ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ছোটগল্প : মৃত্যু ও একটি বকুল গাছের সঙ্কট

সাইফুল্লাহ সাইফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪০, ২৫ জুলাই ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প : মৃত্যু ও একটি বকুল গাছের সঙ্কট

||সাইফুল্লাহ সাইফ||

এক.

এ বাড়ির মেজ মেয়ে যেদিন প্রথম স্কুলে যায়, সেদিন বাড়ি ফেরার পথে বাবা তাকে একটি বকুল গাছের চারা কিনে দিয়েছিল। ঘরে ফেরার পর মেয়েটির মধ্যে স্কুলের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে যতটা না উত্তেজনা, তার চেয়ে বেশি উত্তেজনা ছিল বকুল চারাটি নিয়ে। মেজ মেয়েটি এ বাড়ির বড় আদরের সন্তান। মেয়েটির একগুঁয়ে আবেদনে সেদিন অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গাছটি রোপণ করা হয়েছিল। যেহেতু এটি গৃহস্থ বাড়ি, তাই বাড়ির প্রধান কর্তাকে সেদিন গাছের ভবিষ্যৎ নিয়ে বারবার ভাবতে হয়েছিল, না জানি এই গাছটির অবস্থান নিয়ে আগামীতে কতটা বিপাকে পড়তে হয় তাদের!
 
একটি আটপৌরে শরিক বাড়ি। প্রতি ঋতুতে বাড়ির উঠোনের গুরুত্ব বেড়ে যায়। এমনকি ফসলের মৌসুম এলে শরিকদারদের মধ্যে উঠোনের জায়গা দখল নিয়ে লেগে যায় প্রতিযোগিতার হিড়িক! কার আগে কে ভালো জায়গাটি দখল করে নেবে। উঠোনে একটি সুন্দর জায়গা বলতে যেখানে রোদ থাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, উদয় থেকে অস্তগামী রশ্মি মাথায় ধরে রাখতে পারে যে উঠোন। গৃহস্থের নিত্যদিনের কাজের জন্য রোদ অত্যাবশ্যকীয়।


বকুল গাছটি উঠোনের অনেকটা মাঝখানে একটি অকিঞ্চিৎকর স্থানে রোপণ করা নিয়ে শরিকদারদের কেউ সেদিন মৃদু আপত্তি তুললেও পরিস্থিতি ঘোলাটে করার মতো সাহস দেখায়নি। কেননা, আজকাল গিন্নিদের কথায় নিরুপায় হয়ে একটু-আধটু বিবাদ হলেও, শেষ পর্যন্ত আত্মসমালোচনায় এটাই মেনে নিতে বাধ্য হয় তারা যে, এ বাড়ির প্রধান কর্তা যিনি, তিনি তাদের প্রত্যেকের বয়োজ্যেষ্ঠ পিতৃসম ভাই এবং তার হাতেই বাবা অকৈশোরে তাদের ভবিষ্যতের ভার তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। লোকটি ভ্রাতৃ কল্যাণের জন্য নিজেকে নিবেদন করে কি না করেছিলেন তখন!
 

তাই গিন্নিদের অভিযোগ অনুযোগের চাপে পড়ে কর্তাদের চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার দশা হলেও এই সর্বনাম পদটি কোনভাবেই তারা অবহেলা করতে পারেন না। কিন্তু সমস্যাটিও যে গুরুতর! বকুল যেহেতু কাষ্ঠল গাছ এবং পরিপূর্ণ সময়ে তার ডালপালা একটি বড় অঞ্চল দখল করে থাকে, তাই গাছটি এখানে বেড়ে উঠলে উঠোনের অর্ধেক অংশ যে নিশ্চিত রোদবঞ্চিত হবে- এটাই তাদের সমুদয় আশঙ্কার জমাটবদ্ধ মেঘ।

মেজ মেয়ের গাছভক্তিকে তার স্বজনরা প্রথমে ঢিলেঢালাভাবে নিছক একটি ছেলেমানুষি জ্ঞান করে নিলেও একসময় ব্যাপারটি তারা বাড়াবাড়ি ভাবতে শুরু করেন। তারা মনে মনে সাপের মত ফণা পাকাচ্ছিলেন আর চাপা জেদ থেকে আওড়াচ্ছিলেন, ‘এ কোন জামানার মেয়েরে বাপু? এমন গোঁয়ার মেয়ে দ্বিতীয়টা দেখি নাই!’
আর এই মেয়ে যে অদূরদিনে তাদের দিনরাত এক করে ছাড়বে, এই ভাবনাও তাদের পিছু ছাড়ে না কোনভাবেই।  কিন্তু সবশেষে গুরুতর বাক্য হয়ে দাঁড়ায় একটাই, ‘ঐ যে কর্তা এবং কর্তার বড় আদরের মেয়ে!’

মেয়েটি সকালে ঘুম থেকে উঠে একবার এবং স্কুলে ফেরার পর আরেকবার, রুটিন করে প্রতিদিন এই দু’বেলা গাছটির পরিচর্যা করত। তার এই চর্চাটি এক সময় অভ্যাসে পরিণত হলে, কেউ আর মেয়েটি কিংবা গাছটিকে নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে যায়নি। বরং তারাও অভ্যাসস্বরূপ মেনে নিলো এবং অভ্যস্ত হয়ে উঠল। এমনকি সময় অভিমুখে চলিত হতে হতে অবস্থা এক পর্যায়ে এমন হয়ে দাঁড়াল যে, কীভাবে যেন পরিবারের সবাই কোন না কোনভাবে গাছ এবং মেজ মেয়ের এই দ্বিপক্ষীয় সন্ধির সাথে একাত্ম হয়ে গেল। দুই একদিন মেয়েটির অনুপস্থিতিতে কেউ না কেউ তাদের অন্য আর দশটা কাজের মতো গুরুত্ব দিয়ে গাছটির পরিচর্যাও করতো।  

গাছটি মাটিতে শিকড় ছড়াল। গাছটি পল্লবিত হয়ে মাথা জাগিয়ে তুলল আকাশের দিকে, কঁচি পাতাগুলো তখন যেন সুন্দরতম পৃথিবীর বন্দনামুখর হয়ে উঠল। এভাবে আরও কতদিন কতদিন পার হয়ে গেল, তার হিসেব জমতে থাকলো মেয়েটির বায়োগ্রাফিক পৃষ্ঠাগুলোতে। সেখানে একটি ধবধবে সাদা পাতা থেকে প্রথমে একটি দুটি করে রুল টানা হল। কালপ্রবাহে পাতাটি কালো ও নীল কালির আঁচরে একটি দুটি লেখা জমতে থাকল। পৃষ্ঠাটি ভরে উঠতে উঠতে ক্রসমার্কের মতো দু’একটি লাল কালির দাগও পড়তে থাকে। তারপর আবার একটি নতুন পাতা শুরু হতে হতে দেখা যায়, ঐ পুরনো পাতাটি কোন এক পর্যায়ে আর সাদাকালো না থেকে একটু একটু ময়লা জমে হলদেটে হয়ে যায়। এরই মধ্যে আবার নতুন পৃষ্ঠায় লেখা চলতে থাকে...


মেয়েটি স্কুল-পাঠ শেষ করে কলেজের পাঠে যোগ দিল। ততদিনে সে তরুণী। একদিন সে লক্ষ্য করল, বকুল গাছটির মাথা তার মাথা ছাড়িয়ে গেছে। তাদের পারস্পরিক ভবিষ্যতগামী সন্ধি অব্যাহত চলতে থাকলো একই সাথে। যেন দুজনের সাথে দুজনের প্রতিযোগিতার একটি চোরাস্বাক্ষরিত চুক্তি।

তরুণী কলেজ পাঠ ছাড়তে না ছাড়তেই বাড়ি থেকে বিয়ের বন্দোবস্ত করা হল। প্রিয় মুখগুলোর উচ্ছ্বাস ও আনন্দে সমর্পিত হয়ে তরুণী এবার গৃহত্যাগে সম্মত হল। তরুণী হয়ত সেদিন পিতৃগৃহ ছেড়ে শ্বশুরালয়ে যাবার কালে প্রথম বকুল গাছটির সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ক্ষান্তি টানল চুক্তিতে। একজন গৃহিণী হয়ে ওঠার চর্চা করল তরুণী । একজন গৃহিণী হয়ে উঠতে যা কিছু করতে হয়, তাই করে যাচ্ছিল সে। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে গৃহিণীর গৃহচর্চা শুরু, একটি কর্মব্যস্ত দিন শেষে রাতে পুনরায় ঘুমুতে যাবার সময় পর্যন্ত চলত তার এই নির্মোহ অভিযান। কিন্তু একেকটি রাত্রি তাকে দিন শেষে নিজ আশ্রয়ে ফিরে যাওয়া পাখির মতো রেখে আসত তার কাছে। তারপর আর কাকে দিয়ে কি! ভেতরে ভেতরে সে রয়ে গেল সেই বকুল গাছটির সাথে অলিখিত সন্ধিবদ্ধ তরুণীটি কিংবা ও বাড়ির মেজ মেয়েটি, যে ছোট্ট খুকী।
গৃহিণী মা হতে চলল একসময় ।

দুই.

একদিন এক বিষণ্ণ দিনে বকুল গাছটির ওপর প্রচণ্ড একটি শব্দ হলে সবাই ধরে নেয়, বকুল গাছটি বুঝি বাজ পড়ে মরেই গেল। এর কিছুদিন পর, এ বাড়ির মেজ মেয়ের পতিবাড়ি থেকে খবর আসে, সেদিন প্লাবনের দিনে তাদের গৃহবধূ সন্তানদান করতে গিয়ে তিরোধানপ্রাপ্ত হয়।  
মেয়েটির বায়োগ্রাফিতে এভাবে পূর্ণচ্ছেদ এলেঅ...!   

তিন.

এদিকে তার বায়োগ্রাফি থেমে যাওয়ার কয়েক বছর পর, একদিন বাড়ির মেজ মেয়ের কোন এক স্বজন বকুল গাছটির ভূতপূর্ব স্থানে এসে মাটিতে একটি ঝরা বকুল ফুল খুঁজে পেল। এই সংবাদে মুহূর্তেই পুরো বাড়িতে হইচই পড়ে গেল!
কি আশ্চর্য! গাছটি কীভাবে কীভাবে এতো বড় হয়ে উঠল কেউ টেরই পেল না?
বহুদিন পর তাদের মনে পড়ল মেজ মেয়েকে। যেদিন প্রথম মেয়েটির বিয়ের প্রস্তাব আসে সেদিনও তারা ঠিক এভাবেই চমকে উঠে আত্মসংবরণে কিছু সময় নিয়েছিল- তাদের মেজ কন্যা বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠল, কি আশ্চর্য!
তারা লক্ষ্য করল, সেই ছোট্ট বকুল গাছটি তাদের অলক্ষ্যে শৈশব-কৈশোর পার করে যৌবনবতী হয়ে উঠেছে এরই মধ্যে। ব্যাপারটা বিস্ময়করই বটে, সকাল বিকেল ঘরে ঢুকতে, বের হতে যে গাছটি তাদের চোখে পড়ার কথা তা কেউই একটিবারও লক্ষ্য করেনি?

গাছটি এগুচ্ছিল ভবিষ্যতের দিকেই। শক্ত অবস্থান নিলো মাটিতে, সেইসঙ্গে বৃদ্ধি করল নিজের শক্তি সামর্থ্য। গাঢ় সবুজ বর্ণের একগুচ্ছ পাতা বকুল গাছটির অবস্থান সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দিল যে, গাছটি ইতিমধ্যে উত্তরাগমন ঘটাতে চলছে। ভোরের সূর্যটি যখন তার একগুচ্ছ সবুজ পাতায় প্রতিফলিত হয়ে এসে চোখে লাগত, তখন চোখজুড়ে একটি প্রেমময় অনুভূতি খেলা করত সবার মনে। যেন এই প্রেম সম্পর্কের প্রেম, পারস্পরিক স্নেহ ও শ্রদ্ধার অপার প্রেম- যে প্রেম তারা প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিল। আর যখন বকুল গাছ ছুঁয়ে বাতাস এসে স্বজনদের গায়ে লাগত, তখনও তারা মেয়েটিকে স্মরণ করত।

কিন্তু এভাবে আর কতদিন বকুল গাছটি তাদের মেয়েকে স্মরণ করিয়ে রাখবে? কতদিন আর তারা শুনবে বকুল গাছের পাতা নড়ার শব্দে তাদের মৃত কন্যার আর্তনাদের সমপতন? বরং বকুল গাছের বাড়ন্ত শরীর এবার নিশ্চিত প্রতিবাদের কারণ হয়ে দাঁড়াল।
তখন গাছটিও তার মৌনসঙ্গীকে স্মরণ করছিল চুপিসারে।
স্বজনদের মধ্যে দুটি পক্ষ দাঁড়াল- একপক্ষ বলছে, এই গাছটির সাথে যেহেতু তাদের মৃত কন্যার অসংখ্য স্মৃতিকণা জড়িয়ে আছে, একে কোনভাবেই কেটে ফেলা যাবে না।

ওদিকে অন্যপক্ষ বলছে, সামনে আমন ধানের সিজন। গাছটি যেভাবে রোদ মাথায় চড়িয়ে অর্ধেক উঠোন নিয়ে বসে আছে, তাতে আর ধান শুকানোর রাস্তা নাই। তাই এই মুহূর্তে না কাটলেই নয়। তা না হলে ধান শুকাবে কি করে?


একপক্ষ দাঁত কিড়মিড়ি দিয়ে বলছিল, তোমরা কি মানুষ? মেয়েটিকে পুনরায় মারতে চাও?
অন্যপক্ষ বিরক্তির ভ্রূ কুঁচকে বলল, ধান শুকাতে না পারলে খাবো কি?
এদিকে বকুল গাছটি তখন ভাবছিল এবার তাকেও এ বাড়ির মেজ কন্যার পথ গুণতে হবে....ভবিষ্যৎ আর কতদূর!   





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জুলাই ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়