ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ছোটগল্প : কোথাও নেই আমি

সাব্বির জাদিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০৫, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প :  কোথাও নেই আমি

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

সাব্বির জাদিদ : অবশেষে তিন ঘণ্টার ছুটি মিলেছে হামিদ সাহেবের। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে থাকেত পিঠ ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। একটানা চল্লিশ দিন শোয়া তিনি। বড়সড় ঘর হলে তবু কথা ছিল। দৈর্ঘে প্রস্থে শরীরের মাপে বানানো ঘর। হামিদ সাহেব বিলাসী জীবনযাপন করা মানুষ। বাবার হাতে গোড়াপত্তন হওয়া রড সিমেন্টের বড় ব্যবসা তাদের। বাড়ি গ্রামে হলে কী হবে, দোতলা। বেডরুম তো বটেই বাথরুম, রান্নাঘর ঝকঝকে টাইলসে মোড়ানো। শোবার ঘরে এসি লাগাতে চেয়েছিলেন। গ্রামের খেতে না পাওয়া মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত আর লাগাননি। বড় দৃষ্টিকটু হয়ে যায় ব্যাপারটা। অবশ্য দোতলার দক্ষিণমুখী জানালা খুলে দিলে এসির আর দরকার পড়ে না। বাড়ির দক্ষিণে বড় বড় আম গাছের বাগান। সেখানে বাতাসের প্রাচুর্য। হামিদ সাহেবের বিশ্বাস, চল্লিশ দিন ধরে যে ঘরে শুয়ে আছেন তিনি, নিমাইগাছীর সবচে’ গরিব মানুষটিও এই ঘরে হাঁপিয়ে উঠবে। আর তিনি হাঁপিয়ে উঠবেন- এ অতিস্বাভাবিক। এই হাঁপিয়ে ওঠা থেকেই তিনি ছুটি চাচ্ছিলেন কদিন ধরে। বাইরে থেকে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসলে শরীরের ম্যাজম্যাজানি ভাবটা কমবে। ক্লান্তি দূর হবে। অবশেষে মিলেছে ছুটি। হোক মোটে তিন ঘণ্টার, তবু ছুটি তো!

 

ঘর থেকে বেরিয়েই তিনি দুই হাত আকাশে তুলে আড়মোড় ভাঙলেন। হাই তুলতে গিয়ে মুখে অদ্ভুত আওয়াজ সৃষ্টি করলেন। তারপর ধাতস্থ হয়ে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলেন সামনে। মতিন মিয়ার বাঁশ ঝাড়ের নিচে কালো রঙের একটা গরু মনোযোগ দিয়ে ঘাস খাচ্ছে। পিঠের উপর একটা ফিঙে লেজ দোলাচ্ছে। গরুটা তিনি চিনতে পারলেন। হায়দারের গরু। একটু যেন রোগা হয়েছে। হায়দার সম্ভবত দানাপানি দিচ্ছে না ঠিকমতো । দেবেই বা কোথা থেকে! পরের বাড়ি কামলা খাটে হায়দার। বছরে একটা গরু পোষে। উজান গ্রাম হাট থেকে বাছুরের চেয়ে একটু বড় গরু কেনে। এক বছর পুষে মানুষ করে কোরবানির আগ দিয়ে বেচে দেয় চড়া দামে। বিক্রির দিন হায়দারের বউটার খুব মন খারাপ থাকে। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে কল থেকে পানি তুলে খুব যত্ন নিয়ে গোসল করায়। গোসলের পর ফাঁসির আসামিকে যেমন ভালো-মন্দ খাবার দেয়া হয়, তেমন ভালো-মন্দ খাবার দেয়া হয় গরুকে। গলায় নতুন রশি ওঠে। হায়দার রশি হাতে যখন বাড়ির সীমানা পার হয় তখন হায়দারের বউকে দেখা যায় দেউড়ির সামনে। মুখে আঁচলচাপা দিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। চোখে টলমলে পানি, যেন তার ছেলে চোরাই পথে মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে কাজ করতে যাচ্ছে। অনিশ্চিত যাত্রা।

 

গরু বেচে এসে দুজন মিলে হিসাবে বসে। দেখা যায় গরুর ছাল-খুদের দোকানে যা বাকি সেখানেই চলে যাচ্ছে লাভের এক তৃতীয়াংশ। বাকি এক অংশে সংসারের খরচ। আর শেষের অংশ দিয়ে ঈদের পর নতুন আরেকটা গরু কেনা। নিমাইগাছীর অনেক মানুষই এখন এই ব্যবসা ধরেছে। যেমন ধরেছে হায়দার।

 

মজিদ মোড় পার হলে হারেসের চায়ের দোকান ঢোকে। সকাল-বিকাল মানুষে গমগম করে দোকানটা। যতটা না চাযের তেষ্টা তার চে’ বেশি তেষ্টা গল্পের। দোকানে আসলেই একসাথে অনেক মানুষ পাওয়া যায়। যত মানুষ ততো গল্প। ইদানীং আবার ডিশ লাইনসহ রঙিন টিভি ফিট হয়েছে দোকানে। সেখানে রাত নেই দিন নেই নাচানাচি চলে। মেয়েগুলো পারেও বটে। এই টিভি আসার পর নতুন কিছু কাস্টমার যোগ হয়েছে হারেসের। সবকিছু ঠিক থাকলে টিভির খরচ দেড় মাসে উঠে যাওয়ার কথা। হামিদ সাহেবের ইচ্ছা ছিল দোকানটায় একটু বসবেন। কত দিন হল গ্রামের লোকজনের সাথে বসে দু’দণ্ড গল্প করা হয় না। কত গল্প যে জমে আছে পেটে! গল্প হল আজকালকার গ্যাস্ট্রিকের মতো। সময় মতো বের করতে না পারলে গোলমাল লেগে যায়। কিন্তু গল্প করবেন কার সাথে! দোকান বন্ধ। মানুষ তো মানুষ, একটা মাছিও উড়ছে না। হামিদ সাহেবের গোলমাল লেগে গেল। এমন হওয়ার কথা নয়। দোকানটা দেয়ার পর হারেস একবার মাত্র শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। সেবারই শুধু দোকান বন্ধ হয়েছিল। হারেস কি আবার শ্বশুরবাড়ি গেল! নাকি তার অসুখ বিসুখ কিছু করেছে! হামিদ সাহেব দোকানের সামনে পাতা চাঙের উপর পা ছড়িয়ে বসলেন। কতটুকুই বা হেঁটেছেন, গোরস্তান থেকে এই চায়ের দোকান, পাঁচশ গজ হবে, অথচ হাঁপিয়ে উঠেছেন। বয়স যে হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে।

 

অল্প কিছুক্ষণ জিরিয়ে তিনি আবার হাঁটা শুরু করলেন। মাত্র তিন ঘণ্টার ছুটি। অকারণে কোথাও সময় নষ্ট করা যাবে না। পুরো নিমাইগাছি ঘুরে দেখার ইচ্ছা তার। অবশ্য সময়ে যদি কুলোয়। একবার বাড়ির দিকেও যেতে হবে। সবাই কেমন আছে খোঁজখবর নিতে হবে না!

 

পথের মাঝে হায়দারের বউটার সাথে দেখা হয়ে গেল। বউয়ের হাতে একটা বালতি। বালতির ভেতর ছাল মাখানো বিচালি। হামিদ সাহেব বুঝলেন গরুর খাবার। হায়দারের বউ এখন গরুকে খাবার দিতে যাচ্ছে। এমনিতে হায়দারের বউয়ের সাথে আগে কখনো কথা বলেননি তিনি । দরকার পড়েনি। অনেক দিন পর নিজ গ্রামের মানুষ পেয়ে কথা বলার জন্য বুকের ভেতর আকুলি বিকুলি করতে লাগল। তিনি হায়দারের বউয়ের সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, ফরিদের মা কেমন আছ?

 

ফরিদ হায়দারের ছেলের নাম। সেই দিক থেকে হায়দারের বউ হল ফরিদের মা। হামিদ সাহেব ভুল কিছু বলেননি। কিন্তু হামিদ সাহেবের কথায় ফরিদের মা এমনভাবে চমকাল, হামিদ সাহেব নিজেই দ্বিধায় পড়ে গেলেন- এই মহিলা আসলেই হায়দারের বউ তো! চেনার অস্পষ্টতা দূর করতে তিনি স্থির চোখে তাকালেন। মহিলা এবার কুঁকড়ে গেল। তাড়াতাড়ি আগের দিনের নতুন বউয়ের মতো ঘোমটা নামিয়ে দিল নাকের উপর এবং হাঁটা শুরু করল। কিন্তু যা চেনার তা চিনে ফেলেছেন হামিদ সাহেব। হায়দারের বউয়ের নাকের নিচে মোটা একটা তিল আছে। তিলের উপর কালো একটা চুল আছ। হামিদ সাহেব খুব ভালো করে চেনেন তাকে। কারণ, মাঝখানের দুটো বছর হামিদ সাহেবের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেছে হায়দারের বউ। তার স্মৃতিশক্তি অতটা ম্যাড়ম্যাড়া নয় যে মাত্র চল্লিশ দিনের নির্বাসনে সব গুলিয়ে ফেলবেন। তবু এই মহিলা যখন হামিদ সাহেবকে এড়িয়ে চলে যেতে লাগল, জিদ চেপে গেল মাথায়। তিনি আবার গিয়ে দাঁড়ালেন হায়দারের বউয়ের সামনে। বললেন, এতদিন পর এলাম, ভদ্রতা করেও তো মানুষ কথা বলে, নাকি!

 

হায়দারের বউ এবার থমকে দাঁড়াল। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যাওযায় বোঝা গেল সে ভয় পেয়েছে। যদিও ভয় পাইয়ে দিতে চাননি হামিদ সাহেব। তিনি পরিবেশ স্বাভাবিক করার ইচ্ছায় বললেন, হায়দারের শরীর কেমন আছে?

 

হায়দারের বউ ঘোমটার ফাঁক দিয়ে মুখ বের করে জড়তা নিয়ে বলল, আপনেক তো চিন্তি পাল্লাম না!

 

হামিদ সাহেবের তখন দুম করে মনে পড়ে গেল চিনতে না পারার রহস্য। তিনি ছদ্মবেশ নিয়ে বেরিয়েছেন। এমন ছদ্মবেশ, তার ঔরসের ছেলে কিংবা এক লক্ষ এক টাকা দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করা বউও তাকে চিনতে পারবে না। ছদ্মবেশের কারণ- নির্বিঘ্নে গ্রাম দর্শন।

 

হামিদ সাহেব এবার ঘুড়ির সুতা গোটাতে লাগলেন- আসলে আমাকে তুমি চিনবে না। হায়দার চেনে। ওর সাথে গরুর হাটে পরিচয় হয়েছিল বহুদিন আগে। সেখান থেকে ঘনিষ্ঠতা। তা গরুর খাবার দিতে যাচ্ছ বুঝি! যাও যাও।

 

হায়দারের বউকে হতভম্ব করে দিয়ে হামিদ সাহেব হাঁটা ধরলেন। তিনি যদি একবার পেছন ফিরে তাকাতেন, দেখতেন, হায়দারের বউ রসগোল্লার মতো বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মাথায় প্রশ্নের ঘূর্ণি- লোকটা আসলে কিডা! গরুর হাটে ফরিদির বাপের সাথে পরিচয় হইছে ভালো কতা কিন্তু আমাক চিনল ক্যাম্মা!

 

হামিদ সাহেব বাড়ির পথ ধরলেন। আশা ছিল রাস্তায় অনেক মানুষের সাথে সাক্ষৎ হবে। কিন্তু পুরো নিমাইগাছি গ্রামটাই যেন হারেসের চায়ের দোকান হয়ে গেছে। জনমানবহীন। অথচ নিমাইগাছির এমন চেহারা কোনকালেই ছিল না। তার মনে পড়ে, এই গ্রামে নতুন কোন লোক ঢুকলে সে কোথা থেকে এসেছে, কার বাড়ি যাচ্ছে, এই একই প্রশ্ন পথের প্রতিটি লোক করত। একই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আগন্তুকের জিভ ব্যথা হয়ে যেত। আর যদি আগন্তুকের হাতে মিষ্টির প্যাকেট থাকত, তবে তো কথাই নেই। পারলে লোকজন তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে তোলে। সবুজের বিয়ের কথাবার্তা শুরু হলে ওর শ্বশুর পক্ষের লোক গোপনে দেখতে এসেছিল হামিদ সাহেবের বাড়ি। কিন্তু জানত না কেমন গ্রামের পাল্লায় তারা পড়তে যাচ্ছে। চেয়েছিল গোপনে খোঁজ নিবে। মানুষের নানা প্যাঁচানো প্রশ্নে তা আর হয়ে ওঠেনি শেষ পর্যন্ত। বিয়েটা হয়ে গেলে এই নিয়ে কত হাসাহাসি হয়েছে ও-পক্ষের আত্মীয়দের সাথে। অথচ আজ দেখ, লোকেরা চিনে ফেলে নানান প্রশ্নবানে জর্জরিত করবে বলেই তিনি ছদ্মবেশে এসেছেন। কিন্তু প্রশ্নবানে জর্জরিত করার মতো কোন লোক রাস্তায় নেই। তার ছদ্মবেশ তাহলে ষোল আনাই বৃথা।

 

অল্পক্ষণ পরেই হামিদ সাহেবের ভুল ভাঙল। হারেসের দোকান বন্ধ থাকা, পথঘাট লোকশূন্য থাকার রহস্য নিজের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই জানা হয়ে গেল। পুরো গ্রাম ভেঙে পড়েছে তার বাড়ির সামনে। শুধু নিমাইগাছি নয়, অন্য গ্রামের মানুষও এখানে। অনেক আত্মীয়-স্বজন এসেছে। সবুজের শ্বশুরকে দেখলেন লাঠি হাতে কুকুর খেদাচ্ছে। সবাই খুব ব্যস্ত। ভোটের মাঠের মতো হইচই হচ্ছে। হামিদ সাহেব মানুষের গায়ের সাথে টক্কর খেতে খেতে বাড়ির দিকে এগোতে লাগলেন। কাছাকাছি হতেই খেয়াল করলেন আম বাগানের ভেতর বিরাট জায়গা নিয়ে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। সামিয়ানার নিচে লম্বা বিশ-পঁচিশ সারি পাটির লাইন। খাওয়া-দাওয়া চলছে। উত্তর পাশে বিরাট বিরাট ডেকচিতে রান্না হচ্ছে। ধোঁয়া উড়ছে। ধোঁয়ার সাথে মাংসের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। হামিদ সাহেব এতসব আয়োজনের উপলক্ষ বুঝে উঠতে পারলেন না। বাড়িতে বিয়ের উপযুক্ত কোন ছেলেমেয়ে নেই। তাহলে কিসের আয়োজন! তিনি হাজার মানুষের ভিড়ে নিজের ছেলে সবুজকে খুঁজতে লাগলেন। সবুজের কাছে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। দূর থেকে তিনি সবুজকে দেখতে পেলেন। সে তখন প্রচণ্ড ব্যস্ত। এক ডেকচি মাংসে লবণ কম হয়েছে এই নিয়ে সে বাবুর্চির সাথে ভয়াবহ গ্যাঞ্জামে লিপ্ত। তার পরনে জিন্সের প্যান্ট। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। ঘামে ভিজে টপটপ করে পানি পড়ছে গা বেয়ে। এর ভেতর হামিদ সাহেব এগিয়ে গেলেন ছেলের কাছে। ছেলের ঘামে ভেজা কাঁধে হাত রেখে বললেন, এখানে কিসের খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে?

 

জবাবে সবুজ এমন ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল, হামিদ সাহেবের রক্ত হিম হয়ে গেল। হিম হওয়ার কারণেই তিনি ছেলের কাঁধ থেকে নিজের হাতটা সরাতে ভুলে গেলেন। তখন সবুজ ‘ধুর মিয়া হাত সরাও’ বলে কাঁধের থেকে বাবার হাতটা ছুঁড়ে ফেলে দিলে হামিদ সাহেবের  মাটির নিচে চলে যেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু মাটি অনেক শক্ত। চাইলেই তিনি যেতে পারেন না। ভয়াবহ কষ্ট বুকে চেপে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে এসে ফাঁকে দাঁড়ালেন। তার কানের ভেতর তখনও ঝাঁ ঝাঁ করে বাজছে পুত্রের ক্রুদ্ধ গলা। দাঁড়িয়েছিলেন ফাঁকে, অল্পক্ষণে ফাঁক পূর্ণ হয়ে গেল মানব শরীরে। ব্যস্ত মানুষের আসা-যাওয়ার পথের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি ধাক্কা খেতে লাগলেন ক্রমাগত। একজন খেঁকিয়ে উঠল- ওই মিয়া, ইডা কি দাঁড়া থাকার জাগা! সরো সরো।

 

তিনি সরে গেলেন। একটু সময় নিয়ে স্বাভাবিকে ফিরে পাশের জনকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা ভাই, এখানে কিসের খাওয়া দাওয়া চলছে?

 

খুব সহজ প্রশ্নের উত্তর ভুলে গেলে হিংসুটে সহপাঠীরা যেভাবে তাচ্ছিল্য করে তাকায়, জবাবে লোকটা তেমন করে তাকাল। তারপর বলল, কিছুই জানেন না দেখছি। বাড়ি কই আপনার?

বাড়ি অনেক দূরে।

অনেক দূরে তো এই গ্রামে ক্যান আইছেন আজ?

এমনি ঘুরতে ঘুরতে চলে আসছি।

ধাপ্পাবাজির জাগা পান না, না! আসছেন খানা খাতি আর বলছেন এমনি আসছি!

আচ্ছা, কিসের খানা, মানে উপলক্ষ?

হামিদ চৌধুরির নাম শুনছেন?

হ্যাঁ, শুনেছি।

কিছুদিন আগে তিনি মারা গেছেন। আজ তার চল্লিশা। বিরাট আয়োজন, বুঝলেন! পাঁচটা গরু মারছে। আশপাশের সাত গ্রামের দাওয়াত।

তাই বুঝি! আমি প্রথমে মনে করেছিলাম কেউ ভোটে পাশ করেছে। তারপর ভাবলাম বিয়ে-শাদি অথবা মুসলমানির ব্যাপার। মানুষ মারা গেলে যে এতো ধুমধামের সাথে খাওয়া দাওয়া হয় জানতাম না।

নীতিকথা রাখেন। এই পর্ব প্রায় শেষ। চলেন ওইদিকে আগাই। পরে আর জাগা পাবনানে। যেভাবেই হোক এই বার বসে যাতি হবি। খিদেও লাগছে সেইরাম।

 

লোকটা হামিদ সাহেবের হাত ধরে হ্যাচকা টান দিলো। হাতে টান খেয়ে তিনি লাফিয়ে উঠলেন। টলতে টলতে সামলে নিলেন শেষ মুহূর্তে। লোকটা বিরক্ত হল- ধুর ভাই, এতো সহজ-সুজা হলি চলে নাকি! খানা খাতি আসে ঘুমটা দিলি হবে না। সবার ভিতর আগে বসার ক্যামুন কম্পিটিশন দেখছেন! আসেন আসেন, আমার পিছন পিছন আসেন।

 

হামিদ সাহেবের খাওয়ার ইচ্ছা নেই। মোটে তিন ঘণ্টার ছুটি। খেয়ে তিনি সময়টা নষ্ট করতে চান না। কিন্তু লোকটার হাত থেকে সহজে মুক্তি নেই মনে হচ্ছে। সে এখনো শক্ত করে হাত ধরে আছে। হামিদ সাহেব যেন লোকটার কিশোর ছেলে। ভিড়ের বাজারে ছেলে হারিয়ে যাবার চিন্তায় অস্থির তার বাবা। তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও লোকটার পেছন পেছন চলতে লাগলেন লাল-নীল-হলুদ-সবুজ সামিয়নার দিকে। হঠাৎ একদল কুকুর হাড়ের টুকরো নিয়ে মারামারি করতে করতে একেবারে হামিদ সাহেবের গায়ের উপর এসে পড়ল। ভয়ে তিনি লাফ মেরে সরে গেলেন। এই সুযোগে লোকটার হাতের গেরো থেকে ফসকে বেরিয়ে এলো তার হাত। আপাতত মুক্তি।

 

সবুজের মাকে এক নজর দেখতে ইচ্ছা করছে। আবার কবে ছুটি পাবেন তার ঠিক নেই। কিক্তু এতো মানুষের ভিড়ে কোথায় পাবেন রেকেয়াকে। সে নিশ্চয় এখন বাড়ির ভেতর। আত্মীয়-স্বজনের বৃত্তের ভেতর বসে হয়ত স্বামীর জন্য হা-হুতাশ করছে। রোকেয়া বড় ভালোবাসত স্বামীকে। চল্লিশ দিনে স্বামীর শোক শুকিয়ে যাওয়ার কথা না। হামিদ সাহেবের মনে হল ভিড়ের সুযোগে তিনি ভেতর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারবেন। গেটের বাঁপাশে একটা বকুল গাছ। গাছটা লাগিয়েছিল সবুজ। তিনি কিনে এনেছিলেন শেখপাড়া বাজার থেকে। শীতকালে তারার মতো সাদা ফুলে ছেয়ে থাকে পুরো গাছ। হামিদ সাহেব বাড়িতে ঢোকার আগে বকুল গাছের নিচে একটু দাঁড়ালেন। ঘাড় উঁচু করে তাকালেন দোতলার বারান্দায়। ঝলমলে শাড়ির মেয়েরা সেখানে খানা খাচ্ছে। সবাই নিকট আত্মীয়-স্বজন। পরিবেশন করছে রোকেয়া। তাকে সাহায্য করছে সবুজের বউ আর শাশুড়ি। রোকেয়ার গায়ে খয়েরি-সবুজ ডোরাকাটা নতুন শাড়ি। হাতে সোনার চুড়ি। টুঙটাঙ আওয়াজ আসছে। এই শাড়ি হামিদ সাহেব দেখে যাননি। নিশ্চয় আজকের  অনুষ্ঠান উপলক্ষে কেনা হয়েছে। হামিদ সাহেব অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মহিলাদের খাওয়ার আসরের দিকে। ওই বারান্দার দেয়ালে দেয়ালে কত স্মৃতি লেপ্টে আছে তাদের! আশা ছিল রোকেয়ার সাথে একবার হলেও চোখাচোখি হবে। হল না। রোকেয়া ব্যস্ত। রান্না কেমন হয়েছে, ঝাল-লবণ ঠিকঠাক হল কি না, পেট ভরে খাচ্ছে তো সবাই- এসব নিয়েই সে মত্ত।

 

হামিদ সাহেব কান পেতে রইলেন। কেউ একজন তার কথা বলে কি না শুনতে চেষ্টা করলেন। কেউ না বলুক, অন্তত রোকেয়ার তো বলা উচিত- সবুজের আব্বার জন্য আপনারা একটু দোয়া করবেন। কিন্তু রোকেয়া সেসব কিছুই বলছে না। সে বরং বলছে, বড় গরুটার দাম ছিল এক লাখ দশ হাজার টাকা। এটা সেই গরুরই মাংস। পেট ভরে খান। হামিদ সাহেবের মনে হল আজকের এই যে বিপুল আয়োজন, সেখানে তিনি সম্পূর্ণ অনুচ্চারিত। কোথাও নেই তিনি। মাংসের ডেকচিতে, সামিয়ানার লাল-নীল রঙে, চুলোর ধোঁয়ায়, পুত্রের ঘর্মাক্ত কপালে, রোকেয়ার চেহারায়, বেদনার ভেতর- কোথাও নেই তিনি।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়