ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় ইতিহাস বিকৃতি

জহিরুল হক মজুমদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ২২ আগস্ট ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় ইতিহাস বিকৃতি

জহিরুল হক মজুমদার : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছে ১৯২১ সালের ১ জুলাই। পূর্ববঙ্গের মানুষদের জন্য এ’টি ছিল একটি বিশেষ দিন। বঙ্গভঙ্গের বেদনা ভুলে একটি নতুন যাত্রার দিন। পূর্ববাংলা-আসাম মিলে একটি নতুন প্রদেশ ১৯০৫ সালে ইংরেজ সরকার ঘোষণা করলে পূর্ববঙ্গের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই নতুন প্রদেশ এবং তার রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের নতুন আশার নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে ইংরেজ সরকার এই নতুন প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করলে, এটি পূর্ববঙ্গের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মনোবেদনার কারণ ঘটে। অনেকটা এই মনোবেদনার ক্ষতিপূরণ হিসেবেই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজ সরকার, যার নামকরণ করা হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতিষ্ঠার ৯৬ বছরে পদার্পণ করল। আর কয়েক বছর পরই প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী।

 

শুরুর দিকে বাংলা ও সংস্কৃত, ইংরেজি, উর্দু ও ফার্সি, ইতিহাস, অর্থনীতি, দর্শন, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত, আরবি ও ইসলামী শিক্ষা, আইন- এ কয়টি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম উপাচার্য ছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্যার পি জে হার্টগ। শুরুর দিকের বাঙালী শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মোহিতলাল মজুমদার, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, ডঃ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, হরিদাস ভট্টাচার্য, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ। এছাড়া ইংরেজ শিক্ষকরা তো ছিলেনই। ভারত ভাগের পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংকটে পড়ে। হিন্দু শিক্ষকদের একাংশ ভারতে চলে যাওয়াই এই সংকটের প্রধান কারণ। তৎকালীন উপাচার্য মোয়াজ্জেম হোসেন এই সংকট সমাধানের জন্য ব্রিটেন গিয়ে প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যার হ্যারল্ড লাস্কীর  পরামর্শে বেশ কিছু ইংরেজ শিক্ষককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ দানের জন্য নিয়ে আসেন। যাঁদের মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিউম্যান প্রণিধানযোগ্য। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও কোন কোন বিভাগে বিদেশী শিক্ষক ছিলেন। যেমন ইংরেজি বিভাগে মিস এ জি স্টক। বর্তমানে প্রায় শতভাগ শিক্ষকই বাংলাদেশী। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বিদেশী ভাষা শেখানোর জন্য কিছু বিদেশী শিক্ষক রয়েছেন, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষক নন।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নব্বই দশকের শুরু থেকে বিভিন্নভাবে বিতর্কিত হয়েছে। তারপরও ফলাফলে উপরের দিকে থাকা ছাত্র ছাত্রীরাই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছে বেশী। শীর্ষ ফলাফলধারী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের দিকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ঝোঁক । কোনো সময় শীর্ষ ফলাফলধারী কেউ বাদ পড়লে তার কারণ যে নেহায়েতই রাজনৈতিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সেই বাদ পড়ার সংখ্যা সবসময়ই অনেক কম। বিগত বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে ছাত্র জীবনে অস্ত্রধারী মাস্তানকেও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে দেখা গেছে।  

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে অনেক গল্প এখন মজার এবং পিলে চমকানোও বটে। নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক আব্দুস সালাম তাঁর তরুণ বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে আবেদন করলে নির্বাচনী বোর্ড তাঁকে যথেষ্ট যোগ্য মনে করেনি। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বখ্যাত করার পেছনে যে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদান, তাঁকেও নির্বাচনী বোর্ড দ্বিতীয় পছন্দে রেখেছিল। মেঘনাদ সাহা ছিলেন বোর্ডের প্রথম পছন্দ। বলা হয়েছিল, যদি সাহা যোগদান না করেন, তাহলে বসু যোগদান করতে পারেন।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তির প্রক্রিয়াটি সমাজের বিপুল আস্থা অর্জন করেছে। সবাই এ বিষয়ে নিশ্চিত যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া শতভাগ স্বচ্ছ। কয়েক বছর আগে কিছু ভুয়া ভর্তি ধরা পরলেও বিশ্ববিদ্যালয় কড়া ব্যবস্থা নিয়েছিল।

 

তবে দুঃখজনকভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়েছে উপাচার্য পদটি। বিশেষ করে স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৭৩ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ, যা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩’ নামে খ্যাত, তা জাতীয় সংসদের অনুমোদন লাভের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। শুধু অর্থের ব্যাপারে সরকারি অডিটের কাছে জবাবদিহি ছাড়া নিয়োগ, পদোন্নতি, ছাত্র ভর্তি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণভাবে নির্বাহী কর্তৃত্বের প্রভাব মুক্ত। শিক্ষকদের একাডেমিক স্বাধীনতাও নিশ্চিত করা হয়েছে শতভাগ। একই সাথে শিক্ষকদের জন্য আর্থিক লাভ ছাড়া যে কোনো বৈধ সংগঠনের সদস্য হওয়ার বিধানও রাখা হয়েছে। শিক্ষকদের এই বৈধ সংগঠনের সাথে সম্পর্ক রাখার অধিকারই শিক্ষকদের রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে। অধিকাংশ শিক্ষকই রাজনৈতিক দলের সাথে সরাসরি যুক্ত নন; হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষক সরাসরি রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত। তবে কিছু শিক্ষক জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত আছেন বলে জানা যায়।

 

স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতি করা সম্মানজনক নয় এবং সামাজিকভাবে হেনস্থা হওয়ার ভয়ে তারা সহজে তাদের রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা জানান দিতে চান না। জামাত নিষিদ্ধ হলে একই সাথে সমস্ত জামায়াতি শিক্ষককে চাকুরী থেকে প্রত্যাহার কিংবা বহিষ্কারই হবে যথার্থ সিদ্ধান্ত। আর কয়েক বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণভাবে জামায়াতি মতাদর্শমুক্ত থাকবে এটাই সকলে আশা করে।

সারা পৃথিবীতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ধারার সাথে সঙ্গতি রেখেই ১৯৭৩ এর আদেশ প্রণয়ন করে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে শিক্ষকদের সাংগঠনিক তৎপরতার স্বাধীনতা নগ্ন দলবাজিতে রূপ নেয় এবং এই দলবাজি হয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদে আরোহণের সিঁড়ি। শিক্ষকদের মধ্যে নানা রঙের দলের আবির্ভাব ঘটে। এইসব দল থেকেই সিনেট, সিণ্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, ফাইন্যান্স কমিটি এবং ডীন পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়। সাধারণ শিক্ষকরা আর কোন বিকল্প না পেয়ে মন্দের ভাল হিসেবে দুইটি প্রধান শিক্ষক জোটের মনোনীত যে কোনো একজনকে নির্বাচিত করেন। একাডেমিকভাবে ভাল এবং যথেষ্ট সিনিয়র কোন শিক্ষকের পক্ষে স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন পরিষদে নির্বাচিত হওয়া কিংবা ডীন নির্বাচিত হওয়া প্রায় দুরূহ। তাই কেউ চেষ্টাও করেন না। জুনিয়র শিক্ষকদের পদোন্নতির লোভ কিংবা ভয় এবং হাউজ টিউটর কিংবা সহকারী প্রক্টরের মত লাভজনক পদে নিয়োগের লোভ দেখিয়ে দলীয় ভোট নিশ্চিত করা হয়। এছাড়া দলীয়ভাবে নিযুক্ত ডীন ভর্তি সংক্রান্ত কাজ নিজের পছন্দের শিক্ষকদের মাধ্যমে সম্পাদন করে তাদেরকে বিপুল আর্থিক সুবিধা পাইয়ে দেন। এতে নিজের এবং দলের ভোট নিশ্চিত হয়।

 

১৯৭৩ এর আদেশে প্রদত্ত শিক্ষকদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা বিক্রয় হয়ে যায় সামান্য কিছু সুবিধার কাছে। হয়তোবা এ ছাড়া পরিবার চালানো একজন তরুণ শিক্ষকের পক্ষে দুরূহ।

 

১৯৭৩ এর স্বায়ত্তশাসন উত্তর সময়ে সবচেয়ে বিতর্কিত হয়ে পড়েছে উপাচার্য পদটি। ক্রমাগতভাবেই এর মানের অবনমন ঘটেছে। একজন উপাচার্যের কাছে যে ধরণের পাণ্ডিত্য, ব্যক্তিত্ব, ছাত্রের প্রতি স্নেহপরায়ণ মন, শিক্ষকদের প্রতি যত্নশীল এবং প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় উন্নতির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কাঙ্ক্ষিত, সে ধরণের লোককে আর উপাচার্য পদে দেখা যাচ্ছে না। অধ্যাপক মোজাফফর আহম্মদ চৌধুরী এবং অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরীর পর শিক্ষকদের স্মৃতিতে সর্বশেষ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন উপাচার্য হচ্ছেন অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী।

 

নব্বই উত্তর সময়ের উপাচার্যরা ক্রমাগতভাবেই তাদের বিভিন্ন প্রশাসনিক এবং ব্যক্তিগত আচরণের মাধ্যমে উপাচার্য পদের মর্যাদাহানি করেছেন। ছাত্র এবং শিক্ষকদের কাছে চিহ্নিত হয়েছেন দলবাজ হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক যোগ্যতম শিক্ষককে পেছনে ফেলে শুধু দলীয় আনুগত্যের যোগ্যতায় তাঁরা উপাচার্য হয়েছেন। অনেকে সিনেটে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়ার জন্য আঞ্চলিকতাকেও কাজে লাগিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে উপাচার্যের আসনে বসেও নিজের দল আর নিজের এলাকার লোকদের নিয়োগ এবং পদোন্নতির সুবিধা দিয়েছেন।

 

উপাচার্য পদের এই ক্ষয়টি একটি অসহনীয় বীভৎস মাত্রা পেয়েছে বিগত বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সময় থেকেই। রাতের অন্ধকারে ছাত্রী হলে পুলিশি নির্যাতনের দায় কাঁধে নিয়ে ছাত্র আন্দোলনের মুখে একজন উপাচার্যকে বিদায় নিতে হয়। তাদেরই নিযুক্ত পরবর্তী উপাচার্য ছাত্র অবরোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তৎকালীন সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের মাস্তানদের ব্যবহার করেন।

 

দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ক্ষয়টির চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই সময়ে; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জুলাই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছোট একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই পুস্তিকা একটি কালো পুস্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগদানকারী ছাত্র, শিক্ষক এবং অতিথিদের কাছে। পাতা উলটে সবাই হতভম্ভ হয়ে দেখেছে যে, এই পুস্তিকায় ‘মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল’ এর পরিচিতি লিখতে গিয়ে, জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ এ দেশের যে কোনো সাধারণ মানুষও জানে যে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসের এত বড় বিকৃতি দেখে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে ফেটে পড়ে অনেকেই। পরিস্থিতি সামাল দিতে উপাচার্য প্রফেসর আরেফিন সিদ্দিক বইটি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেন। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি। বাসায় ফেরার পথে উত্তেজিত ছাত্র জনতার হাতে আক্রান্ত হন উপাচার্য। তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ছাত্ররা তাঁর বাসার সামনে অবস্থান নিয়ে তাঁর পদত্যাগ দাবী করতে থাকে এবং তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের ‘রাজাকার’ হিসেবে চিহ্নিত করে শ্লোগান দেয়।

 

উপাচার্য মিডিয়ায় এই বলে দায় এড়াতে চান যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতিমূলক এই লেখাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার রেজাউর রহমান লিখেছেন। সুতরাং এটি তাঁর দায়। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, যেহেতু লেখার বাইলাইনে (By Line) রেজাউর রহমানের নাম রয়েছে, সেহেতু সম্পূর্ণ দায় রেজিস্ট্রার রেজাউর রহমানের। যে কোনো সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন মানুষই বুঝবেন যে, এই ধরণের যুক্তির মাধ্যমে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় উপাচার্যের দায়মুক্তি ঘটে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান, যার প্রধান আয়োজক উপাচার্য নিজে, তিনি রেজিস্ট্রারের ঘাড়ে দায় দিয়ে নিজের দায় এড়াতে পারেন না।

 

তদুপরি এই রেজিস্ট্রার উপাচার্যের অত্যন্ত আস্থাভাজন বলে কথিত আছে। ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রেজাউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রেজিস্ট্রার দপ্তর’ এর কোন কর্মকর্তা নন। তিনি ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) একজন কর্মকর্তা। রেজিস্ট্রার দপ্তরে ভর্তি, বৃত্তি এবং শিক্ষকদের নিয়োগ বা পদোন্নতি বিষয়ে যেসব কার্যক্রম চলে, সেসব বিষয়ে তাঁর কোন অভিজ্ঞতা না থাকা সত্বেও বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় তৎকালীন উপাচার্য তাঁকে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ প্রদান করে।

 

এদিকে সহকর্মীদের বারবার আপত্তি সত্বেও বর্তমান উপাচার্য তার কার্যকালের শুরু থেকে সাত বছর ধরে রেজাউর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হিসেবেই বহাল রেখেছেন। পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে বাইরে থেকে কোন যোগ্য ব্যক্তিকে রেজিস্ট্রার নিয়োগ কিংবা রেজিস্ট্রার দপ্তরের কাউকে পূর্ণকালীন নিয়োগ দেননি। এতে প্রমাণিত হয়, এই রেজিস্ট্রার উপাচার্যের কতটা আস্থাভাজন। এ থেকে এই ধারণা করাও অসঙ্গত হবে না যে, ইতিহাসের এই জঘন্য বিকৃতি উপাচার্যের জ্ঞাতসারেই ঘটেছে। রেজিস্ট্রারকে তাঁর পদ থেকে অব্যাহতি; একধরণের নাটকীয় আচরণের মাধ্যমে উপাচার্যের নিজের দায়মুক্তির চতুর প্রয়াস বলেও ধারণা করা যেতে পারে।

 

উপাচার্য প্রফেসর আরেফিন সিদ্দিক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দুটি শিক্ষক জোট নীল এবং গোলাপী দলের মধ্যে সর্ববৃহৎ শিক্ষক জোট নীল দলের রাজনীতি দীর্ঘ সময় ধরে করে এসেছেন। এর ভেতর দিয়েই তাঁর পরিচিতি গড়ে উঠে এবং এক পর্যায়ে তিনি উপাচার্য হন। কিন্তু ভিতরে লুকিয়ে থেকে সময়মত পিঠে ছুরিকাঘাত করার মত ‘খোন্দকার মোশতাক’ সবসময়ই থাকে। তিনি কি বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন! সে বিচার এখনই করা যাবে না। তবে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের যে হৃদয়ের গভীরে আঘাত লেগেছে তা ছাত্রলীগ কর্মীদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বোঝা গেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ এই ইতিহাস বিকৃতিতে গভীরভাবে আহত বোধ করেছেন, এতে কোন সন্দেহ নেই।

 

অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিককে শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে বিভিন্ন জাতীয় সঙ্কটে শিক্ষকদের অবস্থান প্রশ্নে যে রকম দৃঢ়চেতা দেখা গেছে কিংবা জঙ্গিদের দ্বারা  অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের আহত হওয়া থেকে শুরু করে তাঁর মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার প্রশ্নে যে রকম আন্তরিক দেখা দেখা, তার বিপরীতে ১লা জুলাই এর এই ইতিহাস বিকৃতির ঘটনা তাঁর অবস্থানকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তিনি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিবিরের লোক কী না, এই প্রশ্ন চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে।

 

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি করে এই ঘটনায় উপাচার্য, রেজিস্ট্রার এবং অন্য কেউ জড়িত থাকলে তাদের দায় নির্ধারণ করা এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রিন্টিং এবং পালিকেশন আইন অনুযায়ী এই প্রকাশনাটি সরকারের বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা উচিত।

 

বিশেষ দ্রষ্টব্য : মতামত লেখকের নিজস্ব।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ আগস্ট ২০১৬/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়