ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

তাইওয়ানের সাতকাহন : ৪র্থ পর্ব

মাসুদুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৫, ২৩ মে ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তাইওয়ানের সাতকাহন : ৪র্থ পর্ব

মাসুদুজ্জামান : কেবল ভোর হয়েছে তখন। তীব্র বেগে বাস ছুটে চলেছে শহরের কেন্দ্রে। কী পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। ঘুম থেকে এরই মধ্যে জেগে উঠেছে শহরটা।

 

ডিসকভারি বে আর পার্ক আইল্যান্ডকে অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম কাউলুনে। কাউলুনে যখন পৌঁছাই তখন রীতিমতো সরগরম পুরো এলাকা। এখানকারই সবচেয়ে পুরানো বহুতল হোটেল ভবনের একটা ছোট্ট রুমে এসে উঠলাম আমি।

 

আমার হোটেল মালিক এক প্রৌঢ়া চীনা মহিলা। চারদিকে দেখছি অনেক ভারতীয় মুখ। এই ভবনটিতে বিভিন্ন মালিকের আছে অসংখ্য ছোট ছোট হোটেল। সস্তায় থাকবার ব্যবস্থা। যারা এই হোটেলগুলো চালায়, তাদের বেশিরভাগই ভারতীয়। কয়েকজন শিখকেও দেখলাম হোটেল ব্যবসা করছে। পুরো হোটেলটাকেই একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, ভারতীয়দের দ্বারা ঠাসা। মনে হলো বিমানে যেসব বাংলাদেশি যাত্রীকে দেখেছিলাম, তাদের কেউ কেউ এইসব হোটেলে উঠেছে।

 

আমার এখানে থাকবার একটাই উদ্দেশ্য, অনলাইনে দেখেছিলাম, তাইওয়ানের ভিসা বা তাইওয়ান সরকারের অন্যান্য কাজ করে দেয় যে প্রতিষ্ঠানটি, সেই প্রতিষ্ঠানের অবস্থান কাউলুনের কেন্দ্রে একটা বাণিজ্যিক এলাকায়। যাতায়াতের সুবিধা হবে বলে আমি এই কাউলুনেই উঠেছিলাম।

 

হোটেলের চারপাশে অনেকগুলো অভিজাত শপিংমল। পায়ে হাঁটার দূরত্বে হংকংয়ের সেই বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া পোতাশ্রয়। এর এপার-ওপার প্রায় ৪০টির মতো দৃষ্টিনন্দন উঁচু ভবন আছে। দুই পারের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে চলাচল করে স্টার নামের কয়েকটা ফেরি। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হচ্ছে এর সেই রাত্রিকালীন লেজার রশ্বির আলোর খেলা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কয়েকটা উঁচু ভবন থেকে এই রশ্মির প্রদর্শণী হয়।

 

পারে বসবারও দারুণ ব্যবস্থা আছে। চারপাশ থেকে নিচু স্বরে মাইক্রোফোন থেকে ভেসে আসে ধ্রুপদী সংগীতের সুর। সামনে সমুদ্র। ওই যাত্রায় যে পাঁচ দিন আমি হংকংয়ে ছিলাম, সেই পাঁচদিনই- হয় দিনের বেলা কিংবা সন্ধ্যায় ওখানে বেড়াতে যেতাম। বিশেষ করে রাতের খাবারের পর পায়ে হেঁটে ওখানে বেড়াতে যেতে বেশ ভালো লাগতো।

 

একবার ফেরিতে করে অন্যপারের একটা রেস্তোরাঁতে গিয়ে খেয়ে এসেছিলাম চীনা রাজহাঁসের মাংস। রেস্তোরাঁর সামনেই বিরাট বিরাট রাজহাঁস অর্ধসেদ্ধ করে ঝুলিয়ে রাখা হয় পর্যটকদের আকর্ষণ করবার জন্য। রেস্তোরাঁটি এই মাংসের জন্যই বিখ্যাত। অন্য কোনো খাবার তারা বিক্রি করে না।

 

 

প্রথম দিনই বিমানবন্দরে নেমে এবং শহরে ঢোকার পর আরেকটা জিনিস আমাকে অবাক করে। রাস্তাঘাটে কোথায় কোনো নোংরা নেই, একটুকরো কাগজও না। সরকারি নির্দেশনা আছে এজন্যে নয়, কোনা মানুষই কোনো নোংরা- তা সে কাগজের টুকরাই হোক কিংবা সিগারেটের পরিত্যাক্ত অংশ- কেউ কোথাও কিছু ফেলে নোংরা করে না। পরে যখন তাইওয়ান বা কোরিয়ায় গিয়েছি, সেখানে দেখেছি পরিচ্ছন্নতার এই একই ছবি। আমি জানি বাংলাদেশের যে-সব মানুষ বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, সবারই এই অভিজ্ঞতা হয়। শুধু নাগরিক সচেতনতাই যে একটা শহর বা সারা দেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে পারে, এ হচ্ছে তারই দৃষ্টান্ত।

 

একে ছোট্ট হোটেল কক্ষ তার ওপর আবার প্রথম রাত। ফলে আমার তেমন ঘুম হলো না। সকালে উঠেই মনে হলো প্রফেসর চ্যান তো আমাকে হংকং পৌঁছেই ইমেইলে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন। কিন্তু কোথায় পাই সাইবার ক্যাফে? একটু খোঁজাখুজি করতেই দেখি হোটেলের নিচে করিডরের মতো একটা জায়গায় ছোট্ট একটা সাইবার ক্যাফে। সাত সকালেই খোলা।

 

ঢুকে গেলাম সেখানে। তাকিয়ে দেখি দশ-বারোটা ডেস্কটপের সামনে বসে আছে অনেকেই, এদের বেশিরভাগই শ্বেতাঙ্গ। দুএকজন এশীয়। ওখান থেকেই চ্যানকে আমার হংকং পৌঁছার খবরটা মেইল করে জানিয়ে দিলাম।

 

এবার যেতে হবে ভিসাকেন্দ্রে। একটু হেঁটেই পেয়ে গেলাম পাতাল রেল। এই রেল কোথাও কোথাও মাটির ওপর দিয়ে চলে, কোথাও মাটির তলায় ঢুকে চলতে থাকে। কলকাতার পরে এই আমার দ্বিতীয় পাতাল রেল দেখা।

 

পাতাল রেলে উঠেই দেখি অসংখ্য যাত্রী। একেবারে মুরগীর খোপের মতো গাদাগাদি করে চলেছে মানুষ। এদের সবাই যে কর্মক্ষেত্রে চলেছে, কিংবা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সে তাদের দেখলেই বোঝা যায়। পিক আওয়ারের এরকমি অবস্থা। কিন্তু কয়েক কিলোমিটার পথ আমি ৭ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। নির্দেশিত ঠিকানা অনুসারে ভিসাকেন্দ্রটি খুঁজে পেতে অসুবিধা হলো না। কিন্তু এজন্যে আমাকে দুই তিনজনকে ঠিকানাটা জিজ্ঞাসা করতে হয়েছে, কোথায় এর অবস্থান। একটা বহুতল বাণিজ্যিক ভবনের সাততলার দু’তিনটি কক্ষ নিয়ে তাইওয়ানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। দূতাবাসের যে ছবি আমাদের আছে, বড়োসরো একটা কম্পাউন্ড, প্রতিপদে গার্ড আর অ্যাটেনডান্ট, সে-সবের কোনো কিছুই এখানে নেই। থাকবার কথাও নয়। এ যেন একটা সার্ভিস সেন্টার। শুধু ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাই এদের কাজ। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকলে ভিসা দিয়ে দেয়।

 

এই সার্ভিস মূলত বিদেশিদের জন্য আর ভ্রমণপিপাসু হংকংবাসীদের জন্য। চীনাদের জন্য নয়। উপনিবেশ হিসেবে শাসিত হলেও এক সময় হংকংয়ের মর্যাদা ছিল একটা উন্নত দেশ হিসেবেই। চীনের শাসনাধীনে চলে এলেও এখনও এই মর্যাদা সে ভোগ করে। ফলে হংকংয়ের যারা নাগরিক, তারা আগের মতোই সর্বত্র বিশেষ সুবিধা পায়। তাইওয়ানে ভ্রমণে যেতেও তাদের বাধা নেই। কিন্তু চীনারা এক সহজে তাইওয়ান যেতে পারে না। এ যেন এক ওয়ানওয়ে সার্ভিস। সাধারণ তাইওয়ানিরা চীনে আসতে পারে, কিন্তু সাধারণ চীনারা বৈবাহিক কারণ ছাড়া তাইওয়ান ভ্রমণ করতে পারে না। এসব তথ্যের সবই আমি জেনেছিলাম ওই ভিসাকেন্দ্র থেকে। কিন্তু এতো গেল চীনাদের কথা। আমাকেও ভিসা পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হলো।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ মে ২০১৬/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়