ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ছোটবেলার পূজার স্মৃতি || ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ

ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ২০ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটবেলার পূজার স্মৃতি || ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

বর্ষার রিমিঝিমি একটানা বৃষ্টির পর হঠাৎ মেঘভরা বেদনা-মলিন আকাশ হয়ে উঠেছে কাচের মতো ঝকঝকে পরিষ্কার। আকাশে কাশফুলের মতো সাদা আর পাখির পালকের মতো হালকা মেঘ মনটা আচমকা ভালো হয়ে যায়। সেই ছেলেবেলার বাংলা রচনা খাতায় লেখা-  আমার প্রিয় শরৎ ঋাতু যেন মুখোমুখি এস দাঁড়ায়। বলে এই যে শোনো আমি এসে গেছি।

আচমকা চমকে উঠি।  আমি তো এখন সেই আমি নই। যখন ‘পূজো আসছে-বাড়ি যাব’ দেশের বাড়ি যাবার আনন্দে মন কেমন করা  এক অনুভূতিতে মনটা যাযাবর হয়ে যেত। সুনামগঞ্জে নামের ছোট্ট মফস্বল শহরটি (এখন জেলা শহর) থেকে মন মুহূর্তে পালিয়ে যেত দূর বহু দূরে।
কবির ছন্দময় কবিতা মনে দোলা দেয়-
‘পুজো মানেই ছুটি
পুজো মানেই শরৎ মেঘে
রোদে  লুটোপুটি
পুজো মানে বাধা বাঁধন ছেড়া
পুজো মানে ঘরের টানে
দেশের বাড়ি ফেরা-’

দেশের বাড়ি যাওয়ার আনন্দে শত আনন্দধারা বয়ে যেত মনের গভীরে। পূজো এসে গেছে এসে গেছে ছুটির প্রিয় দিন। শুরু হয়েছে দেশের বাড়িতে যাবার তোড়জোড়, মায়ের ঘোছগাছ, মায়ের মুখের শ্রমের ঘাম, মুখে তবু একরাশ হাসি।

দেশের বড়ি বেশ দূরে ‘সুখাইড়’ গ্রামে। সেখানে নিজের বাড়িতে পূজো, শহরের বারোয়ারি পূজোতে  মন তা ভরে না। স্কুল আছে, পড়াশোনা আছে, গান শেখা আছে- তাই বারো মাসের তেরো পার্বণে বাড়িতে যাওয়া হয় না, তবে শারদীয় দুর্গা পূজোতে যাওয়া চাই-ই।

ছুটির আগে স্কুলে ফাংশান, নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটিকা-পাঁচ মিশেলি আনন্দ  অনুষ্ঠান। দূর-দূরান্তে প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হবার কী আকুল আকাঙ্ক্ষা। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও মহানন্দে ছটি কাটাতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকের মহড়া চোখ বুজলে এখনও দেখতে পাই। আমাদের টিচার বেলদি, ছন্দাদির নিখুঁত নির্দেশনায় দইওয়ালা হাঁকে- ‘দউ নেবে গো দই?’
ফুল কুড়োতে এসে পাখির মতো মিষ্টি গলায় সুধা জানালার পাশে বসা অমলকে নিজের পরিচয়  দেয়- ‘আমি মালিনীর মেয়ে সুধা।’
 কখনো বা ‘দুষ্মন্ত শকুন্তলা’ নাটিকা। শকুন্তলা আংটি দেখিয়ে স্বামী দুষ্মন্তের কাছে পরিচয় দিতে গিয়ে চমকে ওঠে দেখে, আঙুলের আংটি নেই আঙুলের থেকে খসে পড়া আংটি যে মাছ গিলে নিয়েছে সে তো বনবাসিনী শকুন্তলা জানে না। এ মুহূর্তটি যেন নিখুঁত হয়, বার বার মহড়া নির্দেশনা দিয়েও বেলাদির একটুও ক্লান্তি নেই। টিচার কবিমুননেছা দিদিও খবর নেন- কেমন হচ্ছে মহড়া। ফাংশান নিখুঁত হওয়া চাই।

শহরের মহিলারা ভেঙে আসত সতীশ চন্দ্র গার্লস হাই স্কুল-এর অনুষ্ঠানে দেখতে । অপলক চোখে সবাই উপভোগ করত নিটোল অনুষ্ঠান। বেলাদির চোখে মুখে ক্লান্তির সঙ্গে অফুরন্ত তৃপ্তি। মেয়েদের সফলতায় টিচারের মুখে হাসি উপরে পড়ত। আমরাও খুশিতে আত্মহারা। আকাশে মায়ের আগমনী গান, ফুলের গন্ধ মেখে বাতাস মৌ মৌ- এমন মধুর পরিবেশ কার না ভালো লাগে। পড়াশোনা নেই, এবার শুধু পূজোর কেনাকাটা।

ধাঙ্গড় পাড়ার লাখো জিজ্ঞেস করতো, ‘খুকি পূজা মে ক্যায়সা কাপড়া লিয়া?’ ক্লাসের বন্ধু রায়হানা, মুনীরাও চুপিচুপি জিজ্ঞেস করতো, ‘পূজায় কি ফ্রক নিলিরে?’ ধাঙ্গড় পাড়ার রুক্কিনী মাসী যমুনা, ফুলকলিয়া, ক্লাসের বন্ধু রায়হানা, মুনীরার মতো শহরের এই মানুষগুলো সবাই কেন ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করে না,  ‘পূজোতে কি ফ্রক করেছ খুকি।’
আমার আগুন রঙা সিল্কের ফ্রক, কৃষ্ণচূড়ার মতো লাল রঙের স্কার্ট সবাইকে না দেখালে, না জানালে আর মজা কোথায়?

 

পূজো-বাড়ি হ্যাজাক বাতির ঝকঝকে আলোতে, ব্যস্ত-সমস্ত মানুষের কলরোলে গমগম করত। পূজো মণ্ডপে দুর্গা প্রতিমার কাঠামো। শণের ওপর মাটির প্রলেপ।  দশভুজা মা সপরিবারের আসবেন। মৃৎশিল্পী বা  কুমোররা ছাঁচে ফেলে তৈরি করছে সব। মায়ের পূজো শুরু হয়নি। হবে তাই এই আহ্বান- আনন্দ-কলরোল। ফুলের গন্ধ মাথা মিষ্টি হাওয়ার পূজো পূজো গন্ধ । কিশোর-জীবনের মধুময় সময়।

দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজনরা আসতেন। কলকাতা গোহাটা, শিলং সব জায়গা থেকে সুযোগ-সুবিধে করে পূজোর সময় অর্থাৎ দীনেন্দ্র চৌধুরী- কলকাতার নামী সরকার তারা এলে হারমনিয়াম নিয়ে গানের  আসর বসত। পূজোর নতুন গানের সুর লহরীতে আনন্দধাম হয়ে উঠত বাড়িটি। চিরকালের চেনা বাড়ি আনন্দের ছোঁয়ার অপরূপ হয়ে উঠত।

পিসিমা আসতেন রাজনগর থেকে সব ভাইবোনকে নিয়ে। সঙ্গে  আসত ঝুড়ি ভরা পদ্মফুল। মায়ের পূজোয় লাগবে যে। কালীপূজা জবা দিয়ে শিবপূজা সাদা ফুলে, দুর্গা পূজাতে যে পদ্মফুল লাগে।
শোয়ার ব্যাপার হতো দারুণ মজা। মেঝেতে ফরাসপাতা বিছানা হতো । সব বোনই একসঙ্গে ঘুমোতাম। শারদীয় চাঁদভাসা রাত মায়াময় হয়ে উঠত। একে বারেই অন্যরকম সে সব দিনরাত। শুধু যে একঘেয়ে নীরস পড়াশোনার দিন থেকে মুক্তি তা তো নায়, ভোরে উঠেই যে শিউলি ফুল কুড়োতে যায়- সে সব প্ল্যান করা। তাছাড়া আছে সারা বছরের জমানো গল্প। কারণ পূজোতেই তো সবার সঙ্গে  দেখা । তাই তো শারদীয় পূজো শুধু পূজো নয় এ যেন এক মিলনোৎসব।

চুপিচুপি ভোরে উঠে শুকতারা দেখা, শিশিরভেজা ঘাসে ছোটাছুটি করা, গালিচার মতো ঘাসের বুকে কমলা রয় বোটার শিউলি ফুল কুড়ানো সে ফুল মালা গাঁথা- এমন কের পূজোর সময়গুলো শীত বিকেলের মতো হুশ করে ফিরিয়ে যেত।

পূজামণ্ডপে মায়ের পায়ের কাছে নিবেদিত পদ্মফুল, বিল্বপত্র, রকমারী প্রসাদ, ফলমূল। মণ্ডপে পূজারী বাহ্মণের গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ সুরেলা কণ্ঠে চণ্ডী পাঠ- ‘যা দেবী সর্বভূতেষু লক্ষ্মীরুপেণ সংস্থিতা নমস্তসৈ নমস্তসৈ নতো নমঃ...’
উচ্চগ্রামের শখ আর উলুধ্বনিতে শরতের মায়াময় দুপুরে যখন উদ্বেল হয়ে উঠত, তখন ভেতর বাড়িতে মেয়েরা মিলে গাইতেন পূজার মেয়েলী গীত। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠত সে সব গান শুনলে।
‘যাও যাও গিরি  আনিতে গৌরী- উমা নাকি বড় কেঁদেছে-
দেখেছি  স্বপন নারদ রবচন, উমা মা মা বলে কেঁদেছে।’


মেয়েলী গীতে চিরকাল মায়ের আক্ষেপ আর কান্না মুর্ত হয়ে উঠত-
‘কেমন করে পরের ঘরে, ছিলি উমা বলা মা তাই
কত লোকে কত বলে শুনে প্রাণে মরে যাই।’

এসব গান শুনে সে বয়সেও মনে হতো আহা! পরের ঘরে কী দুঃখ। চোখের জল মুছে ভাবতাম, এতই দুঃখ পরের ঘরে তাহলে সে ঘরে মেয়ে পাঠাবার দরকার কি? বিকেল থেকে শুরু হতো মায়ের পূজার জন্য ক্ষীর, নারকেলের  সন্দেশ আর নাড়– বানানো। সে গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠত। গাটরি ভর্তি আসত নতুন কাপড়। রাঁধুনী ঠাকুর থেকে মশলা বাটার অলকা ঝি কেউ-ই বাদ যেত না।
সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর পূজোয় হতো যাত্রা গানের আয়োজন।

আমাদের পরিবারে কর্তা ছিলেন জেঠাবাবু , জেঠিমাকে  ডাকতাম ভালো মা বলে। এই ছেলেবেলায় অনেকে ঠাট্টা করতেন; উনি ভালো মা হলে নিশ্চয়ই তোমার খারাপ মাও একজন আছেন।
মায়ের দৃষ্টিদান অর্থাৎ তুলির আচড়ে চোখ আকা হবার সময় উলুধ্বনির আওয়াজে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠত। দৃষ্টিদানের পর থেকেই সত্যিকারের পূজো উৎসব যেন জমে উঠত। মনে হতো মা দু’চোখ ভরে  আমাদের সবাইকে দেখছেন।

সন্ধ্যারাতে মায়ের আরতি। ঢাকের আওযাজের সঙ্গে কীর্তনের সুর মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত। কাসার আর মৃদঙ্গের যুগলবন্দীতে পূজামণ্ডপ হয়ে উঠত আনন্দধাম। আমার দেখা সে সব দিনে সন্ধ্যারতি করতেন যে ঠাকুর- তার ছিল টুকটুকে ফরসা রং, পরনে ধবধবে নতুন ধুতি, গায়ে চাদরের মতো এলিয়ে রাখা নামাবলী। হাতের বড় ধুনচিতে গনগনে আগুন, তাতে সুগন্ধি ধূপ।

পূজোর শুরু হবার কয়েকদিন আগেই ধূপ গুঁড়া করে আট রকমের সুগন্ধি, যেমন গাওয়া ঘি, চিনি আরো কিছু আট রকমের জিনিস মেশানো হতো, তাই ধূপকে বলত অষ্ঠাগন্ধা। আরতি নৃত্যের সময় এই ধূপ পুড়ে পুড়ে এতই  সুগন্ধি ছড়াত যে পরিবেশটাই মধুর হয়ে উঠত। চারদিক থেকে ভেসে আসত ঢাকের আওয়াজ ডিডিং ডিং ডিডিং ডিং । দ্রয়োতীদের মাঙ্গলিক উলুধ্বনি, শাঁখের  আওয়াজ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে শারদীয় এ উৎসব হয়ে উঠত জনমানুষের আনন্দের কলরব।

পূজোর রাতে কখনো কখনো কীর্তনের পালা হতো। সন্ধ্যেবেলা ঠাকুমার সাবধান বাণী তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমোও, নইলে কিন্তু পালা দেখতে পারবে না।  সবার সঙ্গে বিছানায় শুয়েও ফিসফিস গল্প আর শেষ হয় না। মধুর ভাবনায় এক সময় তন্দ্রা নেমে আসত। স্বপ্ন রাজ্যের মাঝে ডুবে থেকে এক সময় কানে যেত সানাইয়ের মধুর সুরেলা আওয়াজ। পালা শুরু করার  আগে শ্রোতা-দর্শকদের মুগ্ধ ও শান্ত করার অপূর্ব পদ্ধতি।

আমরা বিছানা ছেড়ে মুখ ধুয়ে দৌড়-দৌড়-দৌড়। কখনো নিমাই সন্ন্যাস, কখনো বা নৌকাবিলাস।
নৌকা বিলাস পালায় রাধার আক্ষেপ-
‘আমি যখন বসে থাকি গুরুজন মাঝে গো
নাম ধরিয়া রাজার বাঁশি আমি মরি লাজে গো
বাঁশি কি আর নাম জানে না
কলংকিনী রাধা বিনে বাঁশি কি আর নাম জানে না।’

রাধার করুণ আক্ষেপে মন ছলোছলো নদী হয়ে যেত। আহা! কী খারাপ আর নিষ্ঠুর শাশুড়ি জটিলা আর ননদিনী কুটিলা।  কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার  মেলামেশা করলে কি হয় শুনি? জটিলা-কটিলা, প্রিয়ংবদা, বিশাখা আর ললিতা হলে কি আর এমন ক্ষতি হতো!- রাধার জন্য বড় দুঃখ হতো । পূজার আনন্দভরা রাত বিষণ্ন হয়ে উঠত রাধার চোখের জলে।

রোজ পূজার শেষে গরদের শাড়ি পরে অঞ্জলি দিতে পূজো মণ্ডপে আসতেন মা, ভালো মা, কাকীমা। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর দুপুর পর্যন্ত অফুরন্ত আনন্দ।  নবমী পূজোর শেষ লগ্ন থেকেই আকাশে- বাতাসে বিদায় রাগিনী বেজে উঠত। সবাইকে কাঁদাতে আসত বিজয়া দশমী।

বিজয়া দশমী। বিসর্জনের করুণ সুর। ঢাকের বাজনা স্তিমিত হয়ে আসে । শূন্য ঘর, জনমানুষহীন পূজামণ্ডপ। চারদিক থেকে ভেসে আসার করুণ রাগিনী-
‘ওমা যাইও না গো কৈলাস ভবন
তবে যদি যাও মাগো ধরি শ্রীচরণ’
মায়ের বিসর্জনের গান কান্নায় ভরে যেত। তবে আবাহন আর বিসর্জনের মাঝেই তো লুকিয়ে আছে মহামিলনের জয়ধ্বনি। তাই তো পাড়া প্রতিবেশী সে যে ধর্ম বা গোত্রের হোক না কেন সবার বাড়িতে লুচি-তরকারি, নিমকি এসব খাবার না পাঠালে যেন পূজোর আনন্দ পরিপূর্ণ হয়ে উঠত না। সবার কাছাকাছি আসা, বড়দের প্রণাম করে ছোটরা পেতাম অনেক অনেক আশীর্বাদ। মা, ভালো মা, কাকীমা সবার কাছে আবদার করতো ছেলেমেয়েরা, মামীমা, পূজোর মিষ্টি কোথায়?
এই তো হবে বাবা।

বিজয়া দশমীর মিষ্টি বাড়িতে বাড়িতে পাঠানো হতো। কেউ শত্রু নেই, কারো সঙ্গে রেষারেষি নেই, হানাহানি নেই- একইডোরে বাধা হয়ে যেত সবাই।
ছোটবেলার  আমিটাই শুধু বদলে গেছে। শরৎ এলে তো এখনো পুরনো সুরের রেশ ধরে বাজিয়ে যায় সোনার বীণা, মায়ের হলুদ-মাখা আঁচলের মতো পূজোর গন্ধমাখা প্রিয় দিনগুলো এখনো স্বপ্নের মাঝে আলতো দোলা দিয়ে যায়।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ অক্টোবর ২০১৫/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়