‘দাবাড়ু, না বৈজ্ঞানিক, না সাহিত্যিক?’
তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম
ড. কাজী মোতাহার হোসেন
তাপস রায়
১৯২৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তবুদ্ধি-চর্চার সংগঠন ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’। সংগঠনটি এক সময় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে উঠেছিল। সমাজে রেখেছিল স্মরণীয় অবদান। প্রতিষ্ঠানের বীজমন্ত্র ছিল, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। সংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী, প্রগতিশীল, কল্যাণমুখী সমাজ গঠনই ছিল এর লক্ষ্য। সাহিত্য-সমাজের এক বার্ষিক অধিবেশনের কার্যবিবরণী লিখতে গিয়ে কাজী মোতাহার হোসেন মুক্তবুদ্ধি চর্চা সম্পর্কে উল্লেখ করেন :
‘আমরা চক্ষু বুঁজিয়া পরের কথা শুনিতে চাই না, বা শুনিয়াই মানিয়া লইতে চই না; আমরা চাই চোখ মেলিয়া দেখিতে সত্যকে জীবনে প্রকৃতভাবে অনুভব করিতে। আমরা কল্পনা ও ভক্তির মোহ-আবরণে সত্যকে ঢাকিয়া রাখিতে চাই না। আমরা চাই জ্ঞান-শিখা দ্বারা অসার সংস্কারকে ভস্মীভূত করিতে এবং সনাতন সত্যকে কুহেলিকা মুক্ত করিয়া ভাস্বর ও দীপ্তিমান করিতে।’
ড. কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন মুক্তবুদ্ধি-চর্চা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তার পৈতৃক বাড়ি ফরিদপুর জেলার বাগমারা গ্রামে। জন্ম ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই। সে হিসেবে আজ তার ১১৮তম জন্মদিন। ছাত্রজীবনে তিনি অসাধারণ মেধার স্বাক্ষর রাখেন। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি পর্যন্ত এর পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির সূচনালগ্ন থেকেই তিনি সেখানে ডেমনস্ট্রেটর নিযুক্ত হন। এর মধ্য দিয়েই শুরু হয় তার কর্মজীবন। পরে অবশ্য এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি গণিত ও পরিসংখ্যান পড়িয়েছেন। তার শিক্ষকতা জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো কোনো পদ্ধতিগত শিক্ষা ছাড়া সম্পূর্ণ নিজ চেষ্টায় তিনি পরিসংখ্যান নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি এ ক্ষেত্রে এক নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেন যা ‘হোসেনের শৃঙ্খল নিয়ম’ নামে আন্তর্জাতিক পরিচিতি অর্জন করে। এই মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি ১৯৫০ সালে পরিসংখ্যানে পিএইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেন।
কাজী মোতাহার হোসেন একাধারে পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, প্রবন্ধকার এবং মুক্তচিন্তার অগ্রপথিক। তার এক স্মৃতিচর্চায় নিজের যথার্থ পরিচয় কোনটি সে বিষয়ে বলতে গিয়ে কিছুটা কৌতুক করে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আমার সম্বন্ধে কথা উঠেছে, আমি দাবাড়ু, না বৈজ্ঞানিক, না সাহিত্যিক?’
এই প্রশ্নের জবাবে অনায়াসে বলা যায়, মোতাহার হোসেনের সব ক’টি পরিচয়েই বিখ্যাত ও বিশিষ্ট। এইসব গুণের যে কোনো একটিকে অবলম্বন করেই তিনি জাতীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে পারতেন। আসলে তিনি ছিলেন বিচিত্র রসের রসিক। সঙ্গীতজ্ঞ, দাবাবিশারদ, ক্রীড়াবিদ হিসেবেও তার পরিচিতি ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে এ সব ক্ষেত্রে সক্রিয় বিচরণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
গতানুগতিক চিন্তাধারায় অভ্যস্ত প্রগতিবিমুখ মানসিকতার বিরুদ্ধে মুসলিম সাহিত্য সমাজ তাদের মতাদর্শ প্রকাশের জন্য ‘শিখা’ বের করেছিল। রক্ষণশীলতা, কুসংস্কার, গোঁড়ামি ইত্যাদি দূর করার জন্য এই সাহিত্যপত্রটি সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছে। ১৩৩৩-১৩৩৮ সময়সীমার মধ্যে মোট পাঁচটি সংখ্যা বের হয়েছিল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যা সম্পাদনা করেছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। সে সময় মুসলিম সমাজে মাতৃভাষা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু কাজী মোতাহার হোসেন সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, মুক্ত চেতনার সুষ্ঠু প্রকাশ একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই সম্ভব। এ চেতনা কাজী মোতাহার হোসেন আজীবন লালন করেছেন। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু নয়- বাংলার পক্ষে মত দিয়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন : ‘বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু মুসলমানের ওপর রাষ্ট্রভাষা রূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশিদিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে।’
বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও কাজী মোতাহার হোসেনের শিল্প ও সাহিত্যের ধারণা ছিল স্বচ্ছ। তিনি লিখেছেন : ‘সাহিত্য রস উপভোগ করিতে করিতে পাঠক যখন তন্ময়, ঠিক সেই সময়ই সাহিত্যের বিচিত্র ঘটনাবলী নিষিক্ত করিয়া স্রষ্টার মনের সহিত পাঠকের মনের যে বিচিত্র যোগ স্থাপিত হয়, তাহাই সাহিত্যের মূল বস্তু। এইরূপ করিয়া লেখকের ব্যক্তিত্ব পাঠকের চিত্তে সংক্রমিত হয়।’ এ কারণেই তার দর্শন ও বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধগুলোও সাহিত্য রস থেকে বঞ্চিত হয়নি। তার প্রবন্ধে সামাজিক অন্ধকার এবং এর কারণ ও প্রতিকার নির্দেশিত হয়েছে।
তিনি লিখেছেন : ‘মুসলমানদের যে গৃহ নেই তার একটা কারণ, আনন্দের উপকরণের অভাব। মুসলমানগণ গাইবে না, ছবি আঁকবে না, এক কথায় মনোরঞ্জনের চালিতকলার কোনও সংশ্রবেই থাকবে না। মুসলমান পুরুষেরা কেবল কাজ করবে, আর ঘর শাসন করবে; মেয়েরা কেবল রাঁধবে, বাড়বে, আর বসে বসে স্বামীর পা টিপে দিবে। ... মুসলমান সমাজে পুরুষ আছে, স্ত্রী নেই; আকাঙ্ক্ষা আছে, উদ্যম নেই; ব্যক্তি আছে, ব্যক্তিত্ব নেই। এ সমাজে পেট আছে হাত নেই; পা আছে গতি নেই; দেহ আছে, মাথা নেই; এক কথায় আমাদের সমাজ আছে, সামাজিকতা নেই।’
সে সময় এমন সাহসী মন্তব্য ড. কাজী মোতাহার হোসেনের পক্ষেই করা সম্ভব। তার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে সঞ্চয়ন (প্রবন্ধ সংকলন), নজরুল কাব্য পরিচিতি, , সেই পথ লক্ষ্য করে, গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস, আলোক বিজ্ঞান, নির্বাচিত প্রবন্ধ, প্লেটোর সিম্পোজিয়াম (অনুবাদ), ভুলের মূল্য, সহজ গণিত, আধুনিক ভূগোল, প্রবেশিকা বাংলা ব্যাকরণ, মানবমনের ক্রমবিকাশ ইত্যাদি।
বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মশালবাহী এই বিজ্ঞানী সাহিত্যিকের ঋণ অনস্বীকার্য। এমন বৈচিত্রময় অবদান তিনি রেখেছেন যে আজকের দিনে ভেবে অবাক হতে হয়। পরিসংখ্যানবিদ্যা পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে মোতাহার হোসেন যেমন প্রবর্তকের দাবিদার, তেমনি বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও এ দেশে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পরামর্শে তিনিই প্রথম বাংলায় পদার্থবিদ্যার ব্যবহারিক শিক্ষার বই লিখেছিলেন।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং পরবর্তী সময়ে বই লিখে মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার জোরালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মোতাহার হোসেন। এ ধারায় তিনি জগদীশচন্দ্র বসু, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচিত হবেন। ড. কাজী মোতাহার হোসেন ১৯৮১ সালের ৯ অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জুলাই ২০১৫/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন