ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জামায়াত এখন দায় কীভাবে অস্বীকার করবে?

জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:০১, ২৯ নভেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জামায়াত এখন দায় কীভাবে অস্বীকার করবে?

জাহাঙ্গীর আলম বকুল : অনেক ঘটনা-রটনার পরে অবশেষে দুই যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। তাদের ফাঁসি কার্যকর করার দিন একের পর এক যে নাটকীয় ঘটনার জন্ম দিয়েছে, তা বিস্ময়কর। ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটে যে, গণমাধ্যমের কর্মীদের হিমশিম খেতে হয়েছে পাঠকের কাছে সংবাদ পৌঁছে দিতে। ম্যাজিস্ট্রেটের কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ, সাকা-মুজাহিদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন, সেই আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছানো, রাষ্ট্রপতির তাতে নারাজি আদেশ, এদিকে চলতে থাকে কারাগারে ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি, সাকা-মুজাহিদের পবিরারের ‘প্রাণভিক্ষার আবেদন করেননি’ জানিয়ে পৃথক সংবাদ সম্মেলন, আইনমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পাল্টা বক্তব্য, সাকার স্ত্রী-ছেলের রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন নিয়ে গণভবনে যাওয়া এবং রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ না পাওয়া, রাতে দুই পরিবারের সদস্যদের কারাগারে সাকা-মুজাহিদের সঙ্গে শেষ দেখা করা এবং দেখা করে ‘প্রাণভিক্ষা আবেদন করেননি’ মর্মে বক্তব্য, অবশেষে রাতে ফাঁসির আদেশ কার্যকর। ঘটনাবহুল একটি দিন শেষে ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে অনেকগুলো বিষয়ের অবসান ঘটে। 

 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ সালে সরকার গঠিত হওয়ার পর তার সাহসী এবং দূরদর্শী কয়েকটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ফলে জনগণের মধ্যে একটি বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করা এবং পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর, জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, বিডিআর হত্যা ও বিদ্রোহের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং প্রতাপশালী ব্যক্তিদের ফাঁসিতে ঝোলানোর ফলে এখন মনে হচ্ছে- দেশে অপরাধের বিচার হয়। বিচার না-হওয়ার যে সংস্কৃতি, তা থেকে দেশ বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক সময়ের রাজন হত্যা মামলা, রাকিব হত্যা মামলা, সস্ত্রীক পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার বিচার দ্রুত শেষ হওয়ায় দেশে দ্রুত বিচার করা সম্ভব- সেটা যেমন প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, তেমনি সরকার বাহবা পাচ্ছে। কিন্তু অভিজিৎ হত্যা, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতাদের জড়িত থাকার অভিযোগ আছে, জনগণ কিন্তু সেদিকেও তাকিয়ে আছে।   

 

মানবতাবিরোধী অপরাধের জড়িত থাকার অভিযোগে যাদের বিচার হচ্ছে- তারা আইনি সব সুবিধা ভোগ করতে পারছেন। তাদের বিচার হচ্ছে- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। সেই ট্রাইব্যুনালে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা দীর্ঘ শুনানি, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন, সাক্ষীদের জেরা করার সুযোগ পাচ্ছেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে আসামি সন্তুষ্ট না হলে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার সুযোগ পাচ্ছেন। সেখানেও দীর্ঘদিন ধরে শুনানি, যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সুযোগ পাচ্ছেন। এরপর আপিল বিভাগের রায়ের বিষয়ে রিভিউ করছেন। প্রচলিত আইনে রাষ্ট্রপতির কাছে দোষ স্বীকার করে দণ্ড মওকুফের আবেদন করার সুযোগও পাচ্ছেন। তারপরও বিচার নিয়ে দেশ-বিদেশে রাজনেতিক দল, গোষ্ঠী, আন্তর্জাতিক সংস্থার কত বিরূপ মন্তব্য, পর্যবেক্ষণ। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মান নিয়ে যাদের এত মাথাব্যথা, তারা কি পৃথিবীর এমন একটি দৃষ্টান্ত দেখাতে পারবেন- যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে এতগুলো ধাপ মেনে, আসামিদের আত্মপক্ষ এত সুযোগ দিয়ে বিচার হয়েছে?  পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক সরকারের অধীনে সামরিক আদালতে গোপনে বিচার করে বহু সামরিক অফিসারকে ফাঁসিতে ঝোলানোর দৃষ্টান্ত এ দেশে ছিল। সেই সব বিচারের নথি পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার মুক্তিযুদ্ধের জঘন্যতম অপরাধীদের বিচারে সেই গোপন পথে কিন্তু যায়নি।

 

মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হয় এবং গোলাম আযমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। যারা বাংলাদেশ চায়নি, সেই জামায়াতে ইসলামী এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দোষররা এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, অনেকে আইনসভার সদস্য বা মন্ত্রী হয়েছেন। যে দেশ তারা চাননি, সেই বাংলাদেশের পতাকা নিজেদের গাড়িতে লাগিয়েছেন। এই পতাকা তারা তো চাননি, বরং যারা চেয়েছিলেন- তাদের হত্যা করেছিলেন, সেই পতাকা যখন গাড়িতে লাগিয়েছিলেন, বিবেক কি তাদের এতটুকু দংশন করেছিল- খুব জানতে ইচ্ছা করে।

 

জামায়াত ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা এবং তাদের নেতার নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার তাদের এ দেশে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়। নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয় গোলাম আযমের। অথচ আজ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী স্বীকার করেনি- একাত্তরে তাদের ভূমিকা ভুল ছিল। সেই স্বাধীন দেশে তারা বাস করছে, স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে, কিন্তু কখনো অনুতাপ করতে দেখা যায়নি। এ দেশের মানুষের কাছে, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ক্ষমা চায়নি। স্বাভাবিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারা চায়নি। এই বিচার বানচাল করার জন্য সব চেষ্টাই তারা করেছে।

 

আমরা যারা তরুণ, মুক্তিযুদ্ধ বা ওই সময় জামায়াতে ইসলামীর কী ভূমিকা চোখে দেখিনি, তাদের কারো কারো মধ্যে যদি যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ সংঘটন নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকেও (যেহেতু জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধীরা বলে আসছে, তারা এ সব করেনি এবং সাজানো বিচার হচ্ছে, তাই সহজ-সরল তরুণদের সেটাই সত্য বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়), সাকা-মুজাহিদের দোষ স্বীকারের পর আর সন্দেহের অবকাশ থাকল না। এই যুদ্ধাপরাধীরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন- তারা যে অপরাধ করেছেন, সেটা স্বীকার করেই (সরকারের দুজন মন্ত্রী প্রাণভিক্ষা চাওয়ার কথা গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন)। এখন জামায়াত মুক্তিযুদ্ধকালীন বিতর্কিত ভূমিকাকে কীভাবে অস্বীকার করবে? এই আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদই মন্ত্রী থাকাকালীন দম্ভ করে সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন- দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই, কোনো স্বাধীনতাবিরোধী নেই।

 

সাকা-মুজাহিদরা যে ‘পাকিস্তানের লোক’ ছিলেন- তা স্পষ্ট করে দিয়েছে পাকিস্তানই। ঘৃণ্য অপরাধে ফাঁসির রায় কার্যকরের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে, দলীয়ভাবে এবং ব্যক্তি পর্যায় থেকে উদ্বেগ, হতাশা ব্যক্ত করেছে। সাকা-মুজাহিদ দুজনই এ দেশের নাগরিক। সাকা এ দেশের জনগণের ভোটে একাধিকবার নির্বাচিত প্রতিনিধি। এ দেশেই মন্ত্রী-এমপি ছিলেন। কিন্তু দরদ দেখা গেল  পাকিস্তানিদের।

 

একসময়ের নামকরা ক্রিকেটার এবং বর্তমানে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রধান ইমরান খান সাকা-মুজাহিদের যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ চাইলেন বাংলাদেশ সরকারের কাছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লিখে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের ‘উদ্দেশ্য’ জানতে চেয়েছেন। পাকিস্তানের গণমাধ্যমে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।

 

আরেক রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) পক্ষ থেকেও সেই দেশের সংসদে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নিন্দা জানানো হয়েছে।

 

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে- তারা ‘গভীর উদ্বেগ’ ও ‘নিদারুণ যন্ত্রণার’ সঙ্গে লক্ষ করেছে, সাকা-মুজাহিদের ফাঁসির রায় ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে’ কার্যকর করা হয়েছে। তারা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। ‘দুঃখ’ ও ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান।

 

আমার কথা নয়, পাকিস্তানে একজন মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীর বলেছেন, পাকিস্তান সরকার এমন আবেগ দেখানোয় একটি ব্যাপার নিশ্চিত করেছে, তারা দুজন (সাকা ও মুজাহিদ) পাকিস্তানের রাজনৈতিক এজেন্ট ছিলেন এবং পাকিস্তানের জন্য কাজ করতেন।

 

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সংসদে বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাবার (ফজলুল কাদের চৌধুরী)  ভূমিকা ‘বিতর্কিত’ ছিল। আজ আদালতে প্রমাণিত হলো- তার ভূমিকাও বাবার মতো ছিল। 

 

লেখক : সংবাদকর্মী।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ নভেম্বর ২০১৫/বকুল/এএন    

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়