ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

টাকা নষ্টের মহোৎসব!

নিয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৯, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
টাকা নষ্টের মহোৎসব!

পিন খুলতে গিয়ে এভাবেই নষ্ট হচ্ছে টাকা (ছবি : রাইজিংবিডি)

নিয়াজ মাহমুদ : টাকা মানেই মূল্যবান বস্তু। বিশেষ কাগজে তৈরি এই বস্তু যে কেউই নিরাপদে রাখেন। অর্থনীতির প্রধান এই বাহনের নিরাপত্তার সিংহভাগ দায়িত্ব পালন করে দেশের ব্যাংকগুলো। নিরাপত্তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করলেও স্বয়ং ব্যাংকাররাই দেশের মুদ্রার চেহারা নষ্ট করছেন বলে অভিযোগ করেছেন এর বাহকরা।

ব্যাংক থেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে টাকায় একাধিক বড় স্ট্যাপলিং পিন ব্যবহার, লেখা ও ঘষামাজা করার ফলে একদিকে অপচয় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ, অন্যদিকে চরম ইমেজ সংকটে পড়ছে দেশ। কারণ, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মুদ্রা আমাদের টাকার মতো ছেঁড়া বা মানহীন নয়। ডলার ও অন্যান্য মুদ্রার নোট অতি যত্ন সহকারে এর রক্ষক ও বাহকরা সংরক্ষণ করেন বলে জানা গেছে।       

রাইজিংবিডির এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশে অব্যবহারযোগ্য মুদ্রার নেপথ্যে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে ব্যাংকগুলো। গ্রাহক যখন টাকা জমা দেন, তখন কোনো ধরনের স্ট্যাপলিং পিন ব্যবহার করেন না। গ্রাহক সরসরি ব্যাংকের কাউন্টারে টাকা জমা দেন। পরে ব্যাংকগুলো আলাদা আলাদা বান্ডিল করে বড় আকারের স্ট্যাপলিং পিন ব্যবহার করে। ঘুরেফিরে পিন মারা টাকা গ্রাহকের কাছে আসে। তখন পিন খুলতে গিয়ে অনেকেই টাকা ছিঁড়ে ফেলেন।      

এমনি এক ঘটনার শিকার সরকারি মালিকানাধীন একটি ব্যাংকের গ্রাহক জাহাঙ্গীর আলম। ওই ব্যাংকটির রাজধানীর একটি শাখা থেকে ২০০টি ৫০০ টাকার নোট তুলেছেন তিনি। দুটি বান্ডিলেই বড় আকারের দুটি পিন লাগানো। ব্যাংক থেকে টাকা তোলার পর পিনগুলো খোলার চেষ্টা কিন্তু খুলতে পারছেন না তিনি। একপর্যায়ে জোরে টান দিতেই টাকার বান্ডিলটি খুলল বটে কিন্তু অনেকগুলো নোট গেল ছিঁড়ে। রীতিমতো ভোগান্তিতে পড়লেন জাহাঙ্গীর আলম।

অনেকটাই ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো টাকার বান্ডিলে বড় পিন লাগাচ্ছে কেন? আর আমরাই (গ্রাহকরা) কেন এমন বিপদে পড়ব? কেনই বা আমাদের বারবার বাংলাদেশ ব্যাংকের শরণাপন্ন হতে হবে? ব্যাংকগুলোই যদি টাকার চেহারা নষ্ট করার মহা উৎসবে মেতে ওঠে, তাহলে সাধারণ মানুষও টাকার যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা করবে।’

শুধু জাহাঙ্গীর আলম নন, হাজারো গ্রাহক প্রতিনিয়তই এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে জানা গেছে। ভুক্তভোগীরা জানান, টাকা সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকের এমন পদ্ধতিতে গ্রাহকরা যেমন হয়রানির শিকার, তেমনি রাষ্ট্রীয় সম্পদেরও অপচয় হচ্ছে। আবার দেশের মুদ্রা সম্পর্কে বিদেশিদের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানান তারা।

প্রায় এক যুগ যাবৎ মুদ্রা বিনিময় (মানি এক্সচেঞ্জ) ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মো. শহিদুল ইসলাম। টাকা নিয়ে বিদেশি পর্যটকদের ধারণা প্রসঙ্গে তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমাদের টাকা আমরা নিজেরা এতই নোংরা করি যে, বিদেশিরা টাকা হাত দিয়ে ধরতে চায় না। টিস্যু পেপার দিয়ে টাকা ধরেন এবং ওই টিস্যু পেপারে পেঁচিয়ে বহন করেন। তারা কিন্তু নিজ দেশের মুদ্রার নোট ঠিকই হাত দিয়ে ধরেন। কারণ, তাদের মুদ্রা ছেঁড়া, ফুটো ও ময়লাযুক্ত না।’

একটু হতাশা প্রকাশ করে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘টাকার এই অবস্থার জন্য আমরা (বাংলাদেশিরা) বিদেশি পর্যটকদের কাছে ইমেজ সংকটে পড়ি। টাকা ছেঁড়া ময়লা হওয়ায় আমাদের দেশের মানুষের মনের সৌন্দর্যও প্রকাশ পায় না। এই টাকা কারা নষ্ট করছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।’

টাকা ছাপানোর প্রতিষ্ঠান দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড  (টাঁকশাল) সূত্রে জানা গেছে, টাকা ছাপানোর পরে শুধু এক হাজার টাকা মূল্যমানের নোটের বান্ডিলে ছোট স্ট্যাপলিং পিন মারা হয়। শুধুই নিরাপত্তার জন্য। তবে অন্য কোনো নোটের বান্ডিলে কোনো ধরনের পিন মারা হয় না।   

এ প্রসঙ্গে টাঁকশালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জিয়াউদ্দীন আহমেদ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ব্যাংকার ও গ্রাহকদের নিরাপত্তার জন্যই এটি করা হয়। সবচেয়ে মূল্যবান এই নোট যাতে সহজে না হারায়, সে জন্যই এক হাজার টাকার নোটের বান্ডিলে এ ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু অন্যান্য নোটে পিন মারার কাজটি তফসিলি ব্যাংকগুলো করে। ’

দেশের মানুষের হাতে হাতে ঘোরে কাগজের তৈরি এ বস্তুটি। একদিকে স্ট্যাপলিং পিন ব্যবহার, অন্যদিকে বাহকদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় টাকা ছিঁড়ে যায়, পুড়ে যায় কিংবা রং পরিবর্তন হয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যায়।  ফলে একসময় তা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেসব টাকা পুড়িয়ে ফেলে। এরপর সে টাকা নতুন করে ছাপতে সরকারকে খরচ করতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা।
 
মানুষের প্রধান বিনিময়-মাধ্যম এ টাকা ছাপা বাবদ বছরে কী পরিমাণ টাকা ব্যয় হয়, তা উঠে এসেছে রাইজিংবিডির এক অনুসন্ধানে।
 
পোড়ানো টাকার সমপরিমাণ নতুন টাকাসহ চাহিদামাফিক টাকা বাজারে ছাড়তে, এর ছাপাখানা ‘দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেডের (টাঁকশাল) প্রতিবছর খরচ হয় ১৬৪ লাখ কোটিরও বেশি টাকা।

কেন ব্যাংক থেকে টাকার বান্ডিলে বড় মাপের একাধিক স্ট্যাপলিং পিন করা হচ্ছে- এ প্রশ্নের জবাবে জনতা ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য কর্পোরেট শাখার মহাব্যবস্থাপক বি এম জাহাঙ্গীর রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘যদিও টাকা নষ্ট হচ্ছে, তারপরও নিরাপত্তার জন্যই এটি করা। এ ছাড়া লেনদেনে সুবিধা হয়, তাই মূলত পিন-আপ করা হচ্ছে।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের  উপমহাব্যবস্থাপক পরিমল চন্দ্র চক্রবর্ত্তী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘টাকার চেহারা সুন্দর রাখার দায়িত্ব সকলের। নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকগুলো নোটের বান্ডিলে স্ট্যাপলিং করে আসছে। ফলে গ্রাহকরা যথাযথভাবে নোট যাচাই করে নিতে পারছে না। এর ফলে নোটের গুণগত মান ও স্থায়িত্ব দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।’

তিনি জানান, সম্প্রতি ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোটের প্যাকেটে একটির বেশি স্ট্যাপলিং পিন ব্যবহার না করতে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোটের বান্ডিলের বাঁ দিকের মাঝখান হতে ১-১.৫ সেন্টিমিটারের মধ্যে একটি মাত্র স্ট্যাপলিং পিন ব্যবহার করতে সার্কুলারে নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা।

 

 

 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/নিয়াজ/শাহনেওয়াজ/ এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়