ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হিলারি বা ট্রাম্প ও মধ্যপ্রাচ্য ।। রাসেল পারভেজ

রাসেল পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৬, ৮ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হিলারি বা ট্রাম্প ও মধ্যপ্রাচ্য ।। রাসেল পারভেজ

ভোটের ঢাক বেজে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রে। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে বিশ্বজুড়ে নতুন হিসাব-নিকাষ চলছে। বিশেষ করে জ্বলন্ত মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ বিরাজ করছে।

হিলারি ক্লিনটন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প যিনি-ই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন কেন, তাতে কি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যনীতিতে কোনো পরিবর্তন হবে? এ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মোটামুটি একমত, কোনো পরিবর্তন হবে না। কিন্তু কেন? মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা আর কত দিন চলবে? এর কি শেষ হবে না? এসব প্রশ্নের আশাব্যঞ্জক কোনো উত্তর নেই।

নিটক অতীতে যুক্তরাষ্ট্র যে ধারাবাহিকতায় নজর দিয়েছে, তাতে হঠাৎ করে মধ্যপ্রাচ্যনীতি পরিবর্তন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা যদি আফগানিস্তানের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব- সেখানে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায় মার্কিন বাহিনী ও তাদের নেতৃত্বাধীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক জোট নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো)।

তখন ছিল বুশের শাসনামল। আট বছর ধরে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাড়া জাগানো প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বারাক ওবামা প্রতিশ্রুতি দেন, তিনি নির্বাচিত হলে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে। প্রথম মেয়াদে ব্যর্থ হন, দ্বিতীয় মেয়াদে কিছুটা কথা রাখলেও পুরোপুরি প্রতিশ্রুতি রাখেননি তিনি। এখনো আফগানিস্তানে হামলা-হাঙ্গামা, জঙ্গিবাদী তৎপরতা, সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি।  

রক্ষণশীল রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ তার বাবা সিনিয়র বুশকে অনুসরণ করে মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বালিয়েছেন। এমন ইচ্ছা সব সময়ই ইসরায়েলের ছিল, যার বাস্তবায়ন হয় দুই বুশের আমলে। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির নির্বাচনে ইহুদিদের শক্তিশালী প্রভাব থাকে সব সময়। ভোটে তাদের বিনিয়োগও কম নয়। তবে এক্ষেত্রে ইহুদিরা ডেমোক্রেটিক পার্টিতে বিনিয়োগ করে থাকে। কারণ, রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট যুক্তরাষ্ট্রের সব নেতাই  আর কিছু না বুঝুন, যুদ্ধটা ভালো বোঝেন। ১৯৯০-এর দশক থেকে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যুদ্ধের ঢোল কখনো থামেনি। সময়ের গতিতে তা বহু গুণ বেড়েছে, বরং এক চুল পরিমাণও কমেনি।

বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসার পর শান্তিকামী বিশ্ব তার কাছে অনেক কিছু প্রত্যাশা করেছিল। বিশেষ করে, ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তাকে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়, যে কারণে তার কাছ থেকে বিশ্ব শান্তির প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু আমরা কী দেখলাম? দেখলাম, তিনি বুশের উত্তরাধিকারী হয়ে আগের যুদ্ধগুলো আরো লম্বা করলেন। তার আমলে শুরু হলো নতুন নতুন যুদ্ধ। বলতে গেলে, ওবামার আমলে প্রতিটি যুদ্ধ ও আগ্রাসন ছিল ভুল।

ওবামার আমলের সবচেয়ে বড় ভুল লিবিয়া আক্রমণ করা। লিবিয়ার স্বৈরশাসক লৌহমানব মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হটাতে সামরিক হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এতে কার লাভ হয়েছে? এক অরক্ষিত বারুদগর্ভ হিসেবে লিবিয়াকে ফেলে রেখে চলে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন দেশটি জঙ্গি আর সন্ত্রাসীদের আখড়া। লিবিয়ায় কেউ শোনে না কারো কথা। নৈরাজ্য বলতে যে নেভিবাচক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য বোঝানো হয়, লিবিয়া তার চূড়ান্ত উদাহরণ। এর জন্য ওবামা প্রশাসন দায়ী। একটি দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা না করেই গায়ে পড়ে সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে যে আগ্রাসন চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, তা ২১ শতকের ভয়ংকর ভুলের শীর্ষে থাকবে হয়তো।

ওবামা ক্ষমতায় আসার পর মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের পরিসর বেড়েছে বুশের আমলের চেয়ে বেশি। যুদ্ধ চলছে সিরিয়ায়, শুরু হয় ২০১২ সালে। যুদ্ধ চলছে ইয়েমেনে, শুরু হয় ২০১৪ সালে। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে তিউনিশিয়ায়, যুদ্ধ হয়েছে মিশরে। মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের সামরিক ও কূটনৈতিক উত্তেজনা বেড়েছে বহু গুণে।

মধ্যপ্রাচ্যের ক্যান্সার বলে পরিচিত ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের সঙ্গে তাদের জন্ম শত্রুতা। যুক্তরাষ্ট্রের ‘দুই রাষ্ট্র’ নীতি এখনো গ্রহণ করেনি ইসরায়েল। একদিকে ভিজে গলায় ইসরায়েলকে শাসায়, অন্যদিকে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলিদের বসতি স্থাপন সহ্য করে যুক্তরাষ্ট্র। এই দ্বিমুখী নীতি যুক্তরাষ্ট্র পরিহার করেনি। যে কারণে স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই ঝুলে আছে। ফিলিস্তিনকে বেশ কিছু রাষ্ট্র স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিলেও যুক্তরাষ্ট্র এখনো কিছুই বলেনি। ফলে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল নীতি ওবামার আমলের আগে যেমন ছিল, পরেরও তেমন থাকবে। এক্ষেত্রে যদি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহলে আচমকা কোনো পরিবর্তন হয়তো আসতে পারে, তবে তাও অনিশ্চিত। সেই পরিবর্তন যে ইতিবাচক হবে, তাও বলার কোনো কারণ নেই। কারণ ট্রাম্প মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মুসলিম নামেই তার দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী। এমন লোক প্রেসিডেন্ট হলে, তার কাছ থেকে শান্তিপূর্ণ কিছু প্রত্যাশা করা সমীচীন হবে না হয়তো।

এদিকে, ওবামার প্রথম আমলে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন হিলারি। লিবিয়ায় আগ্রাসনে হিলারির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনিই আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ওবামার স্থলাভিসিক্ত হতে যাচ্ছেন। তাহলে তিনি কি লিবিয়া বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবেন? ঘটনাপ্রবাহ বলছে, না, কোনো পরিবর্তন।

মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় সংকট সিরিয়া গৃহযুদ্ধ এবং একে কেন্দ্র করে ছায়া বিশ্বযুদ্ধ। সিরিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া দুই মেরুতে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিচ্ছে সরকারবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠগুলোকে। সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন চায় যুক্তরাষ্ট্র। ‘বাশারকে অবশ্যই ক্ষমতা ছাড়াতে হবে’ যুক্তরাষ্ট্রের এমন একঘুঁয়ে অবস্থানের সুযোগে বেড়ে যাচ্ছে যুদ্ধ ও মৃত্যুর গল্প। হিলারি বা ট্রাম্প যে-ই জিতুন না কেন, তাতে সিরিয়া ইস্যুর শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে বলে মনে হয় না। কারণ, জঙ্গিবাদ এক ফু দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার মতো বিষয় নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আজ পর্যন্ত জঙ্গিজুজু বিশ্বশক্তির প্রধান ইস্যু। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াইয়ে পরাশক্তিগুলো কোনো আপোশ করতে চায় না। যে কারণে, হুট করে মধ্যপ্রাচ্যনীতি থেকে সরে আসাবে না যুক্তরাষ্ট্র- তাতে প্রেসিডেন্ট যেই হোন।

 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ নভেম্বর ২০১৬/রাসেল পারভেজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়