ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

তদবির ছাড়া তকদির মেলে না

হাবিবুর রহমান স্বপন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০২, ৩০ নভেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তদবির ছাড়া তকদির মেলে না

হাবিবুর রহমান স্বপন : ‘না কাঁদলে মা’ও তার শিশুকে দুধ দেয় না’ এমন প্রবাদ বাক্য বিশ্বে প্রচলিত। আবার আমরা এ-ও জানি তদবির ছাড়া তকদির খোলে না। শিশুর কান্না এ ক্ষেত্রে তদবির। তাকে তদবির করে মায়ের কাছ থেকে দুধ নিতে হয়। কথাটি যদিও আংশিক সত্য। কারণ মায়ের চেয়ে দরদী এই পৃথিবীতে কেউ নেই, কথাটি ধ্রুব সত্য।

 

একইভাবে আমরা জানি সকল ধর্মেই তদবির ও তকদিরের কথা আছে। সৃষ্টিকর্তার অনুকম্পা বা ভালবাসা পেতে হলে তার নির্দেশিত পথ অবলম্বনের পাশাপাশি তাকে ভক্তির সাথে স্মরণ করার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। এর নিয়ম-কানুন পথ বা পদ্ধতি বলে দেওয়া আছে সব ধর্মেই। তদবির এবং তকদির দুটি আরবি শব্দ। তবে শব্দ দুটি বাংলা ভাষায় বেশ শক্ত স্থান করে নিয়েছে। তদবির অর্থ চেষ্টা-চরিত্র, ব্যবস্থা, উপায়, উপরোধ, কার্য সহায়ক, বাঞ্ছিত ফল লাভের জন্য সুপারিশ, তোয়াজ প্রভৃতির ব্যবস্থা এবং তকদির অর্থ ভাগ্য। তদবিরের আরো অর্থ আছে যেমন- প্রতিকার, যোগাড়যন্ত্র, তত্ত্বাবধান, দেখাশোনা, পরিচালনা, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন।

 

তদবির সংস্কৃতিতে ভারত উপমহাদেশের মানুষজন বেশ অগ্রসর। যেহেতু ঔপনিবেশিক ভারতে রাজনীতি, অর্থনীতি সংস্কৃতিতে শক্তিই ছিল প্রধান পদ্ধতি। তাতে ন্যায় এবং অন্যায়ের এক বিশাল ফাঁক তৈরি হয়। সেই ফাঁক গলেই ‘তদবির’ সংস্কৃতির জন্ম। এখনো এর ধারাবাহিকতা চলছে। বাংলাদেশে সকল ক্ষেত্রে চলছে তদবির সংস্কৃতি। তদবির ছাড়া কোনো কাজই হয় না। ইতিহাস ঘাটলে স্পষ্ট হবে যে, সুলতানী শাসনের সময় বা তারও আগে থেকে এবং তুঘলক, মোগল থেকে ব্রিটিশ শাসনকাল পর্যন্ত অনেককে তদবির করেই টিকে বা বেঁচে থাকতে হয়েছে।

 

সম্প্রতি অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মো. আব্দুল মান্নান বলেছেন, ‘তদবিরের কারণে বড় ঠেকায় আছি’। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক কর্মসম্পাদন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি আরো বলেন, ‘রাত ১২ টায় ফোন আসে, এমনকি তারা নিজেরাও চলে আসেন। তদবির করতে না চাইলে অনেকেই বলেন, দলের জন্য কাজ করছেন তারা, দেশ স্বাধীন করেছেন তারা...ইত্যাদি ইত্যাদি।’ নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আব্দুল মান্নান বলেন, ‘দেখা গেছে কোনো ব্যাংকের এমডি বা চেয়ারম্যানের ফোন নম্বর আমার কাছে নেই। তদবিরকারীরাই সেই নম্বর নিয়ে আসে।’

 

রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এর আগে বলেছেন, ‘রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে।’ যখন থেকে তদবির শক্তিশালী হতে শুরু করে তখন থেকেই রাজনীতি ক্রমশ ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যেতে থাকে। কারণ এই রাজনীতি ব্যবসাটি বেশ লাভজনক। এখানে বিনিয়োগ করলে শত-সহস্র গুণ লাভ হয়। কখনো কখনো লাভের পরিমাণ লাখ-কোটি গুণও হয়। ন্যায়ের শাসন যখন রোহিত হয়, তখনই তদবির বাণিজ্য শুরু হয়। এখন ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি যারা অন্য পেশার মানুষ রাজনীতি করছেন তারাও টিকে থাকার জন্য বাধ্য হয়েই তদবির বাণিজ্য বা তদবির সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন।

 

তদবির কেন ও কী কারণে হয় বা কার কাছে হয়? যখন কোনো কিছু নিয়ম মাফিক হয় না বা নিয়ম মেনে হয় না, কিংবা অনিয়মই যখন নিয়মে পরিণত হয় তখন ছুটতে হয় অনিয়মের পেছনে। নিজ স্বার্থে দৌঁড়াতে হয় অনিয়মের পেছনে। আর এ জন্য অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করতে হয়। এই পন্থার নামই হচ্ছে তদবির বা চেষ্টা-চরিত্র করা। তদবির না করলে তকদির বা ভাগ্য ভাল হবে না। কোনো কিছুর ভালো সমাধান না হলে ভাগ্য যেহেতু খোলে না, তাই সমাধানের জন্য চেষ্টা চলে ভিন্ন পন্থায়। তদবিরের জোরে, ভাগ্য ফেরে। নিয়মকে সরিয়ে দিয়ে অনিয়মের রথে চড়ে যিনি কাজ হাসিল করতে পারেন তিনিই ক্ষমতাবান। সেই ক্ষমতাবানের কাছেই মানুষজন ছোটে। রাজনীতিবিদরাই ক্ষমতাবান, তাই তাদের কাছে লোকজন যায়। কখনো অর্থের বলে, কখনো রাজনৈতিক পরিচয়ে তদবির সফলতা পায়।

 

শিশু না কাঁদলেও মা দুধ দেয়। হ্যাঁ, সংসারের নানা কাজে ব্যস্ততার কারণে হয়তো বিলম্ব হয় তখনই শিশু কাঁদে দুধের জন্য। এর মানে এই নয় যে, মা শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর বা দায়িত্বহীন। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে রোদ-বৃষ্টি, আলো-বাতাস ও পানি দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে মহান সৃষ্টিকর্তা ছোট-বড়, ধনী-গরিব বা কোনো ধর্মের বিচার করেন না। সকলের জন্যই বরাদ্দ এসব। মানুষে মানুষে বৈষম্য চিরকাল আছে। কারণ স্বার্থ। এটাই তকদির বা ভাগ্য বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রয়াস সর্ব যুগে সর্বকালে। মনুষ্য সৃষ্ট সমস্যা সমাধান করতে হয় তদবির করে।

 

স্বাভাবিক গতিতে বা নিয়মে যখন কাজ হয় না তখনই তদবির করতে হয়। চাকরি পাওয়ার জন্য, পদোন্নতির জন্য, বদলির জন্য এমনকি চাকরি শেষে পেনশন পাওয়ার জন্যও তদবির করতে হয়। চাকরি পেতে মামা-চাচা, টাকা বা ঘুষ, ক্ষমতার দাপট কাজে লাগে। একইভাবে পদোন্নতির জন্য এবং ভাল স্টেশনে বা সুবিধাজনক স্থানে বদলির জন্য দরকার হয় ক্ষমতার দাপট-প্রভাব। পেনশন পেতে ঘুষ দিতে হয়- এ জন্য দরকার টাকার।

 

এবার তদবিরের কিছু বর্ণনা উল্লেখ করছি। আমার এক আত্মীয় এলজিইডি’তে চাকরি করেন। তার বৃদ্ধা অসুস্থ মাতা এবং স্ত্রী থাকেন বাড়িতে। তার পোস্টিং একটি পার্বত্য জেলায়। সেখানে প্রায় চার বছর কর্মরত। বদলি হয়ে উত্তরাঞ্চলের যে কোনো জেলায় আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করে কর্তৃপক্ষের কাছে বরাবর আবেদন করেন। কিন্তু ফলাফল শূণ্য। এলজিইডির ঢাকা অফিসের এক কেরানি তার কাছে ঘুষ চেয়েছেন। তিনি ঘুষ দিতে অস্বীকার করায় তার বদলির সুযোগ মেলেনি। অথচ বছরের পর বছর একেক জন নির্বাহী প্রকৌশলী একটি জেলায় কর্মরত আছেন। সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়াররা প্রায় এক দশক ধরে একই জেলায় ঘুরে ফিরে আশপাশের উপজেলায় আছেন বহাল তবিয়তে। পাবনার নির্বাহী প্রকৌশলী সম্প্রতি ছয় বছর পর ঢাকায় বদলি হয়েছেন। এলজিইডি ডিপার্টমেন্টে বদলি বাণিজ্য চলে। এটি ওপেন সিক্রেট। দালাল ধরে বদলির তদবির করতে হয়। একই অবস্থা সড়ক ও জনপথ ডিপার্টমেন্টে। বদলির সবচেয়ে বড় তদবির হয় জেলা ও সাব রেজিস্ট্রারদের ক্ষেত্রে। আমার এক বন্ধু জেলা রেজিস্ট্রার, তার কাছেই শুনেছি- সাভার, ধামরাই কিংবা নারায়ণগঞ্জে বদলির জন্য একজন সাব রেজিস্ট্রারকে কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়! আবার এটাও সে বললো, ঘুষ দেওয়ার জন্য প্রোপার চ্যানেল ধরতে হয়। 

 

একজন কলেজ শিক্ষক দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ‘শিক্ষকতা মহান পেশা জেনে অন্য চাকরিতে না গিয়ে কলেজে চাকরি নিলাম। হায়রে কপাল, এখানেও দেখি মহা কেলেঙ্কারি অবস্থা! প্রিন্সিপাল হওয়ার জন্য শিক্ষকরা মন্ত্রণালয়ে তদবির করেন। ঘুষ দিয়ে প্রিন্সিপাল হন। বলতেও লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে।’ তিনি আরো বললেন, ‘ওই সব প্রিন্সিপাল দুর্নীতি করে কলেজের বারোটা বাজিয়ে ছাড়েন।’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে চলে তদবির। ভাল রেজাল্ট করেও চাকরি হয় না। তদবিরের জোরে বা ডোনেশনের কারণে চাকরি হয় অযোগ্যদের।

 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের ক্ষমতা যে, মন্ত্রীর চেয়ে কোনো অংশে কম নয় তার প্রমাণও মেলে! সচিবের নিকটাত্মীয় বুয়েটের (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষক। তাকে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একেই বলে খাঁটি তদবির। বছরের পর বছর ধরে একজন চিকিৎসক রাজধানীর নামী-দামি হাসপাতালে কর্মরত আছেন। অথচ মফস্বলের হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে বদলি করা হয়। তিন মাসের মধ্যেই তিনি তদবিরের জোরে ডেপুটেশনে চলে যান ঢাকার একটি হাসপাতালে। তিনি চাকরি করেন পাবনায় অথচ কর্মস্থল ঢাকায়!

 

পুলিশ প্রশাসনেও এমন উদাহরণ প্রচুর। ‘ভাল থানা’ অথবা ফাঁড়িতে পোস্টিংয়ের জন্য তদবির চলে যা ওপেন সিক্রেট। ‘ভাল’ বলতে পুলিশের ভাষায় যেখানে উপরি আয় বেশি। এর জন্য তদবির চলে ওপর মহলে। এসব তদবির করার জন্য দালাল আছে। দালাল কারা? ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিক অথবা রাজনীতিকদের আত্মীয়-স্বজন। এগুলো সর্বজনবিদিত। এ ব্যাপারে একটি মজার ঘটনা বলি, আমার এলাকার এক মন্ত্রীর আত্মীয়র নাম এবং আমার নাম এক। রংপুর থেকে একজন ওসি ফোন করেছেন আমার টিএন্ডটি ফোন নম্বরে। বলছেন ‘ভাই তা হলে আমি কি আগামী পরশু বৃহস্পতিবার টাকা নিয়ে চলে আসবো?’ আমি পাল্টা প্রশ্ন করার আগেই তিনি আবারও বললেন, ‘আপনার সাথে যেভাবে কথা হয়েছে, সেভাবেই আমি প্রস্তুতি নিয়ে আসছি। হাকিমপুর (হিলি) অথবা ফুলবাড়িতে হলেই ভাল হয়।’ এবার আমি উত্তরে বললাম, ‘ভাই আপনি বোধকরি ভুল ব্যক্তিকে ফোন করেছেন।’ তিনি বললেন, ‘কেন আপনি স্বপন ভাই না?’ আমি বললাম ‘হ্যাঁ আমার নাম স্বপন। তবে আপনি যে স্বপনকে খুঁজছেন আমি সে স্বপন না।’

 

আমার বুঝতে বাকি রইলো না, এই স্বপন বা এই তদবিরবাজটি কে? কিছু কিছু মন্ত্রীর  ব্যক্তিগত সহকারী, শ্যালক, ভাই, ভাতিজা, ভাগ্নেরা এ ধরনের তদবির করে বেশ টাকা কামিয়ে নেন। তদবিরের জোরে বহু দুর্বৃত্ত তাদের অপকর্ম থেকে রেহাই পায় এমন নমুনাও আছে। আইনের ফাঁক গলিয়ে পার পেয়ে যায় অনেকেই। ন্যায়-অন্যায়ের ধার ধারেন না তদবিরবাজরা। তার নিজের কাজ হাসিল হলেই হলো। তাতে অন্যের বা দেশের কি ক্ষতি হলো সেটি নিয়ে ভাবনা নেই তার।

 

ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা ভাল পোস্টিং পেতে নিকটজন বড় আমলা, রাজনৈতিক নেতা-কিংবা তার বন্ধুর শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। আবার আঞ্চলিকতার টানেও ভাল পোস্টিং মেলে। এ ব্যাপারে ভাল উদাহরণ দিয়েছেন একজন প্রবীণ ব্যাংক কর্মকর্তা। তার মতে ড. আতিউর রহমান অতি সাধারণ পরিবার থেকে এসেও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের মর্যাদাপূর্ণ পদ পেয়েছেন। এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। সেটি সম্ভব হয়েছে শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কারণে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগ্যতম ব্যক্তিকে চিনতে পেরেছেন বলেই ওই পদে তিনি আসীন হতে পেরেছেন। অন্যথায় কোনো মন্ত্রী বা সচিবের ভাই-ব্রাদার পদটি দখল করে নিতো।

 

তদবির এখন রীতিমতো বাণিজ্য। এই বাণিজ্য করতে পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয় না। বিনা পুঁজিতে এটি অতি লাভজনক ব্যবসা। আমার চেনা-জানা মতে, কোনো প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকরি করেন না এমন অনেক দালাল আছে যারা শুধু তদবির বাণিজ্য করে ঢাকায় শান-শওকতে থাকেন। যেহেতু লাভজনক এই ব্যবসাটি যুগের পর যুগ ধরে চলছে, তাই আমি মনে করি এটি চলতেই থাকবে। তবে যদি সরকার আন্তরিক বা সতর্ক হয় তা হলে সাধারণ পরিবারের সদস্যরা মর্যাদার সাথে চাকরি করতে পারবেন। বদলি-পদোন্নতি-পেনশন সব কিছু যদি ডিজিটালাইজড করা যায় তা হলে কোনো চাকুরে বছরের পর বছর ভাল স্টেশনে পোস্টিং নিয়ে থাকতে পারবেন না। আবার বঞ্চিতও হবেন না একজন সাধারণ পরিবারের  সন্তান, যার তদবিরের লোক নেই।

 

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ ডিসেম্বর ২০১৫/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়