ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

জন্মপাপ

সাব্বির জাদিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৯, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জন্মপাপ

|| সাব্বির জাদিদ ||

গোসলে ঢোকার পর সাইফের মনে পড়ে ফুলের টবে পানি দেওয়া হয়নি আজ। যদিও ফুলের টবে পানি দেওয়াটা ঘরের কাজ এবং ঘরের কাজগুলো তার স্ত্রী-ই করে সবসময়। তবু এই কাজটা সাইফ নিজের জন্য আলাদা করে রাখতে চায়। সাইফের মনে হয়, ইটপাথরের ঢাকা শহরে এতে খানিকটা সময় বৃক্ষের কাছাকাছি থাকা যায়। সবুজ বাতাসে শ্বাস নেওয়া যায়। মন ভালো থাকলে বৃক্ষের সাথে কথাও বলা যায়।

 

সাইফের পুরা নাম সাইফ আমান। অবশ্য তার সার্টিফিকেট নেম মো. সাইফুল ইসলাম। সেই ঊনিশশ সাতাশি সালে বুক ভরা উত্তেজনা নিয়ে সে হাজির হয়েছিল লালচাঁদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, বাবার সঙ্গে, মেট্রিক পরীক্ষার নাম রেজিস্ট্রেশনের উদ্দেশ্যে। হেডস্যার জিজ্ঞেস করেছিলেন, পুরো নাম কী দেব?

 

বাবা বলেছিলেন, মো. সাইফুল ইসলাম দেন। তখন কে জানত, এই ছেলে একদিন বড় কবি হয়ে উঠবে এবং তার নামে ঈষৎ পরিমার্জনের দরকার পড়বে! বাবা সেদিন আঁচ করতে পারলে হয়ত নাম রচনার ভার ছেলের কাঁধেই অর্পণ করতেন এবং সেদিন ছেলেও হয়ত বাবার মতোই বলত- মো. সাইফুল ইসলামই দেন, স্যার।

 

ভার্সিটিতে ওঠার পর মো. সাইফুল ইসলামের ভেতর কবিতা আসা-যাওয়া করতে থাকে। কবিতা এমন এক চিজ, যদি কারো উপর ভর করে, তার কবি না হয়ে আর উপায় থাকে না। সাইফুল ইসলাম কবিতা লেখা শুরু করে দেয়। প্রথম কবিতা মো. সাইফুল ইসলাম নামে ছাপা হয় ইউনিভার্সিটির বার্ষিকীতে। এরপর সে লিটলম্যাগ আন্দোলনে সক্রিয় হয়। লিটলম্যাগের পাতায় পাতায় সমকালীন কবিদের রঙবেরঙের নাম তার দৃষ্টিগোচর হলে সে উপলব্ধি করে, এ-যুগে মো. সাইফুল ইসলাম নামের কোন কবির অস্তিত্ব জাস্ট অসম্ভব। তখন থেকে মো. সাইফুল ইসলাম হয়ে যায় সাইফ আনাম।

সাইফ আনাম অল্প বয়সেই কবি হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বাজারে তার পাঁচটা কাব্যগ্রন্থ। এই দেশে, দিনে দিনে যেখানে কবিতার পাঠক কমছে, তীব্র খরায় যেভাবে পানি কমে যায় নদীর, সেখানে বড়সড় এক ভক্তগোষ্ঠী তৈরি করে ফেলেছে সাইফ। সমালোচকদের ভেতরেও তাকে নিয়ে যথেষ্ট কৌতূহল। যদিও তারা লোক সমাগমে কিংবা অনেক লোক পড়ে এমন কাগজে এই কৌতূহলের কথা স্বীকার করে না।

 

ট্যাপ ছেড়ে সাইফ আনাম বারান্দায় আসে ফুলের টবে পানি দেওয়ার জন্য। তখন তার ফোন বেজে ওঠে ঘরে। তার অনুমান, ফোন করেছে নাবিলা। সে ফোন রিসিভ না করে আবার বাথরুমে ঢুকে যায়। নাবিলাকে কথাটা বলার দিন আজ।

নাবিলা সাইফের কবিতার ভক্ত। যে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে সাইফ বাংলা পড়ায়, সেই ইউনিভার্সিটির ইংরেজির ছাত্রী নাবিলা। পরিবারের চাপে ইংরেজি পড়ছে, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রতি তার তুমুল আগ্রহ। মেধাবী মেয়ে। সাইফকে নিয়ে নাবিলাসহ তার ভক্তদের ভেতর একটা হতাশা আছে। কৌতূহলও। কী এক অজানা কারণে সাইফ তার জন্ম সন-তারিখ গোপন রেখে দিয়েছে। তার বইয়ের ফ্ল্যাপে জন্মের কোনো প্রসঙ্গ নেই। পত্রিকার ইন্টারভিউয়ে জিজ্ঞেস করা হলে স্বযত্নে সে এড়িয়ে যায়। ভক্তরাও কম খোঁড়াখুড়ি করেনি। কিন্তু গুপ্তধনের সন্ধান পায়নি কেউ। ভক্তদের বড় ইচ্ছে, তারা বছরের একটা দিন, সাইফ আনামের জন্মদিনে কবিকে নতুন রূপে বরণ করবে ফুল দিয়ে। তার কবিতার উপর আলোচনা-পর্যালোচনা চলবে। আবৃত্তিসন্ধ্যা উদযাপিত হবে। কিন্তু সেই দিনটাই যদি থেকে যায় অজ্ঞাত, তবে কীভাবে হবে!

 

নাবিলার সাথে সাইফের পরিচয় মাস সাতেক। এই সাত মাসে নাবিলা অন্তত সাতশ বার জিজ্ঞেস করেছে জন্ম সন-তারিখ গোপন রাখার রহস্য। সাইফ বরাবরই এড়িয়ে গেছে। কিন্তু সাইফ পুরুষ, নাবিলা নারী। হোক সে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, তবু নারী তো! পুরুষ হয়ে এক রূপসী নারীর ক্রমাগত অনুরোধ সে কীভাবে উপেক্ষা করে! তাই একদিন এক আজগুবি শর্ত জুড়ে দেয়- তুমি যদি আমার শেষের বইটা, মানে ‘সন্ধ্যা দুপুর’ মুখস্থ করে একবারে শোনাতে পারো, তবেই তোমাকে বলব। সাইফ কথাটা বলেছিল নিতান্ত কথার কথা হিসেবে। জগতে ধর্মগ্রন্থ মুখস্থ করার চল আছে। এতে ছোয়াবও আছে। সাইফের বড়চাচার ছেলে, গ্রামে থাকে, সে পূর্ণ কোরআনের হাফেজ। খুঁজলে পরিচিতদের ভেতর আরো হাফেজ পাওয়া যাবে। কিন্তু কবিতার বইয়ের হাফেজ- এমন কথা শোনা যায় না। আর সে-কারণেই অমন আজগুবি শর্ত জুড়ে দিয়েছিল নাবিলাকে। কার খেয়েদেয়ে কাজ আছে, একজন লেখকের জন্ম-সন জানার কৌতূহলে আস্ত বই মুখস্ত করে ফেলবে! কিন্তু কি কাণ্ড, পরের সপ্তাহেই নাবিলা দুঃসাধ্য কর্মটি ঘটিয়ে ফেলে। সাইফের তখন আর পিছু হটার সুযোগ নেই। নিরুপায় হয়ে সে বলে, আচ্ছা, তোমাকে বলব। তবে আজ নয়, অন্যদিন।

 

আজ সেই অন্যদিন। সকালে গোসল আর নাস্তা সেরে সাইফ বেরিয়ে পড়ে ‘বিশ্রাম’ কফিশপের উদ্দেশ্যে। নাবিলা আগে থেকেই অপেক্ষা করছে সেখানে। নাবিলাকে আজ অন্যদিনের চেয়ে ঝলমলে দেখায়। সাইফের তখন নিজের স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। জুঁই যদি জানত, এই রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে, ভার্সিটিতে যাওয়ার নামে সে বিশ্রামে এসেছে এক ঝলমলে মেয়ের সাথে সময় কাটাতে, অনুমতি মিলত! বোধহয় না।

অবশ্য জুঁই এখন অনেক বদলেছে। তার স্বামী দেশের জনপ্রিয় কবি। তার কত ভক্ত-অনুরক্ত! তারা ফোন করে। কবির কুশল জানে। দেখাও করে। বইমেলায় ঘিরে থাকে। এদের ভেতর মেয়ের সংখ্যাই বেশি। সাইফও তেমন, খুব গুছিয়ে, একেবারে মুগ্ধ করে দেবার মতো করে তাদের সাথে কথা বলে। প্রথম প্রথম জুঁইয়ের খুব রাগ হতো। কারণে-অকারণে সন্দেহও করত স্বামীকে। এখন সে বোঝে, কবির বউ হলে এই জ্বালাতনটুকু সহ্য করতেই হয়। তাছাড়া সংসারের বয়স বেড়েছে। তাদের ছেলের বয়স নয়ে পড়েছে। এখন, এতগুলো বছর পার করে আসার পর, বিয়ের প্রথম দিনগুলোর মতো স্বামী ছিনতাই হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তাকে আর বিচলিত করে না।

 

নাবিলা বলে, স্যার, আপনি ঠিক আছেন তো! আপমাকে অন্যমনস্ক লাগছে।

নাবিলাকে নিয়ে সাইফ একটা কফিশপে বসে। তারপর উত্তর দেয়- হ্যাঁ, ঠিক আছি। কখন আসলে তুমি?

বেশি আগে না। আধঘণ্টা হবে।

আধাঘণ্টা তো অনেক সময়। তোমাকে বসিয়ে রাখলাম।

বসিয়েই তো রেখেছেন। কোন কাজে তো আর রাখেননি! নাবিলা অল্প হাসে। তার বাঁপাশের দাঁতের উপর দাঁত দেখা যায়। একটু থেমে সে আবার বলে, বাসায় বলে এসেছেন তো! দুষ্টুমি তার চোখ-মুখ-গাল বেয়ে উপচে পড়তে থাকে। আচ্ছা, যে-জন্য এসেছি সেটা বলুন। দেরি সহ্য হচ্ছে না। আপনার নেক্সট বার্থ ডে তে বিরাট হইচই করব।

সাইফ এবার গম্ভীর হয়ে যায়। কফিতে চুমুক দিয়ে লম্বা সময় কথা বলার প্রস্তুতি নেয়। তারপর বলে, আসলে আমার জন্মের সাথে বাংলাদেশের জন্মকাহিনী জড়িয়ে আছে।

 

নাবিলা চমকে ওঠে খানিকটা। তার মুখের রং কয়েক সেকেন্ডের জন্য গোলাপি থেকে বেগুনি হয়ে যায়। সাইফ আনাম আনুমান করতে পারে তার চমকিত হওয়ার কারণ। তাই সে বলে, তুমি হয়ত ভাবছ, আমি যুদ্ধশিশু। না, আমি যুদ্ধশিশু নই। সেটা যদি হতাম, গর্ববোধ করতাম। মূলত আমার জন্ম ১৯৭২ সালের ১৭ মে। তার মানে আমি আমার মায়ের গর্ভে আসি এর দশমাস আগে ১৯৭১-এর আগস্টে। আমি আমার বাবা-মার প্রথম সন্তান। একাত্তরে আমার বাবা পূর্ণ যুবক ছিলেন। দেশের অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে মাকে নিয়ে পালিয়ে কলকাতা চলে যান বাবা। তুমি ভাবো নাবিলা, ১৯৭১ এর আগস্টে দেশ যখন উত্তাল, অগ্নিগর্ভ, ছেলেরা তীব্রভাবে জড়িয়ে পড়েছে যুদ্ধে, মরছে, মারছে, ঠিক তখন, আমার যুবক বাবা দেশ ছেড়ে পালিয়ে নিরাপদ কলকাতায় বসে সন্তান জন্ম দেওয়ার মতো বিলাসিতায় লিপ্ত। বলো, ওই সময় কোনো পুরুষ বাবা হওয়ার কথা ভাবতে পারে, যখন শত শত বাবার বুক খালি হচ্ছে যুদ্ধে! কোনো স্বামী তার স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমের কথা ভাবতে পারে, যখন শত শত স্ত্রী ধর্ষিতা হচ্ছে সেনা-ক্যাম্পে!

 

সাইফ একটু থামে। থেমে নাবিলার দিকে তাকায়। নাবিলার দুইচোখে বিস্ময় এবং সঙ্কোচ। সে কান খাড়া করে শুনছে সাইফের কথা।

তোমরা  আমার কবিতা যারা পছন্দ করো, হয়ত ভাবো, জন্ম সন-তারিখ গোপন করে আমি কিছু একটা আড়াল করার আনন্দ পাই। ভুল ধারণা। আসলে জন্ম-সময় নিয়ে আমি চরম বিব্রত এবং লজ্জিত। জন্মের কথা ভাবলেই আমার মনে পড়ে ওইসব নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের কথা, যারা দেশের জন্য জীবন তুচ্ছ করেছেন। আমাদের ভালো থাকার জন্য জীবন দিয়েছেন। আর সেই সময়ে তৈরি হওয়া আমার ভ্রুণ যেন গোটা বাংলাদেশের অপমান। এ-যেন আমার জন্মপাপ। সাইফের গলা ভিজে ওঠে।

নাবিলা অপরাধীর মতো বসে থাকে থুতনি গলায় ঠেকিয়ে। তারপর সামলে নিয়ে বলে, আমি সরি, স্যার। আপনার জন্ম-তারিখ, যা জানার জন্য আপনার ভক্তদের তীব্র পিপাসা, আমি তাদের পিপাসা নিবারণের ক্রেডিটটা নিতে চেয়েছিলাম। আর সে-জন্যই এইভাবে ধরেছিলাম আপনাকে। আমি সরি।

 

পরিবেশ হালকা করার জন্য সাইফ বলে, না না, ঠিক আছে। তুমি আমার স্নেহের অনুরাগী। কাউকে না কাউকে তো একদিন জানাতেই হতো কথাটা। আজ তুমি জানলে। আর এই জানানোতে আমিও কিছুটা হালকা হলাম। দীর্ঘদিন চেপে রেখে রেখে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।

স্যার, আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। আপনার জন্ম সন-তারিখ গোপনই থাকবে সবার কাছে। আমি কাউকে জানাব না।

 

কফিশপ থেকে বেরিয়ে এসে তারা জানতে পারে, একটু আগে আরো একজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় হয়েছে। রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে তরুণ প্রজন্ম। তারা আনন্দ মিছিল করছে। সাইফের চোখ সজল হয়ে ওঠে। বিজয় মিছিলের দিকে তাকিয়ে তার শরীরটা পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে যায়।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়