, ‘তুমিও তো কম নও বুবু, কেমন চকচক করছে তোমার গালটা।’

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বুবু আমার হাত টেনে ধরে বলল, ‘আজ  তুই আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবি,বুঝলি।’
‘বাব্বা কী স্মার্টভাবে কথা বলছো বুবু।’
‘আরে ঢাকায় থাকি বলে কথা।’ বলেই গায়ের ওপর ঢলে পড়ে ফুলঝুরি বুবু। আজ  প্রায় তেরো বছর পর তার সঙ্গে আমার দেখা। বুবুর চোখ-মুখ যেন নেচে নেচে উঠছে। আকুপাকু লাগছে আমারও। অনেক কালের কথা জমে আছে ভেতরে। তেরোটা বছর মস্তিষ্কে গেঁথে আছে ফুলঝুরি বুবুর রোমাঞ্চে ভরা স্মৃতি। আমার চোখের সামনে ছায়াছবির মতো একটার পর একটা পর্দা ভেসে ওঠে। সরিষা ক্ষেত, ন্যাড়া তালগাছ, ফারুক ভাই।

একটা প্যাকেট খুলে লাঞ্চ বের করে বুবু বলল, ‘চল্ শুরু করি। এই খাবার দুজন ভাগ করে খেতে হবে। পারবি তো?’
‘হু...হুম। খুব পারবো।’
টিফিন বক্স থেকে খাবার বের করল বুবু। আমার চোখ দুটো তখনও তার মুখের দিকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি আমি তাকে।  হঠাৎ মুখ তুলে আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুবু ধমকে ওঠেন, ‘আরে পরে দেখিস। আমি তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছি না। খাওয়াটা আগে শেষ কর।’

তাড়া খেয়ে আমি খাওয়া শুরু করি। খাওয়ার এক ফাঁকে ফুলঝুরি বুবুকে জিজ্ঞেস করি, ‘বুবু ফারুক ভাই কেমন আছে?’
বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুবু। চোখ ছলছল করে ওঠে। আমি পুনরায় তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পাই না। কিছু সময়ের জন্য কারও মুখে কোনো কথা ফোটে না। খাওয়া শেষে বুবু বলল, ‘আজ  আর ডিউটি করতে ভালো লাগছে না। চল্ বাড়ি যাই।’

আমি যেন এক জাদুকরি আয়নায় বন্দি হয়ে আছি। না, হ্যাঁ করতে করতে বুবুর সঙ্গ নিলাম। ঘণ্টাখোনিকের মধ্যে বুবু সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলল। এই এক ঘণ্টা সময় একগাদা স্মৃতির ভেতর হাবুডুবু খেতে খেতে সময় কখন ফুরিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। মার্কেটের সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে সায়েন্স ল্যাব থেকে একটা রিকশা নিয়ে উঠে বসলাম তাতে। রিকশায় উঠেই রাজ্যের সব কথা খলবলিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো। একে একে গ্রামের সবার কথা আগ্রহ ভরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইল বুবু। বড্ড অভিমানী মেয়ে। এতো বছর হয়ে গেল তবু সে গ্রামে ফিরলো না। অথচ গ্রামের প্রত্যেকের নাম মনে রেখেছে।

আমার দাদী মারা গেছে শুনে খুব কষ্ট পেল। ‘আহারে তোর দাদীর হাতে বিচিকলা রান্না যে খেয়েছে, সে জিন্দিগিভর মনে রাখবে।’ একেক জনের কথা উঠছে আর ফুলঝুরি বু’র চোখ একই সঙ্গে জ্বলজ্বল ও ছলছল করছে। এভাবে বকবক করতে করতে একসময় রিকশা এসে থামল গন্তব্যে।  রূপনগর আবাসিকের ২১ নাম্বার রোডের পেছন দিকের বস্তিটাতে থাকে ফুলঝুরি বুবু। টিনের ছাপড়া দিয়ে ঘেরা একটা ঘরে নিয়ে এলো সে আমাকে।

দরোজা ঠেলা দিয়ে ঢুকতেই ঘরে ফারুক ভাইকে দেখে ফুলঝুরি বুবুকে দেখার চেয়েও দ্বিগুণ চমকে উঠলাম আমি। হুইল চেয়ারে বসে আছে ফারুক ভাই। আমাকে দেখে প্রথমে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তারপর শিশুর মতো হাউমাউ করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরল সে। আমি নিজেও কান্না আটকে রাখতে পাললাম না।  আমাদের কান্না দেখে পাশের ঘর থেকে একজন উঁকি দিয়ে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে রে ফুলঝুরি? ছেলেটা কে?’

আমি নির্বাক। মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘কেমন করে হলো?’
এবার বুবু ধীরে ধীরে সব কথা খুলে বলতে লাগল- ‘আমরা যখন ঢাকাতে দু’জন পালিয়ে এলাম। তার দু’দিন পরেই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা হয়। আমরা উঠেছিলাম গুলিস্তানের এক হোটেলে। তোর দুলাভাই বলল, বিশাল বড় জনসমাবেশ হচ্ছে। যাই নেত্রীকে দেখে আসি। বঙ্গবন্ধুকে তো আর দেখিনি। বলেই হোটেল থেকে বের হলো সে। তারপর দেখতেই তো পাচ্ছিস।’

পাঠক কল্পনার পালা শেষ। এবার মূল জায়গায় আসি। ফুলঝুরি বুবুর সঙ্গে অ্যালিফেন্ট রোডে মাল্টিপ্লান মার্কেটে তেরো বছরপর দেখা। সেখানকার চেকার সে। ঠিক এই জায়গায় এসে একটু দাঁড়ান। আর এতক্ষণ আপনি যা পড়লের ভুলে যান শুধুমাত্র ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথাটা বাদ দিয়ে। এবার পুনরায় এখান থেকে পড়ুন।

গ্রেনেডের আঘাতে ফারুক ভাইয়ের বাম হাতটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু ভাগ্য তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় না। সিনেমের মতো বদলে যেতে থাকে তার জীবন। পুনর্জন্ম ঘটে তার। ফুলঝুরি বুবুকে সে মুছে ফেলে জীবনের ব্লকবোর্ড থেকে। এমন কী তার অতীতকেও। সবকিছু অস্বীকার করে সে। তরতর করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে পড়ে দ্রুত। উড়ে যাওয়া হাতটিই ছিল তার সিঁড়ি। গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে অনেকেরই অনুগ্রহ লাভ করে সে। দেখতে দেখতে কীভাবে যেন সক্রীয় হয়ে ওঠে রাজনীতিতে। হয়ে ওঠে বড় নেতা। আমরা গ্রামে  বসে অনেক সময় পেপারে তার কথা পড়তাম।  টিভিতেও মাঝে মধ্যে দেখা যেত তাকে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও গ্রামের কেউ তার দেখা  পায়নি। গ্রামের মানুষের কাছে সে ‘বেঈমান ফারুক’। সে অতীতকে এতটাই দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।

আমিও এক সময় ভুলে গিয়েছিলাম ফারুক ভাইয়ের কথা। কিন্তু ফুলঝুরি বুবুর কথা প্রায়ই বুকে খচখচ করে বাজতো। সেই বুবুকে পেয়েছি আজ। তাই ভাবলাম আপনাদের এখন গল্পটা বলার সময় এসেছে। ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখাটার কথা বলে গল্পটার ইতি টানবো। কোনো এক হরতালের দিন। ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার। আমি লেক পার হয়ে রাস্তায় উঠতে যাবো দেখি একট মিছিল আসছে। সাদা পাঞ্জাবি গায়ে ফারুক ভাইকে দেখে থমকে দাঁড়ালাম। দেখলাম তার ডান হাতে রিভলবার। ধোঁয়া বের হচ্ছে সেখান থেকে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ায় পাশের চামচাকে বলল, ‘চল্। কাজ শেষ।’

মাথার মধ্যে একসঙ্গে অনেকগুলো ফ্ল্যাশ ব্যাক দেখতে লাগলাম।  তেরো বছর আগে। সেই ভোরবেলা। সরিষা ক্ষেত। একপেয়ে তালগাছ। হঠাৎ একটু দূরে ককটেল ফাটার ধোঁয়ার মধ্যে দেখলাম,হলুদ শাড়ি পরে হাসতে হাসতে ফুলঝুরি বুবু ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। আমাকে দেখে যেন বলছে, ‘খবরদার, এ কথা যেন কাউকে বলিস না।’







রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫/তাপস রায়    

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়