ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

তারপরও দীপনকে স্মরণ করা যেত : জলি

অলাত এহ্সান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তারপরও দীপনকে স্মরণ করা যেত : জলি

ডা. রাজিয়া রহমান জলি

একুশে গ্রন্থমেলায় নিহত প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের জাগৃতি প্রকাশনী আগলে আছেন তাঁর স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান জলি। মেলার মাত্র তিন মাস আগে (৩১ অক্টোবর’১৫) নিজ কার্যালয়ে খুন হন দীপন। সেই শোক কাটিয়ে ওঠা ও মেলায় অংশগ্রহণ করা তাঁর জন্য ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। জাগৃতির স্টলটিও সাজানো হয়েছে দীপনের স্মৃতি ঘিরে। সাদাকালো রঙা স্টলের ওপর দুই পাশের ব্যানার ও ভেতরে রয়েছে দীপনের ছবি। স্টলের এক কোণায় রাখা আছে নিহত হওয়ার মুহূর্তে রক্তমাখা প্রুফকাটা পাণ্ডুলিপি, কয়েকটি কলমদানি, চশমা আর রক্তে দাগ বসা চটের কিছু অংশ।

 

বিক্রয়কর্মীদের বুকে স্টিলের কালো ব্যাচে দীপনেরই ছবি। এ ছাড়া বই মেলায় কোথাও দীপনকে স্মরণ করে কিছুই করা হয়নি। অথচ শুধুমাত্র বই প্রকাশের কারণেই উগ্রবাদীদের চাপাতির কোপে নিহত হয়েছেন প্রকাশক দীপন। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠে মেলায় জাগৃতি প্রকাশনীর অংশগ্রহণ, তাঁদের কর্মপরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে  ডা. রাজিয়া রহমানের সঙ্গে গল্পকার অলাত এহ্সানের এই কথোপকথন।

 

অলাত এহ্সান : গত বছরের বইমেলার সঙ্গে এ বছরের পার্থক্য অন্তত আপনার এবং জাগৃতির পাঠকদের জন্যও বেশ দৃশ্যমান এবং বেদনাময়। গত বছর মেলার গেটে খুন হলেন লেখক অভিজিৎ রায়। তার আটমাস পর অভিজিতের বই প্রকাশক দীপনও খুন হলেন। আজ তারা কেউ নেই, আপনারা আছেন। তাকে কীভাবে উপস্থাপন করছেন?

 

ডা. রাজিয়া রহমান জলি : তাঁকে স্মরণ করে প্রত্যক্ষভাবে আমাদের যতটুকু করা যায়, ততটুকুই করছি। আমাদের স্টলে, দেখেন, সবখানেই ওঁর স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। নতুন যে বইগুলি বেরুচ্ছে ওঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়া থাকছে।

 

অলাত এহ্সান : তাঁকে নিয়ে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল।

 

ডা. রাজিয়া রহমান জলি : স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনার কাজ করছি, সেটা শেষ হলে প্রকাশ হবে।

 

অলাত এহ্সান : ওটা কি এই মেলাতেই আসবে? কে করছে সম্পাদনা?

 

ডা. রাজিয়া রহমান জলি : হ্যাঁ, এই মেলাতেই আসবে। সম্পাদনা করছেন গোলাম মুর্তজা।

 

অলাত এহ্সান : বইমেলা নিয়ে প্রকাশকের প্রস্তুতি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এবারের মেলা নিয়েও নিশ্চয়ই দীপন ভাইয়ের প্রস্তুতি ছিল। শেষ মুহূর্তে ঘটলো দুর্ঘটনা। এরপর আপনারা প্রস্তুতিটা কীভাবে সামলে নিলেন?

 

ডা. রাজিয়া রহমান জলি : খুব কষ্ট হয়েছে। আমাদের প্রথম কষ্টটা ছিল সেই ভীষণতম শোক কাটিয়ে ওঠা, তারপর কাজ শুরু করা। আসলে একজনের কাজ কি আরেকজন সেভাবে পারে? তাঁর অফিস বলেন, তাঁর পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার কাজ বলেন- সব গুছিয়ে করাটা খুব কষ্টসাধ্য ছিল। একটা জেদের জায়গা ছিল- ওঁর স্বপ্নটাকে বাঁচাবো। মানে একশটা বইয়ের কাজ ধরেছিল দীপন, এইটুকু আমি জানি। যেহেতু আমার কাছে ওই পাণ্ডুলিপিগুলো পাওয়া এবং এতগুলো কাজ করা অসম্ভব একটা ব্যাপার তাই যতটুকু আমার সাধ্যে কুলিয়েছে করেছি। আসলে ১৫ থেকে ২০টার মতো বই নিয়ে বইমেলায় অংশ নিয়েছি।

 

অলাত এহ্সান : দীপন ভাইয়ে মৃত্যু শুধুমাত্র যে একজন প্রকাশকের মৃত্যু, ব্যাপারটা তা নয়। পুরো প্রকাশনা শিল্পর ওপরই একটা ছাপ পড়ে যায়। সেদিক দিয়ে পুরো বইমেলার ওপরই একটা ছাপ পরার কথা। আপনি সেই ছাপ কতটা দেখছেন?

 

ডা. রাজিয়া রহমান জলি : না, আমি তার বিন্দুমাত্র কিছু দেখছি না। মনে হচ্ছে...

 

অলাত এহ্সান : মানে এবার রাজনৈতিক সহিংসতা নেই বলে ভালো মেলা হবে, এ রকম একটা উৎসবের আমেজ...

 

ডা. রাজিয়া রহমান জলি : সেটা তো ভালো। গত দু’বছর বইমেলায় অনেক প্রতিকূল পরিবেশ, অনেক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে অংশ নিতে হয়েছে। একটা শঙ্কার মধ্যে থাকতাম, ভালো লোক সমাগম হতো না, সেগুলি আমাদের জন্য ব্যবসায়িক দিক থেকে চিন্তা করলে ক্ষতির কারণ ছিল। এ বছর রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে, মানুষ আসছে, মানুষের সমাগম এই দুই-তিনদিনে আমরা অনেকখানি দেখতে পাচ্ছি। এগুলো ইতিবাচক দিক। কিন্তু দীপনকে স্মরণের জায়গা থেকে আমি বলবো, প্রকাশনা সংস্থা যারা এবার অংশ নিয়েছে, প্রতিবছরই নেয়; তো তাদের পক্ষ থেকে অনেক কিছুই করার ছিল।

 

করার ছিল এ জন্য যে, এই ঘটনা একটা প্রকাশনা শিল্পের ওপরে খড়গ নেমে আসা। সেই জায়গাটি থেকে তারা সবাই মিলে একটা প্রতিবাদ করতেন। কিংবা প্রতিবাদ যদি নাও বলি, দীপনকে মনে করে একটা কিছু করা যেত-একটা লেখক চত্বর হোক, দীপন কর্নার হোক, প্রকাশকদের একটা আড্ডার কর্নার থাকতে পারতো যেখানে দীপনকে নিয়ে কথা হতো। তো প্রত্যেকটা স্টল আলো ঝলমল করছে। আমি যেমন চেষ্টা করেছি দীপনকে স্মরণ করে স্টল সাজাতে, সেখানে আমি বলবো না প্রতিটা স্টল সাদাকালো হয়ে যাবে আমার মতো, কিন্তু তারপরও কোনো না কোনো ছাপ রেখে দীপনকে স্মরণ করা যেত।

 

অলাত এহ্সান : আসলে আমাদের দেশে বই বিক্রেতার যতটা আধিক্য আছে, তার চেয়ে প্রকাশক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বা প্রকাশনা বিষয়টি শিল্প হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বেশ ঘাটতি আছে। সেক্ষেত্রে দীপন ভাইয়ে কাজটা আমরা জানতাম যে, তিনি ভালো সম্পাদনার মধ্য দিয়ে মানসম্মত বই প্রকাশে ও লেখককে দিয়ে লিখিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেন...

 

ডা. রাজিয়া রহমান জলি : হ্যাঁ, হ্যাঁ, সত্যিকারের একটা প্রগতিশীল ও সৃজনশীল প্রকাশক ছিল ফয়সল আরেফিন দীপন। তাঁর কাছ থেকে মানুষ অনেক কিছু শিখেছে। যতটুকু আরাধ্য কাজ ও করে যেতে পেরেছে সেটুকু অনুসরণ করলেও অনেক কিছু শেখা যাবে।

 

অলাত এহ্সান : সবচেয়ে বড় যেটা, আপনি এই প্রকাশনাটা তো এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন।
ডা. রাজিয়া রহমান জলি : হ্যাঁ, আর কেউ তো এটার হাল ধরবার নেই এ মুহূর্তে।

 

অলাত এহ্সান : কিন্তু একটা ভয় ছিল, যেমন মেলা শুরুর আগে দেখলাম আক্রান্ত আরেক প্রকাশক ‘শুদ্ধস্বর’র আহমেদুর রশিদ টুটুল এক সাক্ষাৎকারে বলছেন,  তিনি বই প্রকাশ করেতে গিয়ে প্রেসের কাজ করানোর মতো লোক পাচ্ছেন না, যারা আসছে তাদের নিরাপত্তা দিতে পারছেন না বলেই কাজ করানো কষ্ট হচ্ছে। আপনারা সেরকম কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন কি না?
ডা. রাজিয়া রহমান জলি : না, আমি বরং দেখেছি যে ভালবাসার জায়গা থেকে যেখানেই দীপনের নাম করেছি সেখানে সার্বিক সহযোগিতা পেয়েছি। কেউ বলেনি যে, ভাবি, আপনার কাজ আমি করবো না; আমার ভয় আছে অথবা আমি অন্যকোনো কিছু আশঙ্কা করছি। নট দ্যাট। সবাই খুব সাহায্য করেছে।

 

অলাত এহ্সান : খুব সহজ বিষয় হচ্ছে যে, একবার যে আক্রান্ত হয় সে মুটোমুটি গণচিহ্নিত হয়ে যায়। কখনও এমন মনে হয়েছে কিনা আপনারা নিরপত্তাহীনতায় ভুগছেন বা আপনাদের আলাদাভাবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা মেলা কর্তৃপক্ষ করতে পারতো?

 

ডা. রাজিয়া রহমান জলি : না, আমি এখনো ওই জাগয়া নিয়ে চিন্তা করার মতো অবস্থানে নাই। এত অল্প সময়ে আমার বড় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল যে মেলায় অংশ নেয়া, আমি সেটুকু করতে পেরে অনেক আত্মতৃপ্তি লাভ করছি। সুতরাং নিরাপত্তার ব্যাপারটা যারা নীতিনির্ধারকের জায়গায় আছেন, যারা আমাদের অভিভাবকের জায়গায় আছেন তারা দেখুন। আমি আশা করি যে সবার নিরাপত্তাই নিশ্চিত করা হবে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ ফেব্রুয়ারি২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়